প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে দল গোছানোর কাজ শুরু করেছে ক্ষমতাসীনরা। করোনা পরিস্থিতির অবনতি বা উন্নতি এবার থেকে থাকবে না আওয়ামী লীগ। যেসব জেলা, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়নের কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ সেসব স্থানে সম্মেলন করা হবে। স্বশরীরে না পারলে ভার্চুয়ারি সংগঠনের দল গোছানোর কাজ সম্পন্ন করা হবে এমনই সিদ্ধান্ত হাই-কমান্ডের। দ্বাদশ নির্বাচনের এক বছর সময় হাতে রেখে দলকে একটি শক্ত ভীতের উপর দাড় করাতে চাচ্ছেন নেতারা। নির্বাচনের আগে কেন্দ্র থেকে শুরু করে দলের সর্বস্তরে নতুন নেতৃত্ব আনা হবে। গত ইউপি নির্বাচনে যারা বিদ্রোহী হয়ে বহিষ্কার হয়েছেন, যাদের শোকজ করা হয়েছে তাদের কোন পর্যায়ের কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে না রাখতেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তাই আট বিভাগের আট সাংগঠনিক টিম তাদের কাজের খসড়া প্রস্তুত করছেন। তৃণমূল সংগঠনকে তাদেরকাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন; কখন সম্মেলন করা যাবে তা নির্ধারণ করছেন। এ মাসের শেষ দিকে সফর শুরু করবে সাংগঠনিক টিমগুলো। ইতোমধ্যে, স্বশরীরে এবং ভার্চুয়ালি অনেকগুলো সমন্বয় মিটিং করেছে টিমগুলো। সাংগঠনিক টিমের সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে প্রায় ৭০ শতাংশ সম্মেলনের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। তবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কাজ এর প্রায় অর্ধেক।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি গণভবনে দলের সভাপতিমন্ডলীর সভায় আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। দলীয় সূত্র মতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সাপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। তাই আগামী বছর নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য এ বছরের মধ্যে দলের সকল সম্মেলন শেষ করে কমিটি গঠনের কাজ সম্পন্ন করতে চায় আওয়ামী লীগ।
নেতারা জানান, এপ্রিল মাস থেকে পবিত্র রমজান উপলক্ষে সাংগঠনিক কার্যক্রম সীমিত থাকবে। এবং জুলাই এর শেষে ঈদুল আজহা থেকে শোকের মাস আগস্ট পর্যন্ত সম্মেলনের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। তাই মার্চ, মে, জুন ও জুলাই এ চার মাস দল গোছানোর কাজ সম্পন্ন করতে চায় আওয়ামী লীগ। রোজার মাসেও কয়েকটি জেলায় সীমিত আকারে সম্মেলন হতে পারে। এছাড়া আগস্টের পর কয়েকটি সহযোগী সংগঠন যেমন মহিলা লীগ, যুব মহিলা লীগ, তাতী লীগ, ভাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগের সম্মেলনের কথা ভাবছে ক্ষমতাসীনরা। এবছরের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির তিন বছর সম্পন্ন হবে। ২০১৯ সালে কেন্দ্র এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যথাযত নিয়মে এবারও ডিসেম্বরে কিংবা পরবর্তী দুই এক মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সম্মেলনের সম্ভাবনা রয়েছে। সেজন্য আগে ভাগে জেলা, উপজেলা, মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী সংগঠনের সম্মেলন করার বিষয়ে দলের হাই-কমান্ড সকল কাজ গুছিয়ে আনছেন। যেন নির্বাচনী বছর শুধুমাত্র নির্বাচনী কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে পারে সংগঠন।
কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, নির্বাচন আসলেই দেশী ও আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র হয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করবে। তাই দল শক্তিশালী থাকলে যেকোন ষড়যন্ত্র, আন্দোলন প্রতিহত করা সহজ হবে।
এদিকে ইউপি নির্বাচনকেকেন্দ্র করে যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে এবং শোকজ করা হয়েছে তাদের পদে না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গতকাল দলের খুলনা বিভাগী টিমের সভায় এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। খুলনা বিভাগের অন্তর্গত সাংগঠনিক জেলা, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকবৃন্দ, দলীয় সংসদ সদস্যগণ এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের সাথে খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের ভার্চুয়াল বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়। দল থেকে বহিষ্কার হওয়া কেউ বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো পদে আসতে পারবেন না এবং যাদের শোকজ করা হয়েছে, তাদের উত্তর সন্তোষজনক না হলে তাদের বেলায়ও একই নিয়ম প্রযোজ্য বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।
বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডিস্থ রাজনৈতিক কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য অ্যাডভোকেট মো. আমিরুল আলম মিলন, পারভিন জামান কল্পনা ও অ্যাড. গ্লোরিয়া সরকার ঝর্ণা।
বৈঠকের বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের লক্ষ্য আগামী জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখেই দল গোছানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। যে সব জায়গায় নেতাকর্মীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে, সেগুলো মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, যারা দলের নির্দেশনা মানে না, তাদের বিষয়ে তো আমাদের আগে থেকেই নির্দেশনা আছে। যারা বহিষ্কার হয়েছে, সাময়িক বহিষ্কার হয়েছে, শোকজ হয়েছে, তাদেরটা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাদের নেতৃত্বে আনা যাবে না। এ বিষয়গুলোকে সামনে রেখে দলকে গণমুখী করা, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলকে ঢেলে সাজানো যাতে দলের নতুন নেতৃত্বের ওপর জনগনের প্রত্যাশারা জায়গাটা আরও শক্তিশালী হয়, সুদৃঢ় হয়। এ লক্ষ্যে দলকে সম্মেলন করতে হবে।
বৈঠকে উপস্থিত নেতারা আরো বলেন, যাদেরকে শোকজ করা হয়েছে তাদেরকে নেতৃত্বে আনার সুযোগ নেই। কোনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেই তারা আসতে পারে না। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হতে পারে না। যাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে তাদেরকে জায়গা দেওয়ার সুযোগ আছে কিন্তু সেটা বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার হওয়ার পর। আর আগে তাদেরকে কোন জায়গায় আনা যাবে না। যাদেরকে শোকজ করা হয়েছে, তাদের নিষ্পত্তি হওয়ার পর তারা পদে আসতে পারেন।
দলের নীতি-নির্ধারকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০২২ সালের মধ্যে দল গোছানো কাজ শেষ করা হবে। নির্বাচনের আগ মূহূর্তে কেন্দ্রীয় নেতাসহ যারা এমপি পদপ্রার্থী থাকেন তারা নিজ নিজ এলাকা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন দল গোছানোর কাজ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। আর নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করাও কঠিন হয়ে যায়। তাই আগে ভাবেই দল গোছানোর কাজ শেষ করা হবে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে প্রতিনিধি সভা, কর্মীসভা, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছে। নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এসব কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হবে।
এরই মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনী প্রস্তুতি হিসেবে আট বিভাগের জন্য অনলাইনে গুজব ও অপপ্রচার মোকাবিলায় ১ লাখ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টকে প্রশিক্ষণের আওতায় এনেছে দলটি। ইস্যু তৈরি করে জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনো অপশক্তি আন্দোলনের চেষ্টা করলে রাজপথেই তার জাবাব দিতেও প্রস্তুত আওয়ামী লীগ। নেতারা জানান, বিএনপির আন্দোলন মোকাবেলায় আওয়ামীলীগের তিন কৌশল থাকবে। বিএনপি যদি জ্বালাও-পোড়াও করে, তাহলে দলের নেতা-কর্মীরা তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তুলে দেবে। আর গুজব রটালে তাদের বিষয়ে আমরা জনগণকে সচেতন করবে। তাদের মিথ্যা কোনো তথ্যের বিষয়ে আমাদের নেতা-কর্মীরা সচেতন থাকবে। তৃতীয়ত, তাদের যেকোনো অসত্য বক্তব্যের বিষয় জনগণ যাতে বিভ্রান্ত না হয়, সে বিষয়ে আমরা অবশ্যই কাউন্টার দেবে।
আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সবুর ইনকিলাবকে বলেন, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তত বেশি গুজব ও অপপ্রচার ছড়ানোর চেষ্টা করবে। এটা সঠিক। কিন্তু সেটা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। আমরা আমাদের নেতা-কর্মীদের তৈরি করছি, যাতে কোনো তথ্য সন্ত্রাস হলে তারা তৈরি থাকতে পারে। সেই সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীরা যাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারে।
গুজব প্রতিরোধে আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপকমিটি কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আসলে এটা আমাদের কাজেরই একটা অংশ। আমরা দলীয় নেতা-কর্মীদের শেখাচ্ছি যে, কোনো ফেক নিউজ হলে নেতা-কর্মীরা কীভাবে দ্রুত সে বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাজ করবে, যাতে দলের নেতা-কর্মীরা সর্বশেষ আপডেট দিতে পারেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন