বিএনপির দুই গ্রুপের ঐক্যের ভোটে ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন মনিরুল হক সাক্কু।কিন্তু এবারের নির্বাচনে ভোটের মাঠের প্রেক্ষাপট পাল্টে গেছে। দলের যে ভোটে মেয়র হয়েছিলেন সাক্কু, সেই ভোটে বিভক্তির দেওয়াল রচনা করলেন দলটির তরুণ নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সার। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপি থেকে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা–কর্মীদের প্রচারণায় অংশ না নেওয়ার জন্য বিশেষ নির্দেশনা জারি করেছে । শনিবার রাত ১০টার দিকে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি বেগম রাবেয়া চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আমিন উর রশিদ ইয়াছিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
অপরদিকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত এবারের নির্বাচনে বিএনপি দলীয় দুই প্রার্থীর বিষয়টি মাথায় নিচ্ছেন না। তার মতে নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত। এখানে আওয়ামী লীগের ভোট ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
নির্বাচনে অংশ নেয়ার কারণে দল থেকে অব্যাহতি ও পরে বহিস্কার হওয়া কায়সার জেলা বিএনপির একটি বড় ও মূলধারার নেতৃত্বে থাকা সাধারণ সম্পাদক হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিনের (হাজী ইয়াছিন) পরম আত্মীয় (শ্যালক)। সে¦চ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রিয় কমিটির সাবেক সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও মহানগরের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার গণমাধ্যমে বলেছেন, তৃণমূলের নেতকর্মীদের অনুরোধে তিনি প্রার্থী হয়েছেন।শেষ পর্যন্ত ভোটের লড়াইয়ে থাকবেন। সাক্কু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০১৭ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতাকর্মী সমর্থকরা ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনের মাঠে কাজ করে, ধানের শীষে ভোট দিয়ে মনিরুল হক সাক্কুকে মেয়র বানিয়েছে। আর সেই মেয়র গত ৫ বছর আওয়ামী লীগের গুনকীর্তনে ব্যস্ত ছিলেন। নিজ দলের নেতাকর্মীদের মামলাসহ নানাভাবে হয়রানীর পেছনে তার হাত ছিল। গত ৫ বছরে তিনি দলে বিতর্কিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। এবারে তাকে তৃণমূল বিএনপি বয়কট করবে। ২০১৭ সালের ভোটের মাঠ আর ২০২২ সালের ভোটের মাঠ এক নয়।
এদিকে জেলা বিএনপির একাধিক নেতা জানান,শনিবার রাতে জারি হওয়া দলের নির্দেশনা অনুযায়ি দল থেকে বহিস্কৃত সাক্কু ও কায়সারের নির্বাচনী কার্যক্রমে নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে অংশ না নিলেও পরোক্ষভাবে দু’জনের জন্যই কাজ করবেন। তবে এবারে একই দলের দুই প্রার্থী হওয়ায় কোন্দলের এ সুযোগটা নিবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী।
অপরদিকে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে স্থানীয় এমপি আকম বাহাউদ্দিন বাহারের নির্দেশনা ও দুরদর্শীতায় মহানগর আওয়ামী লীগ বেশ সুসংগঠিত। তৃণমুলের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করার মধ্যদিয়ে নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডে মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন হয়েছে। এবারের সিটি নির্বাচনে সবকটি ওয়ার্ডে নেতাকর্মীরা দলীয় প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখে নৌকায় বিজয় নিশ্চিত করবেন, এমনটি আশাবাদী মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা।
দলের মধ্যে যতোই ব্যক্তি বিরোধ থাকুক, সবকিছুর উর্ধ্বে দলের স্বার্থ এবং দলীয় প্রতীকের মর্যাদা রক্ষার এক কঠিন লড়াই শুরু হয়েছে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে। আগামী ১৫ জুন অনুষ্ঠিতব্য কুমিল্লা সিটি নির্বাচনকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে দেখছে আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, দলের কোন্দলকে পুঁজি করে গত ৩২ বছর ধরে টানা বিলুপ্ত কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান ও সিটি করপোরেশনের মেয়রের পদটি বিএনপি দলীয় দুই ব্যক্তির দখলে ছিল। ৩২ বছর আগে আকম বাহাউদ্দিন বাহার বিলুপ্ত কুমিল্লা পৌরসভার দুইবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর আর আওয়ামী লীগের কেউই চেয়ারম্যান বা মেয়র হতে পারেননি। এবার সময় এসেছে, সরকারের উন্নয়নের রোডম্যাপে নগর কুমিল্লাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্যের জায়গায় নিতে হলে নৌকার প্রার্থীর জয়ের বিকল্প নেই।
এদিকে নগরজুড়ে গুঞ্জন ডালপালা মেলেছে সাক্কু ২৬মে তার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। এধরণের গুঞ্জনের জবাবে গণমাধ্যমে সাক্কু বলেছেন, তিনি নির্বাচনের মাঠে আছেন, থাকবেন। নির্বাচনের সব প্রস্তুতি তার নেওয়া আছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় বিএনপি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মনিরুল হককে (সাক্কু) আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করে। একই সঙ্গে মনিরুলের সঙ্গে দলের নেতা–কর্মীদের যোগাযোগ না করার জন্য বলা হয়। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবক দলের কুমিল্লা মহানগরের সভাপতি মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সারকে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। যদিও বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র বৈধ হওয়ার পর মনিরুল বিকেলে এবং নিজাম দুপুরে দল থেকে পদত্যাগ করেন।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ‘বিএনপির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীন জাতীয় ও স্থানীয় কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনিরুল হক ও মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার অংশগ্রহণ করায় তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের নেতারা কেউ তাদের পক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করলে তা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সংগঠনবিরোধী কার্যক্রম হিসেবে গণ্য হবে এবং তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আগামী ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএমে ভোট হবে। নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় দুই মেয়র প্রার্থী মনিরুল ও নিজাম। ২৬ মে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। ২৭ মে প্রতীক বরাদ্দ, এরপর প্রচারণা শুরু হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন