শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

চাপে পড়েছে অর্থনীতি

বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাসের দাম বাড়ছে সরকারকে সবার আগে ভোক্তার স্বার্থ দেখতে হবে : পিআরআই নির্বাহী পরিচালক সরকার ভর্তুকি দিয়ে পারবে না : ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৫ এএম

বিশ্বাবাজারে এমনিতেই এক বছরের ব্যবধানে জ্বালানির দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। তার উপর বর্তমানে ইউক্রেনে অস্থিরতার জেরে আরও চড়াও হয়ে উঠেছে এই অপরিহার্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার। বর্তমানে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম গিয়ে ঠেকেছে প্রায় ৯৪ ডলার। তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম বেড়েছে আরও বেশি হারে। ফলে চাপে পড়ছে বাংলাদেশের মতো দেশ। যাদের জ্বালানির বড় অংশ আমদানিনির্ভর। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাজ্য জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে ৫৪ শতাংশ।

উচ্চমূল্যে কিনে তুলনামূলক সহনীয় দামে জ্বালানি পণ্য সরবরাহের কারণে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি গুণেছিল সরকার। চলতি অর্থবছরে ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা ভর্তুকি রাখা হয়েছে। তবে বিশ্ববাজারে জ্বালানির বর্তমান যে দাম তাতে এই ভর্তুকি ৪৫ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে বলে সরকারি কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। তাদের ভাষ্য, এই চাপ সামলাতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্নেষকরা বলছেন, করোনাকালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে চাপে আছে সীমিত আয়ের মানুষ। এর মধ্যে বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়লে ভোগান্তি আরও বাড়বে।

গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ২৫ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি লাগবে বলে সরকারকে জানিয়েছে পিডিবি। এর ব্যাখ্যায় সংস্থাটি বলছে, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রিতে পিডিবির লোকসান হচ্ছে দুই টাকা ৫৭ পয়সা। গত অর্থবছর এ লোকসান ছিল ৬৩ পয়সা। সংস্থাটি বলছে, গ্যাস সংকটে তরল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্র থেকে অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে খরচ আরও বাড়বে। কারণ, দেশের প্রায় ৭০ ভাগ বিদ্যুৎ আসে গ্যাস থেকে। দাম বৃদ্ধি না করলে সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে হবে।

জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতেও ভর্তুকি বেড়েছে। গত বছর শুধু বিদ্যুতে এলএনজি সরবরাহের জন্য ৬ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে।
চলতি বাজেটে গ্যাস খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। যদিও প্রথম ৬ মাসেই এলএনজি আমদানিতে সরকারের লোকসান হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। এখনও এলএনজির আন্তর্জাতিক বাজার ঊর্ধ্বমুখী। জ্বালানি বিভাগ বলছে, ২০২০ সালের অক্টোবরে স্পট মার্কেটে প্রতি এমএমবিটিইউ (প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) এলএনজির দাম ছিল ৮ মার্কিন ডলার। এখন ২৫ ডলারের ওপরে। আগে একটি এলএনজি কার্গো আনতে খরচ হতো ২৫০ কোটি টাকা, এখন খরচ পড়ে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

পেট্রোবাংলা বলছে, আমদানি করা এলএনজির সঙ্গে দেশীয় গ্যাসের মিশ্রণের পর প্রতি ঘনফুটের খরচ পড়ে ২২ টাকা। গ্রাহকদের কাছে তা বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৯ টাকা দরে। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম যে হারে বাড়ছে তাতে প্রতি ঘনফুট এলএনজির দাম ৩০ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় এলএনজি খাতে ভর্তুকি আরও বাড়বে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে প্রতি ঘনমিটার এলএনজি আমদানিতে খরচ হয়েছে ৩১ টাকা ৫৩ পয়সা। অথচ বিদ্যুৎ খাতে প্রতি ইউনিট গ্যাস বিক্রি হয়েছে চার টাকা ৪৫ পয়সায়। এলএনজি আমদানির কারণে ২৭ টাকা বাড়তি খরচের বোঝা যুক্ত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এলএনজি আমদানিতে খরচ বাড়বে ৭২ শতাংশ। গড়ে প্রতি ইউনিট এলএনজি কিনতে হবে ৩৪ টাকা ৩৭ পয়সায়। এটি সরবরাহ পর্যন্ত পেট্রোবাংলার ইউনিটে খরচ পড়বে ৫০ টাকা ৩৯ পয়সা।
আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার-সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের ডিসেম্বর মাসের সর্বশেষ সভায় বলা হয়, চলতি বাজেটে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ বিভাগ হিসাব করে দেখছে এর পরিমাণ আরও বাড়বে। বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধিতে জ্বালানি তেল, সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লোকসান বেড়ে ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি লাগতে পারে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ভর্তুকি বাড়লে বাজেট ঘাটতি বাড়বে। চাপে পড়বে অর্থনীতি। ভর্তুকির চাপ সামলাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারকে সবার আগে ভোক্তার স্বার্থ দেখতে হবে। তবে সার, গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ, প্রচুর দাম বেড়েছে। সরকারকে ভর্তুকি দিতে হলে বাড়তি ৫০ হাজার কোটি টাকা লাগবে, যা প্রায় দুটো পদ্মা সেতু নির্মাণের সমান ব্যয়।

তিনি বলেন, সরকার ভর্তুকি দিলে সেই টাকা কোথা থেকে আসবে? হয় টাকা ছাপতে হবে, তাতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, নতুবা ঋণ করতে হবে। দিনশেষে জনগণের কাছ থেকেই এই বাড়তি খরচ যাবে। সবশেষ উপায় হতে পারে দাম বাড়ানো। এক কথায় পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে কোনোটাই হজম করার মতো নয়।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, বাংলাদেশে যে পরিমাণ গ্যাসের প্রয়োজন তার জন্য কুয়েতের সঙ্গে চুক্তি আছে। কুয়েত থেকে দৈনিক এক হাজার এমএমবিটিইউ গ্যাস পাওয়ার কথা। বাংলাদেশ আনছে ৭০০ এমএমবিটিইউ। চুক্তি থাকা সত্ত্বেও কেন কম আনা হচ্ছে, কেন স্পট মার্কেট থেকে কেনার প্রসঙ্গ আসছে, প্রথমে এর সমাধান হওয়া উচিত। এরপর আলোচনা হবে দেশের বাজারে দাম বাড়ানো নিয়ে। সরকার ভর্তুকি দিয়ে পারবে তা মনে করে না ক্যাব। তবে অপ্রয়োজনীয় আমদানিরও পক্ষে না। ব্যবসায়িক স্বার্থের চেয়ে সরকারকে জনস্বার্থ বেশি দেখতে হবে।

গ্লোবাল পেট্রোল প্রাইস ডটকমের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গৃহস্থালিতে ৫ টাকা ৫২ পয়সা এবং বাণিজ্যে (শিল্পসহ) ৮ টাকা ৯২ পয়সা। ভারতে এই দাম যথাক্রমে ৬ টাকা ৫৪ পয়সা ও ৯ টাকা ৩৫ পয়সা, পাকিস্তানে ৪ টাকা ৬৭ পয়সা ও ১৩ টাকা ২৬ পয়সা, শ্রীলঙ্কায় ৫ টাকা ৯৫ পয়সা ও ৫ টাকা ৪৪ পয়সা। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের গড় দাম প্রতি ঘনমিটার গড়ে ৯ টাকা ৩৬ পয়সা পাকিস্তানে এই দাম ৬ থেকে ১৫ টাকা, এলএনজি মিশ্রিত অবস্থায় দাম পড়ে ৩৭ টাকা। ভারতের মুম্বাইয়ে প্রতি ঘনমিটার সিএনজির দাম ৭৫ টাকা ২৪ টাকা, যা বাংলাদেশে ৪৩ টাকা। মুম্বাইয়ে গৃহস্থালিতে প্রতি ঘনমিটারের দাম ৪৫ টাকা বাংলাদেশে ১২ টাকা ৬০ পয়সা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
عمر فاروق ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ৬:৩২ এএম says : 0
দুর্নীতি বন্ধ না করে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া আরো দুর্নীতির পথ খোলার চেষ্টা ।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন