আবারো তেল-গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন(বিপিসি)’র একটি প্রস্তাব ইতিমধ্যেই এনার্জি রেগুলেটরী কমিশনের(বিইআরসি) কাছে পাঠানো হয়েছে এবং এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে বিপিসি ও বিইআরসি গত সোমবার বৈঠকে বসেছিল বলে জানা যায়। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে গ্যাসের চাহিদা পূরণে ১০০০মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি(তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানী করতে যাচ্ছে সরকার। এ খাতে সরকারকে অতিরিক্ত ১৪-১৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে বিধায় অর্থের যোগান নিশ্চিত করতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়েই ভাবছে। উল্লেখ্য গত কয়েক বছরে দফায় দফায় জ্বালানির মূল্য বাড়ানো হয়েছে। এমনকি বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানির মূল্যহ্রাস অব্যাহত ছিল তখনো আমাদের দেশে জ্বালানির মূল্য বাড়ানো হয়েছে। গণশুনানীতে অংশগ্রহণকারী সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মূল্য সমন্বয়ের দাবী উপেক্ষা করে অতীতের ভর্তুকি ও লোকসানের অজুহাত তুলে বিইআরসিকে মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাবেই দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। গত বছরের ফেব্রæয়ারীতে গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাবটি যথানিয়মে গৃহীত না হওয়ায় মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া উচ্চ আদালতের রায়ে স্থগিত হওয়ার ঘটনা জনমনে কিছুটা স্বস্তি এনে দেয়। এমনিতেই নিত্যপণ্যসহ বাজারে মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ দরিদ্র মানুষের জীবনে দুর্ভোগ বেড়েছে। তেল-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি হলে উৎপাদন, পরিবহন খরচসহ নিত্যপণ্যের মূল্য নিশ্চিতভাবেই আরেক দফা বাড়বে। ডিজেল, ক্যারোসিন ও গ্যাসের মূল্য লিটার ও ঘনফুটে ৭ থেকে ১৩ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হচ্ছে বলে জানা যায়।
বিদ্যুত ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের স্বল্প আয়ের মানুষ। পণ্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে এমনিতেই সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। এহেন বাস্তবতা বিবেচনা করেই সরকারের সংশ্লিষ্টরা নির্বাচনের আগে তেল, গ্যাস বা বিদ্যুতের মূল্য বাড়াবে না বলে জানিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার একটি সম্ভাব্য খতিয়ান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নানা কারণে দেশে বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান, গার্মেন্টস খাতসহ রেমিটেন্স আয়ের মূল খাতগুলোতেও মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। এহেন বাস্তবতায় জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব দেশের কৃষি, শিল্প বাণিজ্যসহ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো দুর্বিষহ করে তোলছে। প্রায় এক দশক ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য কমলেও আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ তার কোন সুফল পায়নি। বিশ্ববাজারে মূল্য বাড়লে ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে মূল্য বাড়ানো হলেও মূল্য কমলে মূল্য সমন্বয় করার উদ্যোগের বদলে মূল্য বাড়ানো হয়েছে। তেল, গ্যাস, কয়লার দেশীয় উৎসের উন্নয়ন, সংস্কার ও নতুন নতুন উৎস থেকে জাতীয় গ্রীডে সরবরাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ না নিয়ে শুধুমাত্র জনগণের পকেট থেকে টাকা নিয়ে ভর্তুকির যোগান নিশ্চিত করার অপরিণামদর্শি সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে দেশের বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সরকারের বিশেষ উদ্যোগের ফলে গত ৯ বছরে দেশে বিদ্যুত উৎপাদন দ্বিগুনের বেশী বাড়লেও বিদ্যুত নিয়ে জনদুর্ভোগ কমেনি। এখনো ঘন্টার পর ঘন্টা লোডশেডিং পোহাতে হয়। অন্যদিকে গ্যাস সংযোগের অভাবে দেশের আবাসন এবং শিল্পখাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। সরকারী অনুমাদন লাভের পরও তিনশতাধিক শিল্পকারখানায় গ্যাস সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অবশেষে এলএনজি আমদানী করে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগের বাড়তি খরচ মেটাতেই গ্যাস, ডিজেল ও কেরোসিনের মত প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জ্বালানি চাহিদার উপর বাড়তি খরচের বোঝা চাপানোর উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। জ্বালানিখাতের টেকসই উন্নয়ন ও ক্রমবর্ধমান চাহিদার যোগান নিশ্চিত করতে এ খাতে মূল্য সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। তবে দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাসহ সার্বিক বাস্তবতা বিবেচনায় রাখতে হবে। উচ্চ ভর্তুকির রেন্টাল বিদ্যুতের খরচ অব্যাহত রেখে তেল-গ্যাস ও বিদ্যুতের বাড়তি খরচ দরিদ্র মানুষের উপর চাপানোর সিদ্ধান্ত পরিহার করতে হবে। জনগণের ট্যাক্সের হাজার হাজার কোটি টাকা রেন্টাল, কুইকরেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্রে দীর্ঘমেয়াদি ভর্তুকির যোগান অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্খিত। অন্যদিকে সিস্টেম লস, অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে এ খাতের একটি বড় অংশই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পকেটে চলে যায়। পুরনো বড় বড় বিদ্যুতকেন্দ্রের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ও কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে কয়েকগুন বেশী মূল্যে এড-হক ভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে বছরের পর বছর ধরে বিদ্যুত কেনার অপরিণামদর্শি সিদ্ধান্তের মাশুল দিতে হচ্ছে জনগণকে। তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য আর না বাড়িয়ে এ খাতের টেকসই উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয়া হোক। সেই সাথে দুর্নীতি, অপচয় ও সিস্টেমলস কমিয়ে লোকসান ও ভর্তুকির খরচ সমন্বয় করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমলেও আভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রেখে এক সময়ের লোকসানি বিপিসি গত তিন বছরে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশী মুনাফা করেছে বলে জানা যায়। এহেন বাস্তবতায় এলএনজি ক্রয়ের খরচ মেটাতে গ্রাহক পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির বদলে বিকল্প পন্থাগুলো নিয়েই ভাবতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন