শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সংসার টিকিয়ে রাখাতেই সুখ

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৮ এএম

মানুষের জীবনে সংসার অতিব গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রযোজনীয় হলেও সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে এই সংসারে বিচ্ছিন্নতা এবং বিচ্ছেদের যে প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তা রীতিমত ভয়ংকর, হতাশাজনক ও উদ্বেগজনক। সংসারে ভাঙ্গন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক বা বিচ্ছেদ কোনো অবস্থাতেই মঙ্গলজনক নয়। প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকায় এখন প্রতি ঘণ্টায় একটি সংসারের বিচ্ছেদ হচ্ছে। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় ২০২১ সালে মোট ১১৯১৯টি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। ২০২০ সালের তুলনায় এই সংখ্যা ২১৩২টি বেশি। বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পুরুষ এবং নারী উভয়েই দায়ী হলেও নারীরাই এগিয়ে রয়েছে। ২০২১ সালে ঢাকায় সংগঠিত বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্যে ৭১% ক্ষেত্রে নারীরা বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেছে, আর ২৯% ক্ষেত্রে পুরুষরা বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেছে। বিচ্ছেদ বা তালাকের এই প্রবণতা ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত সর্বত্রই বিদ্যমান।

একটি ছেলে এবং এটি মেয়ে যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন নতুন একটি সংসার গঠনের পাশাপাশি দুই পরিবার এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের মাঝেও একটি সুসম্পর্ক এবং বন্ধন গড়ে ওঠে। সংসারজীবন স্থায়ী হলে, এসব সম্পর্কও স্থায়ী হয়। অপরদিকে সংসার জীবনে বিচ্ছেদ হলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদের পাশাপাশি দুই পক্ষের পরিবার এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনের মাঝে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তা ভেঙ্গে যায়। সুতরাং সংসারের বিচ্ছেদের মাঝে কোনো ধরনের অর্জন নেই, বরং সব দিকেই ক্ষতি। একটি সংসার যখন ভেঙ্গে যায়, তখন সংসারের পুরুষ মানুষটি যেমন একাকী হয়ে যায়, তেমনি নারী মানুষটিও একাকী হয়ে যায়। আর একাকী জীবন কখনো সুখের হয় না। তাদের মাঝে হতাশা, বিষণ্নতা এবং দুশ্চিন্তা চলে আসে। মানসিকভাবে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। পুরুষ মানুষটিকে যেমন নতুন করে বিয়ে করার জন্য ভাবতে হয়, ঠিক তেমনি নারী মানুষটিকেও নতুন করে বিয়ে করার জন্য ভাবতে হয়। পুরুষ মানুষটিকে যেমন নতুন করে সংসার গড়ার জন্য উদ্যোগ নিতে হয়, ঠিক তেমনি নারী মানুষটিকেও নতুন করে সংসার গড়ার জন্য উদ্যোগ নিতে হয়। সংসারের বিচ্ছেদ স্বামী এবং স্ত্রীর জীবনে যেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, ঠিক তেমনি তাদের পরিবারেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সংসার ভাঙ্গলে সেই সংসারে জন্ম নেয়া শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের তখন ব্রোকেন পরিবারেই বড় হতে হয়। এটা শিশুদের মনে অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা হতাশা এবং হীনমন্যতায় ভোগে। তাদের মনে একটি ক্ষত এবং একটি দুঃখ স্থায়ীভাবে আসন গড়ে। তারা সবসময় একটি পরিচয় সংকটে ভোগে। ফলে এই শিশুদের মন এবং দেহের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়।

নতুন একটি সংসারের যাত্রা শুরু হলে সেই সংসারে ভালবাসা থাকে, বিশ্বাস থাকে, সহমর্মিতা এবং সহযোগিতা থাকে। এসব সংসারের বন্ধন এবং টিকে থাকার ভিত্তি। কিন্তু যখন সংসার থেকে পারস্পরিক ভালবাসা, বিশ্বাস, ত্যাগ, সহমর্মিতা এবং সহযোগিতা কমে যায়, তখন সেই সংসারের বন্ধন হালকা হয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে ভেঙ্গে যায়। স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের প্রধান কারণ হচ্ছে তাদের মধ্যে বনিবনা না হওয়া। সংসারে বনিবনা না হওয়ার জন্য স্বামী যেসব অভিযোগ স্ত্রীর বিরুদ্ধে করে থাকে তার মধ্যে স্বামীর অবাধ্যতা, অশালীন জীবনযাপন, বদ মেজাজ, শ্বশুর পক্ষের লোকজনকে কম ভালবাসা, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, পরকীয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অপরদিকে সংসারে বনিবনা না হওয়ার জন্য স্ত্রী যেসব অভিযোগ স্বামীর বিরুদ্ধে করে থাকে, তা হচ্ছে, সন্দেহজনক মনোভাব, পরকীয়া, যৌতুক, মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, সংসার ভাঙার কারণগুলো পরিহার করলেই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বনিবনা হবে এবং সংসার টিকে থাকবে। সংসার টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই সবার উচিত এসব কাজকে পরিহার করা। মনে রাখতে হবে, পারস্পরিক ভালবাসা, বিশ্বাস, ত্যাগ, সহমর্মিতা এবং সমঝোতার মাধ্যমেই সংসার টিকে থাকে এবং মজবুত হয়। আর এতেই জীবন সুখের হয় এবং জীবন অর্থবহ হয়ে ওঠে। সুতরাং, সংসারের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থকে পরিহার করতে হবে। সংসারের বন্ধনকে আরো মজবুত এবং স্থায়ী করার জন্য পরস্পরের ছোট খাটো দোষ ত্রুটিকে ক্ষমা করতে হবে। মান অভিমান, অহমিকা, জেদাজেদি এবং রেষারেষি পরিত্যাগ করতে হবে। স্ত্রী কর্মজীবী হলে তাকে একটু বেশি সহযোগিতা করতে হবে। কারণ, সংসার এবং সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব তখনো তাকেই পালন করতে হয়। স্বামীসহ ছেলে পক্ষের সবার উচিত স্ত্রী বা বৌয়ের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, তার প্রতি কোমল আচরণ করা এবং তাকে একটু বেশি সম্মান করা। কারণ, সে কিন্তু তার বাবার বাড়ি, বাবা-মা, ভাইবোন, পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে এসেছে। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ তাদের দাম্পত্য জীবন আমৃত্যু অটুট রেখেছে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধই এ বন্ধনের নিয়ন্ত্রক শক্তি। এরাই সত্যিকারের সুখী। যারা ধর্মকে অনুসরণ করে তাদের দা¤পত্য জীবন অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী এবং যারা ধর্মকে অনুসরণ করে না তাদের দা¤পত্য জীবন অপেক্ষাকৃত স্বল্পস্থায়ী। এটি বর্তমান সময়েও প্রমাণিত সত্য। কাজেই সবারই উচিত নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা। জাপানের এক দম্পতি ২০১৭ সালে তাদের সংসার জীবনের আশি বছর পূর্ণ করেছে। মাসাও-মিয়াকো নামের এই দম্পত্তি ১৯৩৭ সালে বিয়ে করেন এবং ২০১৯ সালে স্বামী মাসাওয়ের বয়স হয়েছে ১০৮ বছর এবং স্ত্রী মিয়াকোর বয়স হয়েছে ১০০ বছর। এই দম্পত্তির নাম গিনেস বুকে স্থান পেয়েছে। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ও তার স্ত্রী সিতি হাসমার বিয়ে হয় ১৯৫৬ সালে এবং সেই দাম্পত্য এখনো বিদ্যমান। এ রকম আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে, যাদের দাম্পত্য সম্পর্ক আজীবন অটুট রয়েছে। টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী দাম্পত্য সম্পর্ক এসব মানুষের জীবনকে সুখী, সমৃদ্ধ এবং গতিশীল করেছে। করেছে কর্মমুখর এবং দিয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য।

লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
omar_ctg123@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন