১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাতিদীর্ঘ একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি শুধু ঐতিহাসিকই ছিল না, এটি ইতিহাস সৃষ্টির কারণ হয়েছে এবং যারা ১৯৭১ সালে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে। ক্ষুরধার, নান্দনিক ও প্রখর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন যেই বক্তব্য তিনি রেখেছিলেন, তা কেবল বাংলাদেশের নয়, পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী মানুষের জন্য বার্তা বহন করে চলেছে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ড ৪৩১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন জাতীয় নেতা, বীর ও সেনাপতিদের মধ্য থেকে ৪১ জনকে নির্বাচিত করে Speeches that Inspired History শিরোনামের একটি মূল্যবান গ্রন্থ সংকলন করেন এবং সেই গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর এই মূল্যবান ভাষণটিকে অন্তর্ভুক্ত করেন। দিন যত গড়িয়েছে, এই ভাষণের তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক মূল্য ততই বেড়েছে; এটা অনুধাবন করতে পেরেছেন বিশ^নেতৃবৃন্দও। ২০১৭ সালর ৩০ অক্টোবর ভাষণটিকে বিশ্বসংস্থা ইউনেস্কো ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে’ বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভাষণটি এখন বাংলাদেশ বা আওয়ামী লীগের একক কোনো সম্পদ নয়, এটি এখন বিশ্বের ইতিহাসমনস্ক সমাজ ও সভ্যতার অতীত নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের সবার সম্পদ। বঙ্গবন্ধুর ১৩০৮ শব্দের অলিখিত এই ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন, অনন্য উচ্চতায় আসীন, নিপীড়িত, নিস্পেষিত মুক্তিকামী মানুষের পথের দিশা এবং অনুসরণীয় হিসেবে বিবেচিত।
বিশ্বের অন্যতম সেরা ভাষণসমূহ
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F. Field যে ৪১ জন জাতীয় নেতা, বীর ও সেনাপতির ভাষণ নির্বাচন করে তার গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেছেন তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পেরিক্লিস, আলেকজান্ডার, হ্যানিবল, জুলিয়াস সিজার, সালাদিন, নেপোলিয়ন, গ্যারিবল্ডি, আব্রাহাম লিঙ্কন, ভøাদিমির ইলিচ লেনিন, এডলফ হিটলার, চার্চিল, মাও, রুজভেল্ট, স্টালিন, হো চি মিন প্রমুখ নেতৃবৃন্দের ভাষণ সংকলিত হয়েছে গ্রন্থটিতে। আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস বিশ্বের সেরা ভাষণ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদ যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে জাতীয় সৈনিক সমাধিক্ষেত্র উৎসর্গকরণ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’ ছিল লিখিত এবং পরিসর ছিল সীমিত। যার সারমর্ম ছিল জনকল্যাণ করতে পারে ‘জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য সরকার, যা পৃথিবী থেকে ধ্বংস হবেই না’। আব্রাহাম লিঙ্কন তাঁর ভাষণে বলেন, ‘আমরা এখানে যা-ই বলি না কেন, পৃথিবী হয়েতো সেটি বেশিদিন স্মরণ রাখবে না। দৃষ্টিও দেবে খুব সামান্য। কিন্তু আমাদের বীর সন্তানদের কার্যকলাপ কখনো স্মৃতির পাতা থেকে বিস্মৃতি হবে না; বরং তাদের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। নিজেদের উৎসর্গ করতে হবে প্রতিনিয়ত।’ তাঁর বিখ্যাত উক্তি- ‘Government of the people, by the people, for the people’ ’ গেটিসবার্গের ভাষণেরই অংশ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ১৯৪০ সালের ৪ জুন তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, We shall fight on the beaches, we shall fight on the landing grounds, we shall fight in the fields and in the streets, we shall fight in the hills, we shall never surrender এখানে we shall fight ছিল বক্তৃতার শিরোনাম।
একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মার্টির লুথার কিং ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তার শিরোনাম ছিল: I have a dream উক্ত বক্তৃতার একটি অংশ ছিল: I have a dream that one day this nation rise up and live out the true meaning of its creed. We hold these truths to be self-evident, that all men are created equal. I have a dream that my four children will one day live in a nation where they will not be judged by the colour of their skin, but by the content of their character.
আমেরিকায় যখন ব্রিটিশ আধিপত্য অহনীয় হয়ে ওঠে এবং সবকিছুতেই ব্রিটিশরা নাক গলাতে থাকে তখনই অর্থাৎ ২৩ মার্চ ১৭৭৫ ভার্জিনিয়ার একটি চার্চের আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে স্থানীয় জনগণের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার জন্য জ্বালাময়ী ভাষণের এক পর্যায়ে পেট্রিক হেনরি বলেছিলেন, ‘আমাকে স্বাধীনতা দাও, নয়ত মৃত্যু’। তার এ ভাষণটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে। যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বর্ণাঢ্য জীবনে অনেক বক্তব্য দিলেও ১৩ মে ১৯৪০-এর ভাষণটি ছিল যেমন সময়োযোগী তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির আগ্রাসী ভূমিকা একের পর এক কালো ছায়ায দেশটিকে ঘিরে ফেলতে থাকে। দূরদর্শী ও বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল অবস্থার প্রেক্ষাপটে হাউস অব কমন্সে সরাসরি জার্মানির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের আহবান জানিয়ে বলেন, ‘এ মুহূর্তে দেয়ার মতো কিছুই নেই আমার। আছে শুধু রক্ত, কষ্ট, অশ্রু আর ঘাম’। প্রখর মেধাসম্পন্ন মহাত্মা গান্ধী জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে উপলদ্ধি করেন, ‘পরাধীন জাতির মেরুদন্ড বাঁকা থাকে, তারা কখন কোনদিক দিয়ে মাথা উঁচু করে ভাগ্যের উন্নয়ন করবে তা জানে না’। সেই দর্শন ও অহিংস নীতিকে সামনে রেখে তিনি ৮ আগষ্ট ১৯৪২ বোম্বের গাওলিয়া ট্যাক ময়দানে ব্রিটিশদের প্রতি অবিলম্বে ‘ভারতবর্ষ থেকে চলে যাও’ স্লোগান শীর্ষক একটি যুগান্তকারী ভাষণ দেন, যা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। ৭ মার্চের জনসভায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু ভাষণটির বিষয়বস্তু আরো অনেক বেশি ব্যাপক। রণকৌশল, স্বাধীনতা আদায় ও রক্ষা এবং জনগণকে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তাসহ কুপমন্ডূকতা থেকে মুক্ত করার দিকনির্দেশনা সম্বলিত সুদূরপ্রসারী অঙ্গীকার। কাব্যিক কৌশলে প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণার দ্বিতীয় নজির পাওয়া যাবে না। Newsweek পত্রিকার ৭ এপ্রিল ’৭১ সংখ্যায় ভাষণটির জন্যে বঙ্গবন্ধুকে Poet of politics আখ্যায়িত করেছিল।
বিশ্বের সেরা ৩১টি ভাষণ নিয়ে গবেষণা করেছেন ড. জালাল ফিরোজ। সেখানে ৭ মার্চের ভাষণের অবস্থানটি কোথায়? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’ উইনস্টন চার্চিলের ‘উই শ্যাল ফাইট অন দি বিচেস’, জওহর লাল নেহেরুর ‘ট্রাইস্ট ইউথ ডেস্টিনি’, মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’- বিখ্যাত এই চার ভাষণের সঙ্গে তুলনা করেছেন শেখ মুজিবের ভাষণটিকে। তুলনামূলক আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, একটি ভাষণের মাধ্যমে একটি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার কাব্যিক এরকম ঘোষণা সত্যি বিশ্ব ইতিহাসে বিরল ও অতুলনীয়। অন্যান্য শ্রেষ্ঠ ভাষণের সাথে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পার্থক্য হলো এর নিখাদ মৌলিকত্ব।
গাজী আজিজুর রহমানের বর্ণনায়, ‘সেদিনের ১৯ মিনিটের বিকেলটা ছিল শুধু তাঁর। সেদিন আর কোনো দৃশ্য ছিল না তাঁর দৃশ্য ছাড়া। সেদিন আর কোন কন্ঠস্বর ছিল না তাঁর কণ্ঠস্বর ছাড়া। সেদিন একটিমাত্র নদী কলস্বরিত ছিল বাঙলায়। সেদিন তিনিই ছিলেন বাঙলার দিনমণি-অংশুমলী। সেদিন সবাই দেখল এক প্রমিথিউসকে, এক হারকিউলিসকে দেখল স্পার্টাকাসরূপী এক অবিসংবাদিত ত্রাতাকে।’ ভাষণটিকে অতি বাস্তব, ইতিহাসনিষ্ঠ, ঐশ্বর্যমন্ডিত বলিষ্ঠ, কবিত্বময়, নাটকীয় এবং একটি নিষ্পেষিত জাতির মুক্তির দলিল হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি। লিখেছেন, ‘কথোপকথনের ভঙ্গিতে সাবলীল ভাষায় বর্ণিত এর আবেগ সজীবতা, নাটকীয়তা, দিকনির্দেশনা, প্রমিত আঞ্চলিক বিদেশী ভাষার মিথস্ক্রিয়া, আপনি তুমি সর্বনামের সম্ভ্রমমূলক ব্যবহার, বজ্রকণ্ঠের বাগবৈদগ্ধ, সম্মোহিত করার জাদুকরি আকর্ষণ, মন্ত্রমুগ্ধতা, যুদ্ধ ঘোষণা করেও যুদ্ধে অবর্তীর্ণ না হওয়ার কৌশলÑ সব মিলে একই অঙ্গে এত রূপের প্রাচুর্যের কারণেই এই ভাষণের শ্রেষ্ঠত্ব।’
বিশিষ্ট লোকতত্ত¡বিদ এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিশ্লেষক শামসুজ্জামান খান ৭ মার্চের ভাষণের ভাষাগত ব্যঞ্জনা ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের একটা স্বকীয় সত্তা ও নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে লৌকিক ভাষাভঙ্গি ও বাকপ্রতিমায় তার চমৎকার ও লাগসই প্রকাশ ঘটে। এই বিশিষ্ট সত্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য চারিত্রিক দার্ঢ্য, বিদ্রোহের মানসিকতা এবং কোনো অবস্থাতেই মাথা নত না করা। বাংলার পৌরাণিক চরিত্র চাঁদ সওদাগর, সাহিত্যের চরিত্র হানিফ গাজী ও তোরাপ, কাব্য¯্রষ্টা কবি নজরুল এবং মানবিক ও রাজনৈতিক চরিত্র শেখ মুজিবে আমরা এই বিদ্রোহী সত্ত¡ার পরিচয় পাই। বাঙালি চরিত্রের এই বিশিষ্ট রূপের স্পর্শে ৭ই মার্চের ভাষণে যুক্ত হয়েছে অনন্য বৈভব। বঙ্গবন্ধু তাঁর আপসহীনতা ও চারিত্রিক দার্ঢ্যরে পরিচয় মুদ্রিত করেছেন লৌকিক বাগভঙ্গির বিশিষ্ট বুলির সংযোজনের মাধ্যমে। প্রাকৃতজনের ব্যবহৃত এইসব মণিমুক্তাসদৃশ শব্দ বাঙালির ব্যবহারিক জীবন থেকে নেয়া। ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর শিকড়সম্পৃক্ত বুলিসমৃদ্ধ এরকম একটি লাইন হলো : সাড়ে সাত কোটি মানুষের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’
ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষণটিকে দেখেছেন মো. আনিস আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে বহু দ্বিবিধ অর্থ বাক্য ও শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং তাতে এই ভাষণদানে তাঁর রাজনৈতিক কৌশলের পরিপক্কতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি নির্বাচনে জয়লাভের পর জাতীয় পরিষদে বসে দেশের জন্য কাজ করার লক্ষ্য বর্ণনা করতে গিয়ে এ দেশ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেন, যার দ্বৈত অর্থ হতে পারে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা তিনি সে সময় পরিষ্কার করে বলেন। পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে সংগ্রাম ও সংঘাতের একটি কালানুক্রমিক বিবরণও দিয়ে যান ভাষণের এই পর্যায়ে, কিছু সন তারিখও উল্লেখ করেন। কিন্তু ইতিহাসের চেয়ে সমসাময়িকতাই তখন বঙ্গবন্ধুর জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয়, দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণের জন্য এবং সেই সুযোগে এই কথাটিও দ্ব্যর্থহীনভাবে বোঝানোর জন্য যে কেন তিনি এই চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন। তাঁর ভাষণের একটি উল্লেখযোগ্য বাক্য হচ্ছে, ‘আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে (ইয়াহিয়া খানকে) অনুরোধ করলাম ১৫ই ফেব্রæয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।’ ভাষণের এই অংশে তিনি তাঁর দুঃখ ও ক্ষোভের কথা হৃদয়স্পর্শীভাবে বলেছেন সেটি আমরা শ্রোতা হিসেবে সকলেই জানি। খানিকটা ব্যঙ্গাত্মকভাবে তিনি যখন বলেন, তিনি আমার কথা রাখলেননা, (বিরতি) ... তিনি রাখলেন (বিরতি) ... ভুট্টো সাহেবের কথা’, তখন সেই বিরতিতে এক ধরনের অনবদ্য নাটকীয় সাসপেন্স সৃষ্টি হয়েছিলো। শেখ মুজিব এ ধরনের সাসপেন্স সৃষ্টিতে দক্ষ ছিলেন। শ্রোতাদের প্রত্যাশা সৃষ্টি করে, তিনি সেই প্রত্যাশিত বাক্যটি তুণের শেষ তীর হিসেবে ছুঁড়তেন, যেন সপ্তদশ শতকের ইংরেজ কবি জন ডান এর বহুল আলোচিত মেটাফিজিকাল উইট এর মতোই তিনি প্রস্তুত করে নিতেন, তাঁর শ্রোতাদের, সেই কাঙ্খিত বাক্যটি বলার জন্য, যা শুনতে প্রতীক্ষিত ছিলো তাঁর লক্ষ লক্ষ শ্রোতা।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির ভাষাতাত্তিক কলাকৌশল বিশ্লেষণ করে এ ভাষণটিকে ভাষাজ্ঞানের স্মারক হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী কাবেদুল ইসলাম তাঁর লিখিত ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ: ভাষাতাত্তি¡ক আলোচনা’ গ্রন্থে। তাঁর ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধু ‘আমি’ ও ‘আমরা’র এ Archaic I Figurative প্রয়োগ করেছেন। তবে সাধারণত ‘আমি’ ব্যবহার করলেও যখন বলিষ্ঠতা ও নিশ্চিতি আনতে চেয়েছেন, তখন ‘আমি’ সর্বনামকে দুবার উচ্চারণেও কুণ্ঠিত হননি। যেমন বলেছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব- আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ এখানে ‘আমি’ ও ‘আমরা’ একে অপরের পরিপূরক, তা বলাই বাহুল্য। একই বাক্যে অব্যবহিত বা পরপর প্রযুক্ত দুই ‘আমি’তে ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছায়- দৃঢ় সঙ্কল্পে নিজেকে শামিল করলেও, পরক্ষণই উচ্চারিত ‘আমরা’ দ্বারা মানুষের অধিকার আদায়ের নিরন্তর কঠোর সংগ্রামে তিনি স্বাভাবিকভাবে তাঁর সহযাত্রী করে নিয়েছেন তাঁর স্বভাষী বাঙালি জনসাধারণকে। অন্যদিকে ‘আমি’ ও ‘আমরা’ সর্বনামের পাশাপাশি বহুবাচনীয় ‘আমাদের’ সর্বনামের চব্বিশ বার প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে জনগণের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধকে আরও গভীর ও আত্মিক করেছেন। বাংলা ব্যাকরণে স্বীকৃত পদবিন্যাস মতে অর্থাৎ ৫ প্রকার পদের অন্যতম সর্বনাম পদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু মোট ৩২টি সর্বনাম ভাষণটিতে ব্যবহার করেছেন (‘এ’ ও ‘এই’- এ দুটো পদকে সর্বনামরূপে গণ্য করে; তবে এ দুটোকে অন্য পদসোপানেও নেয়া চলে)। এগুলোর মধ্যে প্রধান বা সর্বাধিক উচ্চারিত হয়েছে ‘আমার’ (৪০-বার), অতঃপর ‘আমি’ (৩৬-বার), ‘আমরা’ (২৭-বার) ও ‘আমাদের’ (২৪-বার)। একজন দেশপ্রেমিক নেতা কতখানি জনগণ-অন্তপ্রাণ হলে তাঁর বোধে ও বোধিত আমি-আমরা-আমার-আমাদের একাত্ম হয়ে যেতে পারে, তা এ থেকে বোঝা যায়।’ শামসুজ্জামান খান ভাষণটিতে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালি শত শত বছর ধরে যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে, সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে, অসংখ্য কৃষক-বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে এবং তার ফলে স্বাধীনতার যে প্রত্যাশাটি উন্মুক্ত হয়ে উঠেছে তাকে ভাষা দিয়েছেন এবং এই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত একটি ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি সৃষ্টি করেছিলেন। তাই তিনি বাঙালি জাতির স্রষ্টা এবং এই সংগ্রামের ফলে সৃষ্ট বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা।’
রাজনৈতিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোনে এই ভাষণকে বিশ্লেষণ করেছেন অধ্যাপক নুরানা। Method of agreement এবং Method of disagreement কে তাত্তিক লেন্স হিসেবে ব্যবহার করে তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেক মহান নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর উক্তিকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল আরো গভীর, ব্যাপক এবং আবেদনময়ী। নুরানার ব্যাখ্যাটি এরকম, ‘আরেকটি ভাষণ হচ্ছে অখন্ড ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পথিকৃত নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর। তিনি ভারতবর্ষকে ইংরেজ ঔপনিবেশিক নিগড় থেকে মুক্তির লড়াইয়ে নেমে তাঁর বিখ্যাত আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়ে তুলেছিলেন এবং ১৯৪৪ সালে বার্মায় তাঁর ঐতিহাসিক এবং বিখ্যাত ভাষণে নিম্ন উক্তিটি করেছিলেন- তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদেরকে স্বাধীনতা দেব। ৭ মার্চের ভাষণকে যদি ঞযব The method of agreement অনুযায়ী আলোচনা করি তাহলে দেখা যাবে দুটি ভাষণই বিশ্ববিখ্যাত এবং মোটামুটিভাবে দু’টি ভাষণেই জনগণের স্বাধীনতা, মুক্তি ও গণতন্ত্রের কথা কথা বলা রয়েছে। অন্যদিকে The method of disagreement অনুযায়ী দেখা যায় যে, যদিও নেতাজী ও বঙ্গবন্ধু দুজনেই রক্ত ও স্বাধীনতার সম্পর্ক তুলে ধরেছেন তথাপি বঙ্গবন্ধু ভাষার ব্যবহার ছিল নেতাজী থেকে অনেক বেশি সুনিপুন। যেখানে নেতাজী বলেছেন- ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও.....’ সেখানে বঙ্গবন্ধু বলেছেন ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব....।’ অর্থাৎ একজনের মধ্যে পাওয়া যায় নেতা (নেতাজী সুভাষচন্দ্র), আরেকজনের মধ্যে নেতা ও যোদ্ধা (বঙ্গবন্ধু)। কারণ নেতাজী তাঁর ভাষণে যেখানে ‘তোমরা’ ও ‘আমি’ সর্বনাম ব্যবহার করে নিজেকে জনগণের নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু সেখানে ‘রক্ত আরো দিবো’ বলে নিজেকে জনগণের কাতারে একজন যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে উপসস্থাপন করেছিলেন।’
প্রবীণ সাংবাদিক ওবায়দুল হক লিখেছেন, This (Bangabandhu’s speech on March) tape-recorded speech known all the world over as the `Voice of Thunder’ played everyday from the Swadhin Bangla Betar (Radio of Free Bangladesh) inspired and guided the freedom fighters and the people throughout the war of liberation. The amplified voice of Bangabandhu made the people feel his constant presence so that although he was out of sight, he was never, not even for a split second, out of mind. It is unique in the history of a nation’s independence anywhere in the world that a mere tape relaying the resounding voice of the leader became the supreme commander of a country’s war of independence. The voice was the command and the commander personified.
দেশের প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল-আজাদ ভাষণ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দলিল, লিঙ্কনের গ্রহযুদ্ধ ভাষণের চেয়েও শ্রেষ্ঠ এবং শুধু ভাষণ হিসেবেও এমনি যে, তা নিঃসন্দেহে বিশে^র দশটি শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণের অন্যতম। এই ভাষণ শুধু যেন ভাষণ নয়-এক বীজমন্ত্র, যা কোটি মানুষকে শুধু উদ্দীপ্ত করেছে। বাংলাভাষায় এই ভাষণ প্রকাশ পেয়েছে, সেজন্য আমি গর্ববোধ করি। ‘গেটিসবার্গে লিংকনের বক্তৃতা শুধু একটি রাজনৈতিক ভাষণ নয়, এর দার্শনিকতাই তাঁকে দিয়েছে সর্বজনীনতা। তিনি মার্কিন জাতিকে, সেই সঙ্গে দুনিয়ার মানুষকে উপহার দিয়েছেন একটি দর্শন। তা হলো রাষ্ট্র বা সরকার রাজার নয়, ডিরেক্টরের নয়। তা সাধারণ মানুষের। সাধারণ মানুষই তা নিজেদের জন্য প্রতিষ্ঠা করে। একইভাবে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যেও রাজনৈতিক দিকের মতো একটি দার্শনিক দিক স্পষ্ট। তিনি বাঙালি জাতিকে তো বটেই, সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য একটি দিকদর্শন রেখে গেছেন। এই দর্শনটি হলো, সব পীড়ন থেকে মুক্তির দর্শন। অহিংস অসহযোগ আন্দোলন থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে উত্তরণের দর্শন।
আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা বিশ্লেষণ করি তবে দেখবো, অলিখিত একটি বক্তৃতা। ভাষণের সময় ১৯ মিনিট। শব্দ সংখ্যা ১৩০৮টি। আব্রাহাম লিংকনের Gettysburg Address-এর শব্দ সংখ্যা ২৭২, সময় ৩ মিনিটের কম এবং লিখিত। অপরদিকে, মার্টিন লুথার কিং ‘‘I have a dream’-’-এর শীর্ষক লিখিত ভাষণটির সময় ১৭ মিনিট, শব্দ সংখ্যা ১৬৬৭। কিন্তু বিশে^র কোনো নেতার ভাষণ এমন সংগ্রামমুখর ১০ লক্ষাধিক মুক্তিকামী নিরস্ত্র মানুষের সামনে হয়নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণটি প্রদান করে মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে, নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিলেন। অভিনেত্রী শাবানা আজমির পিতা কাইফি আজমি ৭ মার্চের ভাষণকে উল্লেখ করে যথার্থই লিখেছেন। শুধু তো একটি দেশ নয় যে তুমি জ্বালিয়ে দিবে/ প্রাচীর নয় যে তুমি পুরোপুরি মুছে ফেলবে/ কতই না নির্বোধ তুমি/খয়রাত এ পাওয়া ট্যাংক নিয়ে আমার দিকে ধেয়ে আসো/, রাজ্যের নাপাম বোমা বৃষ্টি বর্ষাচ্ছ/ ক্লান্ত হয়ে পড়বে তুমি/ শৃংখল পরাবে তুমি কোন হাতে/ হাত তো আমার আছে সাত কোটি/ গর্দান থেকে কোন মাথাটি তুমি আলাদা করবে/ সেখানে তো মাথা আছে সাত কোটি/ একটি ভাষণ ৭ কোটি মাথাকে একসাথে গ্রথিত করতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ ও পরিচালক, সেন্টার ফর সোশ্যাল সাইন্স রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন