বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে

প্রকাশের সময় : ১০ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. এম এ সবুর
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। আবহমানকাল থেকেই এ দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান। এ দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য যেমন সৌন্দর্যময় তেমনি এর অধিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাসও বৈচিত্র্যময়। হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধ মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী লোকের বসবাস এদেশে। বাঙালি, মণিপুরি, চাকমা, মারমা প্রভৃতি নৃগোষ্ঠীতে বিভক্ত এদেশের সব অধিবাসী একক পরিচয়ে বাংলাদেশী। বাঙালিয়ানা বাংলাদেশের প্রধান সংস্কৃতি হলেও এ দেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ ও প্রীতিময় করেছে সাঁওতাল-চাকমা, হাজং-ত্রিপুরাসহ অন্যান্য সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক এ সম্প্রীতির কারণে এদেশে খ্রিস্টানদের বড় দিন, বৌদ্ধদের পূর্র্ণিমা উদযাপন, হিন্দুদের পূজা পালন এবং মুসলমানদের ঈদ উদযাপনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্য এসব দিনগুলোতে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। এদেশে রোজা-পূজাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান এক সাথে উদযাপনের অনেক উদাহরণ আছে। হিন্দুদের পূজার অনুষ্ঠানে খ্রিস্টান, মুসলমান ও বৌদ্ধদের এবং মুসলমানদের ঈদ-জলসাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরও দাওয়াত দেয়ার রীতি আছে। এমনকি হিন্দু-বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-মুসলমানের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পারস্পরিক সহযোগিতার খবরও নতুন নয়। বিয়ে, মেলা, নবান্নসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সকল ধর্মাবলম্বীদের পারস্পরিক অংশগ্রহণ বহুল প্রচলিত। এমনিভাবে বাংলাদেশের সামাজিকতার বিভিন্ন পর্যায়ে হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত।
ধর্ম ও বিশ্বাসের ভিন্নতা সত্ত্বেও বাঙালি হিন্দু-মুসলিমের সংস্কৃতি অনেকাংশে সাদৃশ্যপূর্ণ। তাদের সামাজিক বন্ধনও হৃদ্যতাপূর্ণ। হিন্দু-মুসলিমের মিলিত সংস্কৃতিই বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এখানে যেমন আজানের ধ্বনিতে মানুষের ঘুম ভাঙে তেমনি সূর্যাস্তের সময় সঙ্খধ্বনিও বেজে ওঠে। এদেশের বোরকা পরিহিতা মুসলিম আর সিঁদুর পরা হিন্দু নারীরা একসাথে জমিয়ে আড্ডা দিলেও তারা ধর্মীয় বির্তকে জড়িয়ে পড়েন না। আবার ধুতি-তিলক পরা হিন্দু পুরোহিতেরা পাজামা-পাঞ্জাবি-টুপি পরা দাড়িওয়ালা মৌলবিদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করলেও তাদের মধ্যে ধর্মীয় কোন বিরোধ হয় না। তাছাড়া আসর বসিয়ে হিন্দু-মুসলিম একসাথে বাউল-কীর্তন, মুশির্দী-মারফতি গান শোনে। বাংলা সাহিত্যও সমৃদ্ধ হয়েছে হিন্দু-মুসলিমের সমন্বিত প্রচেষ্টা ও সংস্কৃতিতে। ধর্মীয় কিছু বিধি-নিষেধ ছাড়া মৌলিক কোন পার্থক্য নাই বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের খাদ্যাভ্যাসে। এমনিভাবে বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে।
বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও এদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা উপেক্ষিত নয় এবং হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি অনেক পুরনো। মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশের হিন্দু সাহিত্যিকগণ দেব-দেবীর স্তূতিমূলক সাহিত্য রচনা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, রামায়ন, মহাভারত প্রভৃতি হিন্দু ধর্মগ্রন্থাদি বাংলায় অনূদিত হয়েছে মুসলিম সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায়। মুসলিম শাসনামলে সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আবার হিন্দু-মুসলিম বার ভূইয়াগণ মিলিতভাবেই মোগল সৈন্যদের প্রতিরোধ করে বাংলাকে স্বাধীন রেখেছেন। এভাবে মুসলিম শাসনামলে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব-সম্প্রীতি স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু বৃটিশ শাসনামলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ছেদ ঘটে। এ সময় বৃটিশ শাসকরা এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে সুযোগ-সুবিধা বেশি দিয়ে এবং মুসলিমদের বঞ্চিত করে ‘ডিভাইড এ্যান্ড রুল’ অর্থাৎ ‘ভাগ কর এবং শাসন কর’ নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি নস্যাৎ করে। কিন্তু অনেক দিন পরে হলেও বৃটিশদের এ অপনীতি বুঝতে পেরে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছে। তবে বৃটিশরা বিভিন্ন সময়ে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছে।
তাদেরই কূটরাজনীতির কারণে ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধে। যার পরিণতিতে বাংলা বিভাগের প্রবল দাবি উঠে এবং ১৯৪৭ সালে বাংলা বিভক্ত হয়ে পড়ে। তবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুদৃঢ় হয়েছে। কিন্তু অনেক সময় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি-গোষ্ঠী ভিন্ন ধর্মের বিশ্বাস ও লোকদের উপর আক্রমণ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন সময় অতর্কিতভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে। নিকট অতীতে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপর আক্রমণ এবং সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এজন্য ধর্মাবমাননাকারী, উসকানীদাতা ও হামলার সাথে জড়িত সবাইকে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষত ক্ষতিগ্রস্তদের সঠিক তথ্য দিতে হবে। অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্তরা প্রভাবশালী অপরাধীদের ভয়ে সঠিক তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ ছাড়া অনেক ঘটনায় রাজনৈতিক কারণে ‘উদোর পি-ি বুদোর ঘাড়ে চাপানো’র চেষ্টা চলে। যাতে প্রকৃত অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে। যে কারণে এ ধরনের ঘটনা বার বার ঘটে। সর্বোপরি প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করার এবং শাস্তি দেয়ার বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে সুশীল সমাজ, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সমাজপতি সবাইকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।
য় লেখক : আহ্বায়ক, ডক্টরস এসোসিয়েশন অব নন-গভর্নমেন্ট টিচার্স (ড্যাঙ্গট)
ফসধংড়নঁৎ০৯@মসধরষ.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন