মীর আব্দুল আলীম
ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয় নারী। ২৭ অক্টোবর রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো স্থানে গণধর্ষণের অঘটন তাতে নতুন ও নিকৃষ্ট মাত্রা যুক্ত করেছে। সে রাতে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ এক তরুণী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আনসার বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধর্ষিত হয়। হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা ছিলেন তারাই কিনা এক অসহায় তরুণীর উপর নির্যাতন চালালো। আমাদের নারীরা আর কবে নিরাপদ হবে? ধর্ষণ! ধর্ষণের পর খুন! এ জাতীয় অপরাধ কি বন্ধ হবে না? এ জাতীয় ঘটনাপ্রবাহ সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশের পর কেবল আমাদের উদ্বিঘœই করে না আমাদের বিস্ময়ের বাঁধও ভেঙে দিচ্ছে। এ অবস্থায় সবার আগে নারীর নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইন রয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর বাস্তবায়ন নেই। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই অপরাধীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজটিই এখন বেশি জরুরি।
খুব বেশি আগের কথা নয়। মাস কয়েক আগে খোদ রাজধানীতে তুলে নিয়ে মাইক্রোবাসে গারো মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে খালার বাড়িতে বেড়াতে এসে খালুর দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে এক তরুণী। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার হন এক পোশাককর্মী। তাদের ঘৃণিত এই কাজ অপরাধ বিজ্ঞানের কোন সংজ্ঞায় ফেলাতে পারি আমরা? দেশে নিত্যই এসব ঘটনা ঘটছে তো ঘটছেই। কোথাও যেন আজ নারীরা নিরাপদ নয়। এ ক্ষেত্রে থাকছে না বয়স, স্থান, কাল, পাত্রের ভেদও। পারিবারিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাব এবং ভিনদেশি অপসংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের সমাজকে কতটা ক্ষতবিক্ষত করছে তা হালআমলের এসব নারী নির্যাতনের চিত্র দেখলেই বেশ টের পাওয়া যায়। আসলে দ্রুততম সময়ে অপরাধীর সাজা না হলে এ জাতীয় অপরাধ বাড়বে, এটি চির অবধারিত।
এ অপরাধ শুধু নারীর বিরুদ্ধে নয়, মানবতার বিরুদ্ধেও এটি চরম অপরাধ। বিশ্বের যেসব দেশে ধর্ষণ বাড়ছে, দেখা যাচ্ছে ধর্ষণকারীর সাজা না হওয়া তার অন্যতম কারণ। এশিয়ার মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশে এ ধরনের অপরাধ বেশি হয়ে থাকে। আর এর শিকার হচ্ছে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তরাই বেশি। যারা উচ্চবিত্ত, সমাজের ওপরতলার মানুষ, এই জাতীয় বিপদ তাদের ছুঁতে পারে কম। তাছাড়া এমন অনেকেই আছেন, যারা অপরাধের শিকার হয়েও ভয়ে চুপ থাকেন। ইজ্জত হারিয়েও মুখ খোলেন না। তারা জানেন আইন-আদালত করলে তাদের ভাগ্যে উল্টো বিপত্তি ঘটতে পারে। অন্যায় করে অপরাধীরা এভাবেও অনেকে পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা নতুন করে অপরাধ করার ব্যাপারে উৎসাহী হচ্ছে। বর্তমানে আমরা ঈমানি শক্তি হারিয়েছি। দেশপ্রেম, সততা, নৈতিক মূল্যবোধ, যৌন কামনা ইত্যাদি নেতিবাচক প্রবণতা আমাদের অন্ধ করে ফেলেছে। তাই সমাজ থেকে সুখ, শান্তি বা আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে। নিঃশর্ত ভালোবাসা বা ভক্তি কমে যাওয়ার কারণে আমাদের গঠনমূলক মনোভাব বা সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধার পরিবর্তে আমাদের ভোগের মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশ ও ভারতের মতো সমাজব্যবস্থায় নারীদের অধিকাংশই এখনো তাদের ওপর নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো ঘটনার কথা প্রকাশ করতে চান না। আর ঘটনা জানাজানি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তারা পুলিশের কাছে থানায় কিংবা আদালতে মামলা করেন না। তাই সরকারের খাতায় প্রতিবছর যতগুলো ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত হচ্ছে প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু এসব অপরাধ বৃদ্ধি হওয়ার জন্য সরকার ও তার প্রশাসনের ব্যর্থতাও কম দায়ী নয়, কারণ প্রভাবশালী অন্যায়কারীরা অন্যায় করার পরও প্রশাসন নীরব থাকে, সরকারেরও যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। আর যারা এর শিকার হন তাদের অধিকাংশই দরিদ্রসীমার নিচে বাস করেন ফলে তাদের পক্ষে খুব বেশিদূর যাওয়া সম্ভব হয় না।
তবে এটা সত্য যে, মেয়েদের প্রতি পদেই বিপদের মোকাবেলা করতে হয় আজকের সমাজে, শ্রেণিবিভাগ ব্যতিরেকেই। উচ্চবর্গীয়রা নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বাস করেন বলে ঘরের মধ্যে তাদের বিপদ কিছু কম হতে পারে তবে পার্টিতে অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিতের হাতে, আর ঘরে নিকট আত্মীয় বা পরিচিতজনদের হাতে লাঞ্ছনা জোটার সম্ভাবনাটাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। আসল সমস্যাটা হলো কুরুচিপূর্ণ পূরুষদের দৃষ্টিভঙ্গিতে, সেটা কোনো শ্রেণিভাগ মানে বলে মনে হয় না। এমনকি শিক্ষাগত যোগ্যতাও এই মানসিকতা বদলাতে পারে না। তা নাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্থানে শিক্ষকের হাতে ছাত্রী, ডাক্তারের হাতে রোগী কিংবা নারী ডাক্তার ধর্ষিত হয় কী করে?
ব্যভিচার সর্বযুগে, সর্বধর্ম মতে নিন্দনীয় নিকৃষ্ট পাপাচার। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে এসব অপরাধ করেও অপরাধীরা রেহাই পেয়ে যায়। দেখা যায় হয় চূড়ান্ত রিপোর্টে ঘাপলা নয়তো সাক্ষ্য প্রমাণকে প্রভাবিত করে অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছেন ঠিকই। উপরন্তু এর বিচার চাইতে গিয়ে বিচারপ্রার্থীরাই অনেক ক্ষেত্রে পাল্টা হুমকির মুখে পড়ছেন। এ অবস্থা থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।
১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিশেষ বিধান আইন করা হয়। পর্যায়ক্রমে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়। ২০০৩ সালে এ আইন আবার সংশোধন করা হয়। ধর্ষণের শাস্তি কত ভয়ানক, তা অনেকেই জানেন না। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের বিচার হয়। এ আইনে ধর্ষণের সর্বনিম্ন শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদ- এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- করা হয়েছে। আইনের ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে সে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হবে। এছাড়া অর্থদ-েও দ-িত হবে। ৯(২) উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদ-ে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হবে। অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদ-েও দ-িত হবে। উপধারা ৯(৩)-এ বলা হয়েছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদ-ে দ-িত হবে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করে, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হবে ও এর অতিরিক্ত অর্থদ-েও দ-িত হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ওই ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হবে। এছাড়া অতিরিক্ত অর্থদ-ে ও দ-িত হবে। অর্থাৎ আইন আছে ঠিকই কিন্তু আইনকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আইনের যারা প্রয়োগ করবেন তাদের অনেকেই ওই আইনের পথে হাঁটেন না।
নারী দেখলেই কেন ধর্ষণ করতে হবে? সব দোষ নারীর? সব দোষ পোশাকের? এমন মানসিকতা কেন আমাদের। ধর্মে নারীকে পর্দা করতে বললেও পুরুষদেরও চোখ অবনত রাখতে বলা হয়েছে। তবে শুধু নারীর দোষ কেন? নারীর রূপ-যৌবন পুরুষকে মোহিত করবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই বলে তার ওপর পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে কেন? ধর্ষণ কমাতে হলে আগে পুরুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলি জাগ্রত করতে হবে। অবাধ মেলামেশার সুযোগ, লোভ-লালসা-নেশা, উচ্চাভিলাষ, পর্নো সংস্কৃতির নামে অশ্লীল নাচ-গান, যৌন সুড়সুড়িমূলক বই-ম্যাগাজিন, অশ্লীল নাটক-সিনেমা ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়ানো কামোত্তেজনা মানুষকে প্রবলভাবে ব্যভিচারে প্ররোচিত করে। তাই এসব বর্জন করতে হবে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সময়মতো বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। পারিবারিক ও ধর্মীয় শিক্ষার গ্রহণ করতে হবে। বাজে সঙ্গ ও নেশা বর্জন করতে হবে। পাশাপাশি নারীকেও শালীন হতে হবে। যৌন উত্তেজক পোশাক বর্জন করতে হবে। কেননা প্রবল কামোত্তেজনা মানুষকে পশুতুল্য করে ফেলে। ব্যাপকভাবে কামোত্তেজনা সৃষ্টিকারী উপকরণগুলোর কাছাকাছি চলে গেলে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের আর কোনো উপায়ই থাকে না। ধর্ষণের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে কেবল আইনের কঠোর প্রয়োগেও কোনো কাজ হবে না। এর জন্য প্রয়োজন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যার যার পারিবারিক বলয়ে ধর্মানুশীলনে একনিষ্ঠতা, পোশাকের শালীনতা, অশ্লীল সংস্কৃতিচর্চার পরিবর্তে শিক্ষণীয় বিনোদনমূলক ও শালীন সংস্কৃতি চর্চার প্রচলন নিশ্চিতকরণ। আর এটা করতে হলে কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতা, আইনের শাসন প্রয়োগ বা ফতোয়া দিলেই চলবে না, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যার যার অবস্থানে থেকে স্কুল-কলেজ, মাদরাসা -মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সমাজের অন্য বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয় নারী। তাই সবার আগে নারীর নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সে লক্ষ্যে আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা চাই। মনে রাখতে হবে, ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি শহরেই বহু কর্মজীবী নারীকে সন্ধ্যার পর কর্মস্থল থেকে একাকী ঘরে ফিরতে হয়। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা দরকার প্রশাসনকে তা সুনিশ্চিত করবে। ধর্ষকদের ধরতে হবে প্রথমে, এরপর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষিতাদের সার্বিক সহায়তা দেয়াটাও সরকারের কর্তব্য। সর্বোপরি এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যাতে নারীরা ঘরে এবং বাইরে নিজেদের নিরাপদ ভাবেন। কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। আমাদেরকে সম্মিলিত উদ্যোগে সেটাকে সম্ভব করতে হবে।
য় লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
হবংিংঃড়ৎব১৩@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন