দেশে চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ও নিখোঁজের তালিকা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। একদিকে হত্যাকাণ্ডের পর খুনিরা ধরা পড়ছে না, অন্যদিকে নিখোঁজের ঘটনায় বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করেও পরিবার নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান পাচ্ছেন না। সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. অধ্যাপক আফতাব উদ্দিন আহমেদ হত্যাকাণ্ডসহ শত শত খুনের রহস্য উদ্ঘাটন কিংবা হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা এখনো অধরাই রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে কোনো অপরাধ ঘটনার যথাযথ বিচার না হলে পরবর্তীতে একই ধরনের ঘটনা বেড়ে যায়।
জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন ইনকিলাবকে বলেন, অনেক হত্যা মামলার তদন্ত বছরের পর বছর শেষ হয় না, এটা বিচারহীনতার বিষয় বলে আমি মনে করি। হত্যা মামলার তদন্ত বিলম্বিত হলে এ ধরনের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া ইউং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ইনকিলাবকে বলেন, র্যাবের কাছে যে সব নিখোঁজ ও হত্যা মামলার তদন্ত রয়েছে তা গুরুত্ব দিয়েই তদন্ত করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলার আলামত নষ্ট হওয়ায় বা সাক্ষীর অভাবে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে বিলম্ব হয়।
বিএনপির সাবেক এমপি ও সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী গুমের ১০ বছর হলেও তার গুম হওয়ার রহস্য এখনো উদ্ঘাটন হয়নি! তবে এখনো এম ইলিয়াস আলী ফেরার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছেন তার বৃদ্ধা মা সূর্যবান বিবি, স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর লুনা, তার ছেলেমেয়েরা ও গোটা সিলেটবাসী। তার সাথে গুম হওয়া ইলিয়াস আলীর গাড়ী চালক আনসার আলীর পরিবারও আজো প্রতীক্ষায় আছে। এ ধরনের বহু নিখোঁজ সাধারণ মানুষের রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি আজও। অথচ একটি প্রভাবশালী চক্রের মদদে বা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কিছু সাধারণ মানুষকে হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই সাথে সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের নানাভাবে হেয় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অপরাধ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পুলিশের অদক্ষতা ও অজ্ঞাত কারণে চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রহস্য অনুদ্ঘাটিত রয়ে যাচ্ছে। আসামিরাও চিহ্নিত হচ্ছে না। ফলে বিচার পাচ্ছে না নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। তবে ঘাতকরা এমন কিছু আলামত রেখে যায় তাতে খুনিদের শনাক্ত করা খুব সহজ। অবশ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে এমন দক্ষতা পুলিশের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। পুলিশের দক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা দিন দিন কমবে।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন ইনকিলাবকে বলেন, নিখোঁজ ব্যক্তিকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তবে ওই ব্যক্তি যদি কোনো অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত থাকে তাহলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক বছরের পর বছর নিখোঁজ থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিখোঁজ ব্যক্তির কোনো সন্ধান পাবে না এটি হতে পারে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আদালতের রায় রয়েছে, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতের রায় না হওয়া পর্যন্ত ওই অপরাধীকে কনডেম সেলে রাখা যাবে না। এর প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ না হওয়ার আগে ওই ব্যক্তির নামে আগে কোনো বিশেষণ যোগ করা যাবে না। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি আমাদের দেশে এটি মানা হয় না।
রাজধানীর মতিঝিলে কথা হয় ব্যবসায়ী জহির আহমেদের সাথে। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, গত মঙ্গলবার চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতলকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ গ্রেফতারের পর একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর নামের আগে যেভাবে বিশেষণ ব্যবহার করে মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছে তা কাম্য নয়। কোনো ব্যক্তি অপরাধি প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তির নামের আগে বিশেষায়ণ ব্যবহার করার বিষয়টি এক ধরনের মানহানিকর বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড কিংবা বহুল আলোচিত নিখোঁজের মামলার ফাইল হওয়া থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ধাপে এটি দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়ে। এছাড়া তদন্তের সময় নেয়া, অসংখ্যবার তারিখ নেয়া এবং আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়াও মামলা ঝুলে যাওয়ার বড় কারণ। আইন অনুযায়ী, বিচার বা মামলার তদন্তের একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া থাকলেও খুব কম ক্ষেত্রে সেটি মান্য করা হয়। সাক্ষীর আদালতে হাজির না হওয়ার ঘটনাই বেশি। ভয়ভীতি ও হুমকির কারণে সাক্ষীরা অনেক সময় আদালতে আসেন না। দেশে সাক্ষী সুরক্ষা আইন নেই। সাক্ষীদের আদালতে আনা-নেয়ার আলাদা কোনো ব্যবস্থাও নেই। তাছাড়া নিখোঁজের ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক কারণে আগ্রহের অভাব দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ্যকরা যাচ্ছে।
সূত্র মতে, চাঞ্চল্যকর অনেক মামলারই তদন্ত প্রত্যাশিত সময়ে শেষ করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এমনকি আসামি শনাক্ত, গ্রেফতার ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পাওয়ার পরও বিচারের জন্য আদালতে অনেক মামলার চার্জশিট জমা দিতে দেরি করছে তদন্তকারী সংস্থা। আর এসব কারণে শুরু হচ্ছে না স্পর্শকাতর বহু মামলার বিচার। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী, ইসলামিক অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ফারুকী, গোপীবাগের লুৎফুর রহমান ফারুকসহ ৬ জন, ধানমন্ডির চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান লিপি, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ড অন্যতম। এছাড়াও অ্যাডভোকেট, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক খুনের ঘটনাগুলো দীর্ঘ সময়েও রহস্য উদ্ঘাটিত না হওয়ায় তদন্ত কার্যক্রম ডিপফ্রিজে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কোনো কোনো খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) পরিবর্তন করা হয়েছে এক ডজনেরও বেশি বার। এসব চাঞ্চল্যকর খুনের মামলা তদন্ত করছে পুলিশ, র্যাব, সিআইডি, ডিবি ও থানা পুলিশ। অথচ হত্যা রহস্য উদ্ঘাটিত হচ্ছে না দীর্ঘদিনেও। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে নিখোঁজ হন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী। গত ১০ বছরেও তার হদিস মেলাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তিনি কি আদৌ বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন; সে সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। ঘটনার পর, ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদী ও তার সন্তানরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথেও দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রীও তাদেরকে আশ্বস্ত করেছিলেন। ওই আশ্বাস পর্যন্তই শেষ। কিছুই হয়নি, উদ্ধার বা কোনো সন্ধান মেলেনি ইলিয়াস আলীর। শুরু থেকেই এ ঘটনার ব্যাপারে ইলিয়াস আলীর পরিবার এবং দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে। তাদের অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনই ইলিয়াস আলীকে তুলে নিয়ে গেছে।
এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আফতাব উদ্দিন আহমেদ হত্যাকাণ্ডের রহস্যের জট খোলেনি ১৫ বছরেও। তাকে কারা খুন করেছে, এত বছরেও পুলিশ তাদের শনাক্ত করতে পারেনি। ২০০৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে আটটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের বাসায় দুর্বৃত্তরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আফতাব উদ্দিনকে গুলি করে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। এ ঘটনায় আফতাবের স্ত্রী নুরজাহান শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। ২০১৫ সালে নুরজাহান মারা যান। আফতাব-নুরজাহান দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। বাদীর মৃত্যুর পর আফতাবের স্বজন, সহকর্মী বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের কেউ এ মামলা নিয়ে সোচ্চার হননি।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া ইউং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, কারো নামের আগে বিশেষণ লাগানো র্যাবের উদ্দেশ্য নয়। র্যাব শতভাগ আইন মেনে তদন্ত কাজ করে আসছে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা এবং জনসাধারণের নিরাপত্তা বিধান করাই র্যাবের উদ্দেশ্য বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন