বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পাঠ, পাঠাভ্যাস ও পাঠক

সাজ্জাদুল করিম | প্রকাশের সময় : ১৪ মে, ২০২২, ১২:৩৫ এএম

পাঠ, পড়া বা অধ্যয়ন এমন একটি কাজ, যা এই মহাবিশ্বের একমাত্র সৃষ্টি হিসেবে মানুষ নামক প্রাণীটিকেই করতে হয়। অর্থাৎ এই বিশ্ব জগতের অন্য কোন সৃষ্টির বেলায় এই শব্দটির কোন অস্তিত্ব নেই। এর কারণ আমরা সবাই জানি, এই বিশ্ব-চরাচরে মানুষই একমাত্র সৃষ্টি, যার রয়েছে চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতা, শেখার-জানার আকাক্সক্ষা। আর এই কাজটির গুরুত্ব এতটাই বেশি যে, স্বয়ং স্রষ্টা মানুষকে সৃষ্টির পর তাকে প্রয়োজনীয় সকল কিছু শিখিয়েছেন এবং এ কারণেই তাকে শ্রেষ্ঠত্বও দেয়া হয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সর্বপ্রথম বাণীতেও পড়ার নির্দেশনাই দেয়া হয়েছে, যা থেকে আমরা সহজেই পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝতে পারি।

পড়া এমন একটি প্রক্রিয়ার নাম, যার মাধ্যমে মানুষ তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও ইন্দ্রিয়কে ব্যবহার করে কিছু সাংকেতিক চিহ্ন, ছবি, চিত্র, প্রতীক, লিপি ইত্যাদির সাহায্যে কোন ধারণা, বার্তা, তথ্য বা জ্ঞান লাভ করে। আর এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয় প্রথমে দেখা, শুনা বা স্পর্শের মাধ্যমে তারপর কখনো কখনো বাগযন্ত্রের মাধ্যমে তা আওড়ানো এবং সর্বশেষ তা অনুধাবন, আত্মস্থ বা হৃদয়ঙ্গম করা। অর্থাৎ পাঠের মাধ্যমে আমরা কোন কিছু সম্পর্কে ধারণা বা জ্ঞান লাভ করি। আর এটিই পাঠের মূল উদ্দেশ্য। বুঝ, অনুধাবন, জ্ঞানলাভ ব্যতীত পাঠ শব্দটির অস্তিত্ব নেই।

আমরা যদি নৃতাত্ত্বিকদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তাহলে দেখবো, সভ্যতার সূচনালগ্নে মানুষ যখন পাহাড়ের গুহায় বসবাস করতো তখন থেকেই তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে বিভিন্ন ছবি, চিত্র, সংকেত, চিহ্ন বা প্রতীকের মাধ্যমে তাদের মনের ভাব বিনিময় করতো এবং তা বিভিন্ন মাধ্যমে সংরক্ষণের প্রয়াস চালাতো। যেমন আমরা জানি, আদিম মানুষ পাহাড়ের গায়ে, মাটিতে, পাথরে, গাছের ছাল-বাকলে, পশুর চামড়ায় বিভিন্ন উপায়ে এসকল চিহ্ন এঁকে রাখতো, যা ধীরে ধীরে লিপি আকারে রূপান্তরিত হয়েছে। আর এভাবেই তারা তাদের ভাব, চিন্তা, কল্পনা ইত্যাদির বিনিময় করতো। সুতরাং এথেকে আমরা বুঝতে পারি, সভ্যতার ঊষালগ্নেই মানুষ পড়ার সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। আবার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে সেখানেও দেখবো যে, আদি মানব আদমকে সৃষ্টির পর তাঁকে তাঁর প্রয়োজনীয় সকল কিছু শিক্ষা দেয়া হয়েছে বলে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, সৃষ্টির সময় থেকেই মানুষকে পড়া, শেখা বা জ্ঞান আহরণের উপযোগী সকল যোগ্যতা দেয়া হয়েছিল।

সভ্যতার সূচনালগ্নেই মানুষের মধ্যে এই যে পড়ার বা জানার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল, তার পদ্ধতি, ধরন, মাধ্যম বা উপকরণ কিন্তু সবসময় একই রকম ছিল না। সময়ের পরিক্রমায় তা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন গুহাবাসী আদিম মানুষ পাহাড়ের গায়ে, পাথরে, মাটিতে বিভিন্ন চিত্র, ছবি, প্রতীক, চিহ্ন ইত্যাদি অংকন করে রাখতো এবং সেগুলোই তারা পাঠ করতো। পরবর্তীতে পোড়া মাটির ফলক, গাছের পাতা, ছাল-বাকল, পশুর চামড়া, কাঠ ইত্যাদি মানুষের পাঠোপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, প্রচীন লাইব্রেরিগুলোতে এখনকার মতো কাগজে মুদ্রিত বই সংরক্ষিত থাকতো না, বরং ক্লে-ট্যাবলেট, প্যাপিরাস, পার্চমেন্ট, ভেলাম ইত্যাদি ছিল তখনকার পাঠোপকরণ। এরপর কাগজ আবিষ্কৃত হওয়ার পর তাই হলো প্রধানতম পাঠোপকরণ, যা এখন পর্যন্ত সহজলভ্য মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে বিভিন্ন আধুনিক মাধ্যম (ই-বুক, পিডিএফ, ব্লগ, ছবি, ভিডিও, বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম ইত্যাদি) আমাদের পাঠের অভ্যাস, ধরন ও মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করেছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আসলে পাঠ বা পড়ার সংজ্ঞা অনেক বিস্তৃত। শুধু কাগজের পটে অংকিত লিপি আওড়ানোর নামই পাঠ নয়। ছবি, অডিও বা ভিডিও দেখে বা শুনেও যদি কোন ধারণা বা জ্ঞান লাভ হয় সেটিও এক অর্থে পড়া। একারণেই আমরা দেখতে পাই, বিশ্বের আধুনিক লাইব্রেরিগুলোতে কাগজে মুদ্রিত বইয়ের পাশাপাশি ই-বুক, অনলাইন জার্নাল/ম্যাগাজিন/সংবাদপত্র, অঁফরড়-ারংঁধষ উপকরণ ইত্যাদিও সংরক্ষণ করা হয়। তাছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চারপাশে যা কিছু ঘটে তা থেকেও কিন্তু আমারা সচেতন বা অবচেতনভাবে প্রতিনিয়ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করি যেটাও মূলত পড়ারই অংশ। এজন্যই বিখ্যাত মনীষী গোলভেনি বলেছেন, ‘পৃথিবী হচ্ছে একটি চমৎকার গ্রন্থ, কিন্তু যে পাঠ করতে জানে না তার কাছে এর কোনো মূল্য নেই।’

কাগজে মুদ্রিত বইয়ে সাধারণত আমরা কী পড়ি? আমরা সাধারণত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত, লেখকের চিন্তা, দর্শন, উপলব্ধি, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ইত্যাদির সাথে পরিচিত হই। ঠিক এই বিষয়গুলোই যদি আমি কাগজে মুদ্রিত বই ব্যতীত অন্য কোনো মাধ্যম বা উপকরণ থেকে জানি তাহলে সেটিকে কী আমরা পড়া বলবো না? যেমন আজকাল আমরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ভধপবনড়ড়শ, ঃরিঃঃবৎ, ষরহশফরহ, নষড়ম ইত্যাদি ব্যবহার করে আমাদের চিন্তা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতার বিনিময় করি। তাহলে শুধুমাত্র মাধ্যম বা উপকরণের ভিন্নতার কারণে কোন যুক্তিতে আমারা একে পড়া নয় বলে অস্বীকার করবো?
আমরা জানি, ফেব্রুয়ারি মাস এলেই প্রতিবছর বাংলা একাডেমি কর্তৃক অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় দেশের স্বনামধন্য পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো অংশগ্রহণ করে। মেলাকে ঘিরে প্রতিবছর কয়েক হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয় এবং তা পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়। একটু সচেতনভাবে যদি চিন্তা করি তাহলে দেখবো, প্রতি বছরই বই মেলার পরিসর বৃদ্ধি পাচ্ছে, নতুন নতুন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নিচ্ছে এবং কয়েক কোটি টাকার বই বিক্রি হচ্ছে শুধুমাত্র বই মেলাকে কেন্দ্র করেই। বাংলা একাডেমির হিসেব অনুযায়ী ২০২২ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রায় সাড়ে ৫২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে, যা বিগত বছরের তুলনায় প্রায় ১৭ গুণ বেশি। অন্যদিকে এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে অনলাইনে বই বিক্রির সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান রকমারি ডট কম বছরে ১০ লক্ষাধিক বই বিক্রি করে। তাছাড়া সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পাবলিক লাইব্রেরি, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিগুলোও পাঠাভ্যাসে আগ্রহ সৃষ্টি ও পাঠকদের জন্য নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে শুধুমাত্র সরকারি পাবলিক লাইব্রেরিগুলো মোট ৩৪,৯১,৮৯৩ জন পাঠককে সেবা দিয়েছে। দেশব্যাপী পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কার্যক্রমে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি প্রকল্প একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ, যেটি বর্তমানে সরকারের সাথে যৌথভাবে কাজ করছে। এই প্রকল্পটি দেশের ৬৪টি জেলার মোট ৩০০টি উপজেলার ৩২০০টি লোকালয়ে সেবা প্রদান করছে এবং বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৩ লক্ষ ৩০ হাজার। এছাড়াও একাডেমিক কারণ, চাকরি প্রস্তুতি গ্রহণ বা জীবন-জীবিকার প্রয়োজনেও মানুষ পড়ালেখা করে এবং কোনো পরিসংখ্যান ছাড়াই নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই শ্রেণির পাঠকসংখ্যাও কিন্তু ক্রমবর্ধমান। যাদেরকে পাঠক হিসেবে গণ্য না করার কোনো কারণই নেই। এখন প্রশ্ন, এই যে প্রতিবছর এত বই বিক্রি হচ্ছে, বই কেন্দ্রিক নতুন নতুন প্রকাশনা ও বিপণন কেন্দ্র গড়ে উঠছে বা সারাদেশে লাইব্রেরি পরিসেবা বিস্তৃত হচ্ছে, পাঠাভ্যাস ও পাঠক সংখ্যা যদি সত্যিই কমে যেত তাহলে এই চিত্রগুলো কী আমরা দেখতাম?
উপসংহারে আমরা একথাই বলতে চাই, পাঠের যে সংকীর্ণ ধারণা আমরা পোষণ করি তার চেয়েও এর সংজ্ঞা ও পরিধি অনেক বিস্তৃত। আর এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতে হবে, সত্যিকারার্থে পাঠক কমছে না বরং পাঠের উদ্দেশ্য, অভ্যাস, ধরন, মাধ্যম, উপকরণ ইত্যাদির পরিবর্তন হচ্ছে মাত্র।

লেখক: জেলা লাইব্রেরিয়ান, শেরপুর
sazzad.karim70@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন