দুই বছর ধরে করোনার সঙ্গে যুদ্ধ চলছে। প্রতিষেধক বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই এ যুদ্ধে জেতার একমাত্র অস্ত্র। দেশে দেশে সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণ, ফলে অর্থনৈতিক মন্দা। উৎপাদন হ্রাস, হঠাৎ চাহিদা বৃদ্ধি ও সরবরাহব্যবস্থায় সংকটের জেরে বিশ্বব্যাপী রেকর্ড মূল্যস্ফীতি। তাই বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যে আগুন। অধিক ব্যয় মেটাতে মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত। আবার ওই আগুনেই যেন ঘি ঢালার কাজ করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ইউরোপের রুটির ঝুড়িখ্যাত ইউক্রেন ও বিশ্বের অন্যতম তেল, গ্যাস, গম, ভুট্টা রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়ার পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় বিশ্বে দেখা দিচ্ছে খাদ্যের সংকট। পুতিন, জেলেনেস্কি ও বাইডেনের মতো গুটিকয়েক বিশ্বনেতার উচ্চাভিলাষী আকাক্সক্ষাই বিশ্বকে নিয়ে যাচ্ছে নরকের দ্বারপ্রান্তে। এর পরিণতি অনুমেয়। যুদ্ধে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে, এটাই বাস্তবতা। এর আঁচ বিশ্বের কোনো দেশই এড়াতে পারবে না। যুদ্ধের পরিণামই ক্ষতি, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর বিশ্বের অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করতেই ব্যস্ত। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি যে কমে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সব দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। যুদ্ধের প্রভাবে পরনির্ভর প্রবাসী আয় কমে যাবে। ইউরোপের মন্দায় পোশাক রপ্তানি কমে রপ্তানিবাণিজ্যে দেখা দেবে স্থবিরতা। ফলে বিপদ আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তাই আমাদের মতো সদ্য উন্নয়নশীল, বৈষম্যপূর্ণ দেশের জনগণের জীবনে হাপিত্যেশের মাত্রা চরমে। ব্যয় মিটাতে শুধু সঞ্চয়ই ভাঙছে না, ঋণের বোঝা ভারী হচ্ছে প্রতিনিয়ত। লোকলজ্জার ভয় কিংবা সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হচ্ছে মধ্যবিত্তরা। ফলে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে টিসিবির ট্রাকে পিছনের সারিতে দাঁড়ানো অসহায় মানুষের মুখোচ্ছবি। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করছে দেশের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী। ফলে সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে। এই মহামারির মধ্যে আশঙ্কাজনক পর্যায় পৌঁছেছে আত্মহত্যার হার। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে এই বৃদ্ধির হার লক্ষণীয়। ধারণা করা হয়, মন্দা অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানহীনতা, ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তা, করোনাকালীন একাকীত্ব, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও সর্বোপরি সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবের কারণেই বেড়ে চলছে এই প্রবণতা। অথচ, এই নতুন প্রজন্মের হাত ধরেই দেশ এগিয়ে যাওয়ার কথা। অর্থাৎ দেশ যখন উন্নত বিশ্বের স্বপ্নে বিভোর, ঠিক তখন কিছু তরুণ তাদের জীবনের মায়া ত্যাগ করছে। আজ আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করেছি। ভেবে দেখার বিষয় হলো, বহু আগ থেকেই অর্থাৎ আদিযুগ থেকেই আমাদের এ ভূখণ্ডে মনুষের বসবাস। বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর আদি আটটি সভ্যতার একটি এবং বাংলার প্রাচুর্য, ঐতিহ্য এ উপমহাদেশের ইতিহাসকে করছে সমৃদ্ধ। ঐতিহাসিকদের মতে, ভারতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রদেশ ছিল বাংলা। বিশেষ করে সুলতানি আমলে বাংলা কৃষি ও শিল্পে অনেক সমৃদ্ধ ছিল। ১৭১৭ সালে মুর্শিদ কুলি খান এবং সুজা খান দিল্লির সম্রাটকে বছরে এক কোটি টাকা খাজনা দিতেন। ভাবা যায়, সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি কী বিপুল পরিমাণ অর্থ! শুধু তাই নয়, মধ্যযুগে ভারতবর্ষের সমৃদ্ধির খবর বিশ্বব্যাপী এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, ইতালিয় নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস স্পেনের রাজা-রানির সহায়তায় ১৪৯২ সালে ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে গিয়ে আমেরিকা আবিষ্কার করেন। এর ৬ বছর পর পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৮ সালে ভারতবর্ষ আবিষ্কার করেন। পর্তুগিজদের পথ অনুসরণ করেই ওলন্দাজ, ফরাসি ও ব্রিটিশরা ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে আসে। মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে লুটপাটই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। অবশেষে ব্রিটিশরা ১৭৫৭ সালে ২৩ জুন বাংলা দখল করে। দখলের কিছুদিন পরই মাত্রাতিরিক্ত লুটপাট ও ভুল অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের ফলে ১৭৬৯ সালে বাংলায় দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, যা ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে এবং এই ব্যাপক দুর্ভিক্ষ পুরো বাঙালি জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। মারা যায় এক কোটি মানুষ, যা ওই সময়কার মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। ফলে বাঙালির মনোবল ভেঙে যায়। মন থেকে ইতিহাস ও পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়ে যায়। এ সময় পুরো একটি প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যায়। নতুন একটি প্রজন্ম গড়ে ওঠে ব্রিটিশ উপনিবেশের মধ্য দিয়ে, যারা ছিল শিক্ষা-দীক্ষায় বঞ্চিত, পূর্বপুরুষ সম্পর্কে অজ্ঞ। তাদের মধ্যে ছিল ঐতিহ্যগত জ্ঞানের অভাব, আত্মবিশ্বাসের অভাব। ছিল নেতৃত্বের অভাব, যা বরাবরই বাংলাসহ দক্ষিণ এশিয়ার বড় সমস্যা। এ জন্য ভূখণ্ডে চলে ব্রিটিশদের প্রায় ২০০ বছরের শোষণ। অবশেষে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে ব্রিটেনের স্বপক্ষ শক্তি জয়ী হলেও অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। এই সুযোগে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার হয়। ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দুটি আলাদা রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তানের জন্ম হয়। পাকিস্তান আন্দোলনে পূর্ব বাংলার মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। নেতৃত্বে ছিলেন শের-ই বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাথে সে সময়কার সাহসী তরুণ, উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু মাতৃভাষা বাংলার দাবিতেই শেখ মুজিবের বুঝতে বাকি রইল না- এই নব্য সাম্রাজ্যবাদী দেশের সঙ্গে বেশিদিন থাকা যাবে না। মনে মনে স্বপ্নবীজ বুনতে থাকলেন এক স্বাধীন দেশের। এ দেশের মানুষও পেয়ে গেলেন এক যোগ্য নেতা, যার ওপর ভরসা করা যায়। এই ভরসার মূল্যায়ন করেই মুজিব মাত্র ২৪ বছরে উপহার দেন নতুন এক দেশ, নাম বাংলাদেশ। বিশ্বের মানচিত্রে অঙ্কন করেছেন নতুন এক স্বাধীন ভূখণ্ড। দরিদ্র-নিপীড়িত মানুষের আর্থসামাজিক মুক্তিই ছিল যার মূল লক্ষ্য। কিন্তু ওই যে কথায় বলে, ‘বাঙালির নেতাভাগ্য ভালো নয়।’ দুর্ভাগা বাঙালি, খুব স্বল্পসময়েই ১৯৭৫ সালে দেশ স্বাধীনের মাত্র চার বছরের মাথায় হারায় তার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তানকে, যিনি শূন্য হাতে স্বপ্ন দেখেছেন উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলার।
প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা ও দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশও যে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, হতে পারে অনুকরণীয় উন্নয়নের রোল মডেল, তা শেখ হাসিনা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে অগ্রাহ্য করে গরিব কৃষকদের সারে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছেন। নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করেছেন। বড় বড় প্রকল্পগুলো আজ দৃশ্যমান। যার দৃঢ় নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বই প্রমাণ করে তিনি বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসুরি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আজ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। আজ বাংলার মানুষ শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রেখেছে। তিনিই আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। পরনির্ভরতা থেকে বের হয়ে, সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে, দূরদর্শীতা ও সাহস দিয়ে দেশকে স্বনির্ভর করেছেন, যা বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অনেক আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে আমাদের আরও এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাব ও দুর্নীতি এখনো বড় বাধা। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাব আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে কাক্সিক্ষত পর্যায়ের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ইদানিং লক্ষ করা যাচ্ছে, ‘উন্নয়নের সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক থাকে’ এটি আপ্তবাক্যে পরিণত হয়েছে, যা দুর্নীতিকে উসকে দেওয়া বা স্বাভাবিকতা দেওয়ার এক অপচেষ্টা। মনে রাখা দরকার, ব্রিটিশদের চেয়ে অধিক সৈন্য নিয়েও সেনাপতি মীরজাফর, রায় দুর্লভ ও জগৎ শেঠের মতো নিজেদের লোকের বিশ্বাসঘাতকতায় সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। বিশ্বাসঘাতক, লোভী, অসৎ লোকজন নিয়ে দেশ গড়া যায় না। উন্নয়ন টেকসই করা যায় না। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ অথবা আধুনিক মালয়েশিয়ার উত্থানের জনক ডা. মাহাথির বিন মোহাম্মদ ছিলেন কঠোর, সৎ, প্রাজ্ঞ, দূরদর্শী নেতা। তারা দুজনই আইনের শাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি দূরীকরণে সফল ছিলেন। ফলে অতিস্বল্পসময়ে দেশ দুটির উত্থান হয়েছে। তাই শেখ হাসিানাকেও কঠোর হস্তে সব দমন করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় এনে সবার জন্য সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের চিন্তাচেতনার সংস্কার করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। আমাদের রয়েছে শক্তি, সাহস ও সমৃদ্ধির একটি গৌরবময় ইতিহাস। ইতিহাসের কয়েকটি পর্বে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের উন্নত ও অগ্রসর জাতিগুলোর মধ্যে একটি। সেই ইতিহাস জানতে হবে। জাতি সম্পর্কে উচ্চ ধারণা তৈরি করতে হবে। জাতিকে নিশ্চয় গর্ব করতে হবে।
লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন