সব পূর্বাভাস এবং জনমত জরিপকে ভুল প্রমাণিত করে বিতর্কিত রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে ভালো ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। যদিও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ২ শতাংশের বেশি পপুলার ভোট পেয়েছেন। এ নিয়ে মোট পাঁচবার পপুলার ভোট বেশি পাওয়া প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে হেরেছেন। নিকট অতীতে ২০০০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী আল গোর পপুলার ভোট বেশি পেলেও ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে সামান্য ব্যবধানে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী জর্জ ডব্লিউ বুশের কাছে হেরে যান। ২০১৬ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের ফলাফল চূড়ান্তভাবে ঘোষিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে তা অতীতে কখনো ঘটেনি।
ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট পদে না বসানোর দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে শুধু ডেমোক্রেটিক দলের সদস্য ও সমর্থকরাই নন, এদের মধ্যে বহু শান্তিকামী ও মানবতাবাদী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকও রয়েছেন। মাইকেল মুর, লেডি গাগাসহ বহু সেলিব্রেটিও রাজপথে জনতার সাথে বিক্ষোভে শরিক হয়েছেন। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ডেমোক্রেটিক দলীয় প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার আবেদনে এ পর্যন্ত সই করেছেন দেশটির ৩০ লাখেরও বেশি নাগরিক। ১৫টি অঙ্গরাজ্যের ২০০ জন ইলেকটোরালের কাছে তারা এ মর্মে আবেদন জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, ইলেকটোরাল কলেজের সদস্যরা আগামী ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ চূড়ান্তভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন।
আবেদনকারীরা বলেছেন, পপুলার (জনগণের) ভোটে প্রায় ৩ লাখ ভোটের ব্যবধানে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করেছেন হিলারি ক্লিনটন। কাজেই তাকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কোনো কোনো মার্কিন ও বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, আগামী ১৯ ডিসেম্বর কংগ্রেসের নি¤œকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে ইলেকটোরাল কলেজের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ভোট প্রদান করবেন। নিয়ম অনুযায়ী ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ী প্রার্থীরাই এসব ভোট প্রাপ্য। কিন্তু মার্কিন সংবিধানের আর্টিকেল ৩৮ (বি) অনুযায়ী কোনো ইলেকটোর জয়ী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য নন। এখন বাতাসে এ গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে যে, এক্ষেত্রে ইলেকটোররা হিলারি বা গ্যারিজনসন (তৃতীয় প্রার্থী)-কেও ভোট দিতে পারেন।
তবে এক্ষেত্রে তাদেরকে জরিমানা গুনতে হতে পারে। কিন্তু এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, জরিমানা গুনতে হলেও দেশের স্বার্থে অনেক ইলেকটোর ট্রাম্পকে ভোট দিতে নারাজ। এমন কি নিজ দলের অনেক ইলেকটোরও। এমতাবস্থায় এখনো হিলারির বিজয়ের ক্ষীণ সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এটি অনেকটা নিশ্চিত যে, কোনো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকা ডোনাল্ড ট্রাম্পই পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। প্রসঙ্গের সূত্র ধরে বলা হচ্ছে, পপুলার ভোটে জয়ী হিলারি ইলেকটোরাল কলেজের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর নতুন করে ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি বাতিলের জন্য সংবিধান পরিবর্তনের দাবিও জোরদার হয়ে উঠছে। দাবি উঠেছে প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টকে জনগণ সরাসরি ভোটে অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করার।
তবে কাজটা মোটেই সহজ নয়। ১৯৬৯ সালে ইলেকটোরাল বা নির্বাচনী কলেজ বাতিলের জন্য প্রবল গণদাবির প্রেক্ষাপটে নি¤œকক্ষ প্রতিনিধি সভা এতদসংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পাস করে এবং তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এই প্রস্তাবের বিলে স্বাক্ষরদান করার পরও উচ্চকক্ষ সিনেট তা বাতিল করে। যা হোক, ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ায় শুধু গণবিক্ষোভই নয়, ক্যালিফোর্নিয়ার জনগণের একটা বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দাবিও তুলেছে। উল্লেখ্য যে, ইলেকটোরাল কলেজের সবচেয়ে বেশি ইলেকটোরাল ভোটার (৫৯ টি) এই ক্যালিফোর্নিয়ার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলমান রাজনীতির প্রবণতা দেশটির জন্য শুভকর নয়। ট্রাম্পের অভিবাসনবিরোধী ও নারী-মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য, নারী কেলেঙ্কারি এবং দুর্নীতির কারণেই ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকে তার বিরুদ্ধে সচেতন মার্কিন জনগণ প্রতিবাদমুখর হয়েছেন।
এত কিছুর পরও এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝে ঘুরে দাঁড়ানোর অদ্ভুত এক ক্ষমতা তথা গুণ ট্রাম্পের রয়েছে। এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, ট্রাম্পের উত্থান আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। এটি নিউকনদের দীর্ঘ প্রয়াসের ফসল। এই নিউকন তথা নব্যরক্ষণশীলরা মূলত শ্বেতাঙ্গ নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই এই নব্যরক্ষণশীলরা তৎপর হয়। ‘টিপার্টি’ কিংবা ‘হোয়াইট শার্ট’ আন্দোলন শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে দ্রুত তাদের সমর্থন ভিত্তি গড়ে তোলে। এর সাথে যুক্ত হয় ৯/১১-এর ঘটনার সূত্র ধরে সৃষ্ট মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণা। এই নব্যরক্ষণশীল বা নিউকনদের সাথে যুক্ত হয় ইভানজেসিক্যাল নামে কট্টর খ্রিস্টান গ্রুপ এবং কু ক্লাকস ক্লান নামের সন্ত্রাসী শ্বেতাঙ্গ সংগঠন। এরা সদ্য সমাপ্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপালিকান ট্রাম্পের পক্ষে প্রকাশ্য নির্বাচনী প্রচারে নামতে চেয়েছিল।
এদিকে বিশ্বায়নের কারণে বহু মার্কিন শিল্প কলকারখানা ভিন্ন দেশে স্থানান্তরিত হয়েছে। বহু কয়লা কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্বল্প শিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ মার্কিন শ্রমিকরা। তাদের মধ্যেও অভিবাসী ও বর্ণবিদ্বেষ জাগিয়ে তোলা হয়। বর্ণবিদ্বেষ, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব এবং মুসলিমবিদ্বেষ মূলত এই তিন বিষয়কে পুঁজি করেই ট্রাম্পের উত্থান। বিশ্লেষকদের অনেকের অভিমত হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গদের মনোভাব ও অনুভূতিকে দক্ষতার সাথে কাজে লাগিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধু প্রাইমারি নয়, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী বৈতরণীও পার হয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় অভিবাসী কৃষ্ণাঙ্গ এবং হিস্পানিকবিরোধী বক্তব্যও ট্রাম্প দিয়েছিলেন। প্রকাশ পেয়েছে তার নারীবিদ্বেষী মনোভাবও। এদিকে মুসলিমবিরোধী বক্তব্য দেয়ার কারণে ট্রাম্প ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের সমর্থন পেয়ে যান। ট্রাম্পের বিজয় কামনা করে হিন্দু মন্দিরে মন্দিরে প্রার্থনা করা হয়। ট্রাম্প তার মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্যের সাথে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাবেরও প্রকাশ ঘটান। নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প পাকিস্তানকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ভারতের প্রতিবেশী একটি দেশ বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দেশ। আর পাকিস্তান সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি আগে থেকেই মন্তব্য করে আসছেন যে, পাকিস্তান হলো সন্ত্রাসবাদের স্বর্গরাজ্য। শুধু তাই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু হিন্দু মন্দিরে আশীর্বাদ নিতে গিয়ে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, আমি ভারত ও হিন্দুদের ভালোবাসি। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ের ক্ষেত্রে অন্য অনেকের মতো মার্কিন প্রবাসী ভারতীয় ব্যবসায়ী শালভ কুমারেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকদেরকে ট্রাম্পের পক্ষে শুধু ভোট দানেই উদ্বুদ্ধ করেননি, সেই সাথে ট্রাম্পের অন্যতম পরামর্শকের ভূমিকাও পালন করেছিলেন।
এসব কারণে ট্রাম্পের জয়ে উৎফুল্ল ভারতের মোদি সরকার। কারণ মুসলিমবিদ্বেষী নীতিতে দুজনই একাট্টা। যে কারণে ‘মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট ডিসকাশন অর্গানাইজেশন অব রেভ্যুলিউশন সায়েন্স’-এর এক বিশেষ নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘ট্রাম্প ও মোদি হলো শয়তানের যমজ ভাই’। অন্যদিকে ট্রাম্পের বিজয়কে নিজের বিজয় বলে মন্তব্য করেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতা নিয়াহু। সুতরাং ট্রাম্পের বিজয় এবং আগামী জানুয়ারিতে তার দায়িত্ব গ্রহণ ইত্যাদিতে উদ্বিগ্ন পাকিস্তান, আরব বিশ্ব তথা গোটা মুসলিম জাহান। যে কারণে পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকরা হিলারির চেয়ে ট্রাম্পকেই বেশি বিপজ্জনক বলে মনে করছেন। অন্যদিকে ট্রাম্পের বিজয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আঁতাত আরো দৃঢ় হওয়ার সম্ভাবনাই অনেক বেশি।
যে কারণে অনেকের ধারণা, ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে সকলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা আরো ক্ষীণতর হয়ে গেল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রবল আন্দোলনের মুখে ভাবি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওবামার স্বাস্থ্য বীমা, হিস্পানিক ও মুসলিমদের বিষয়ে নরম মনোভাব ও অবস্থান পরিবর্তনের কথা বললেও তা যে ছিল নিছক কথার কথা সেটি প্রমাণিত হতেও সময় লাগেনি। ইতোমধ্যে ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ৩০ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করবেন। মেক্সিকো সীমান্তে সীমিত আকারে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করবেন। অন্যদিকে ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মার্কিন মুসলিম অভিবাসীদের ওপর কট্টরপন্থি শ্বেতাঙ্গদের হামলা ও নির্যাতন বহুগুণ বেড়ে গেছে। তাই বলা চলে, ট্রাম্পের বিজয় শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঐক্যই বিনষ্ট নয়, বাদ বাকি বিশ্বও এক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
লেখক : কলামিস্ট
jamil201312@live.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন