* এক দশকে বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে প্রায় ৮ ফুট পলিথিনের স্তর জমেছে : এসডো
* পলিথিন নিষিদ্ধে আইন থকলেও অবাধে চলছে উৎপাদন ও বিপণন, পরিবেশ অধিদফতর নীরব
* পলিথিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরিতে সবাইকে কাজ করতে হবে : সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
* পলিথিন বন্ধে সরকার আন্তরিক নয় : বাপা
নিষিদ্ধ পলিথিন ও প্লাস্টিকের অবাধ ব্যবহারে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র ধ্বংসের মুখে। বর্তমানে দৈনন্দিন জীবনের সব কাজে চলছে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার। নিত্যদিনের বাজার সদাই থেকে শুরু করে এক টাকা দামের চকলেট হোক, মশলা, সাবান বা লাখ টাকার সোফা সব কিছুর সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে পলিথিন। চা-কপি পানে ব্যবহার হচ্ছে ওয়ানটাইম ইউজ প্লাস্টিকের কাপ। পানি কিনে তা পান করে প্লাস্টিকের বোতল যেখানে সেখানে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এসব অপচনশীল পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহারের পর যত্রতত্র ফেলে দেওয়ায় ভরাট হচ্ছে নগরীর পয়োনিষ্কাশনের নালা-নর্দমা। তাতে নগরীতে তৈরি হচ্ছে পানিবদ্ধতা। ধ‚ষিত হচ্ছে পরিবেশ। এ ছাড়া পলিথিন বা প্লাস্টিক মাটিতে না পঁচে এক ধরনের আবরণ সৃষ্টি করে মাটির গুণাগুণ নষ্ট করছে। এ ছাড়া পলিথিন ও পাস্টিক নদীতে মিশে নদীর তলদেশে পুরু স্তর তৈরী হচ্ছে। এর ফলে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। এতে সামন্য বৃষ্টি বা ঢল হলে নদ-নদীগুলো উপচে আশপাশের বাড়ি-ঘর ক্ষেত খামার ভাসিয়ে দিচ্ছে। সিলেট-সুনামগঞ্জসহ হাওর এলাকার বর্তমান বন্যা তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অধিকাংশ নদ-নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর জমায় তাদের পানি ধারণ ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। সিলেটের সুরমা নদীর অবস্থা এরকম হওয়ায় পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানি নদী ধারণ করতে পারছে না। ফলে প্লাবিত নদী উপচে হচ্ছে শহর-গ্রাম তথা গোটা এলাকা। পলিথিন আমাদের ভ‚মি, নদী, পরিবেশ সব কিছু গিলে খাচ্ছে। সাগর বিষাক্ত করছে। ঢাকা শহরেই প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখের বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হয়। রাস্তা এবং গলি থেকে পলিথিন বাতাসে উড়ে এক পর্যায়ে জমা হয় ড্রেনে-নর্দমায়। রাস্তার মধ্যে থাকা ড্রেনের মুখে পলিথিনের স্তুপ সবসময়ই চোখে পড়ে। পলিথিন ৪০০ বছরেও পচে না। অর্থাৎ আজ কাজ শেষে যে পলিথিন গলিতে বা রাস্তায় ফেলা হচ্ছে তা পরিবেশ ধ্বংস করার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পলিথিন একদিকে জলাবদ্ধতা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে মাটির উর্বরতা কমাচ্ছে, আবার তলদেশে জমা হয়ে নদী ভরাট হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে।
পলিথিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় সিটি করপোরেশন, জেলা শহর, পৌরসভা ও উপজেলা শহর এলাকায়। ফলে শহর এলাকার নদ-নদীগুলোই পলিথিন দূষণের শিকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ^রী নদী, বরিশালের কীর্তনখোলা নদী, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর পড়েছে। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র, নরসুন্দা, নবগঙ্গা, সুরমা, করতোয়া, ইছামতি, মগড়াসহ বিভিন্ন নদ-নদী পলিথিন দূষণের কবলে পড়েছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, হালদা ও কর্ণফুলী নদীর তলদেশে কয়েক ফুট পুরু পলিথিনের স্তর জমার কারণে নদীর দূষণ তো বটেই, জীববৈচিত্রও ধ্বংস হচ্ছে। পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণে মাছের জীবনচক্র হুমকির মুখে পড়ছে। পলিথিন নদী থেকে সাগরে মিশছে। এতে লবণেও ক্ষতিকর পলিথিনের কণার অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে, যা মানব দেহে প্রবেশ করে মারাত্মক ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলার) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ইনকিলাবকে বলেন, পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার আমাদের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। এটা একধরনের আত্মহত্যার শামিল, তাই এগুলোর ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। উচ্চ আদালতের এক রায়ে বলা হয়েছে, সব হোটেল-মোটেলে পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া পলিথিন উৎপাদন ও বিপননও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও অবাধে চলছে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার এতে ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র। অথচ পরিবেশ অধিদফতর এ বিষয়ে নিরব। তারা পলিথিন উৎপাদন ও বিপনন বন্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এ ছাড়া আমাদের নগরীরর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একেবারেই দুর্বল। তার উপর নিষিদ্ধ ও ক্ষতিকর পলিথিন অবাধে ব্যবহার করে যত্রতত্র ফেলে দেওয়া নগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এতে নগরীতে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও উদাসীন। তারা পলিথিনের বিরুদ্ধে জনসচেতনা সৃষ্টির লক্ষে প্রচার প্রচারণা ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু আমরা তা দেখছি না। জনপ্রতিনিধিরা যদি জনগণকে ক্ষতিকর জিনিসের বিষয়ে সচেতন না করে তাহলে কে করবে। আমাদের সকলেরই উচিত পলিথিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রচারে নামা।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক জরিপে দেখা গেছে প্রতি বছর ৮৭ হাজার টন একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন ও প্লাস্টিক বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিকের স্ট্র, কটনবাড, ফুড প্যাকেজিং, ফুড কনটেইনার, বোতল, প্লেট, প্লাস্টিক চামচ, কাপ, প্লাস্টিক ব্যাগ, পেস্ট, শ্যাম্পুর প্যাকেট ইত্যাদি। মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে এসব প্লাস্টিক কৃষি জমি, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নদী-নালা, খাল-বিল ও সমুদ্রে পতিত হয়ে এসব পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতি করছে। তাদের অপর এক জরিপে বলা হয়েছে গত প্রায় এক দশকে বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে প্রায় ৮ ফুট পলিথিনের স্তর জমেছে। পরিবেশ অধিদফতর বলছে, পলিথিনসহ হিসাব করলে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১০ লাখ ৯৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়।
পলিথিন উৎপাদন ও বিপনন আইনগত নিষিদ্ধ। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে ২০০২ এ পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হয়। আইনে পলিথিন উৎপাদন ও বিপননের দায়ে জেল এবং জরিমানা উভয়দন্ডের কথা বলা হয়েছে। তারপরও এর উৎপাদন, বাজারজাতকরণ অবাধে চলছে। ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাগুলোতে পলিথিন উৎপাদনের ৭ শতাধিকে কারখানা রয়েছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির প্রায় ১২০০ কারখানা রয়েছে। যার বেশির ভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। এরমধ্যে ঢাকার অলিগলিতে আছে ৫শতাধিক কারখানা। সম্প্রতি প্রকাশিত তাদের এক তথ্যে উল্লেখ করা হয়, সারাদেশে অবৈধ পলিথিন তৈরির কারখানা রয়েছে কমপক্ষে ১৫০০। এর মধ্যে পুরান ঢাকা এবং বুড়িগঙ্গার তীর ঘেষে রয়েছে কমপক্ষে ৭শতাধিক কারখানা। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিদিন কোটি কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া হয়। ফেলে দেওয়া পলিথিন ব্যাগের একটা বিরাট অংশ কোনো না কোনোভাবে নদীতে গিয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর জমেছে।
পরিবেশের শত্রæ ও নিষিদ্ধ পলিথিন প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি যেমন হচ্ছে তেমনি নদী ও নদীর জীববৈচিত্রও হুমকির মুখে পড়ছে। নালা-খাল হয়ে পলিথিন-প্লাস্টিক গিয়ে পড়ছে নদীতে, আর নদ-নদী হয়ে পলিথিন-প্লাস্টিক গিয়ে পড়ছে সাগরে। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য মতে, সমুদ্রের প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্রায় ১০০ গ্রাম করে প্লাস্টিক বর্জ্য ভাসছে। সমুদ্রে পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। নদ-নদী ও সামুদ্রিক অনেক প্রাণী ছোট ছোট প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যকে খাবার মনে করে খেয়ে প্রাণ হারাচ্ছে! পেটে পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্যসহ অনেক মাছও এখন জেলেদের জালে ধরা পড়ছে। প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যরে মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো মাইক্রোপ্লাস্টিক। সমুদ্রের ঢেউয়ের ধাক্কা ও তাপ-চাপের কারণে নদী ও সমুদ্রে ভেসে থাকা পলিথিন-প্লাস্টিকের কণাগুলো ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হয়ে যায়। অনেক সময় প্লাস্টিক-পলিথিনের অতি ক্ষুদ্রক্ষুদ্র কণা সমুদ্রের পানির সঙ্গে মিশে যায়, যা পরর্বর্তী সময়ে সামুদ্রিক প্রাণীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া লবন ও মাছের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে তা ক্যন্সারসহ মারাত্মক রোগের জন্ম হতে পারে।
আমাদের কৃষিকাজ, জীবনযাপন ও অর্থনীতির সঙ্গে নদ-নদীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আর এই নদ-নদী যদি পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয় তাহলে তা পুরো অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। নদীর তলদেশে দিনের পর দিন এখন লাখো-কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হয়ে নদী ও জীববৈচিত্রের জন্য যে সর্বনাশ ডেকে আনছে। মৎস্যসম্পদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণের কারণে নদীতে মাছ আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক নদীতে দূষণের কারণে অক্সিজেনের পরিমাণ অতিমাত্রায় কমার ফলে মাছসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র টিকে থাকাও কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে নদীর তলদেশে পলিথিনের স্তর এত পুরু হয়ে গেছে যে, নদী খনন কাজেও সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
পলিথিন উৎপাদন ও বিপনন বন্ধে পরিবেশ অধিদফতরের ভূমিকার বিষয়ে জানতে মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদকে একাধিকবার ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল এ বিষয়ে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধে আইন থাকলেও এর কার্যকারিতা একেবারেই নেই। সরকার এ ব্যাপারে সামান্যতমও আন্তরিক নয়। পলিথিন বন্ধ করতে হলে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ প্রয়োজন। শুধু পরিবেশ অধিদফতর একা পলিথিন বন্ধ করতে পারবেনা। তাদের সাথে শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সিটিকর্পোরেশনও সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন