চা উৎপাদনে চলতি বছর অতীতের সব রেকর্ড ভাঙা সম্ভব হবে এমন সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে চা চাষ শুরু হয়েছিল ১৬২ বছর আগে। রপ্তানির লক্ষ্যকে সামনে রেখেই শুরু হয় চা চাষ। নিজেদের ব্যবসা বাড়াতে চা কোম্পানিগুলো এ দেশের মানুষও যাতে চা পানে আগ্রহী হয়ে ওঠে সে জন্য নানামুখী প্রণোদনামূলক পদক্ষেপ নেয়। ফলে চা পানের অভ্যাস গড়ে ওঠে এদেশের নাগরিকদের একাংশের মধ্যে। তারপরও উৎপাদিত চায়ের সিংহভাগই রপ্তানি হতো। কিন্তু এক দশক আগে দেশে চায়ের চাহিদা বৃদ্ধি অন্যদিকে উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় রপ্তানির বদলে চা আমদানিকারক দেশে পরিণত হয় বাংলাদেশ। তারপর থেকে চায়ের উৎপাদন বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়। তার ফলশ্রুতিতে কয়েক বছর ধরে বছরে ১৩ লাখ কেজি চা বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
গত বছর দেশে চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়। উৎপাদিত হয় ৬৭.৩৮ মিলিয়ন কেজি চা। চলতি বছর দেশের ১৬২ বছরের চা উৎপাদনের সব রেকর্ড ভেঙে উৎপাদন ৭০ মিলিয়ন কেজি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। গত বছর জুন পর্যন্ত দেশের ১৬২টি বাগানে চা উৎপাদন হয়েছিল ১৭.২২ মিলিয়ন কেজি। চলতি বছরের একই সময়ে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫.৩৮ মিলিয়ন কেজি। বছরের শেষ পর্যন্ত উৎপাদনের এ ধারা ঠিক থাকলে তা গত ১৬২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড বলে বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশ টি বোর্ডের তথ্যমতে, ২০০৫ সালে দেশে চা উৎপাদন হয় ৬ কোটি ১ লাখ ৪০ হাজার কেজি। কিন্তু ২০০৬ সালে উৎপাদন ৫ কোটি ৩৪ লাখ ৭০ হাজার কেজিতে নেমে আসে। এর পরের বছর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে উৎপাদন। ২০০৭ সালে ৫ কোটি ৮৪ লাখ ২০ হাজার কেজি, ২০০৮ সালে ৫ কোটি ৮৬ লাখ ৬০ হাজার, ২০০৯ সালে ৫ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার, ২০১০ সালে ৬ কোটি ৪ লাখ, ২০১২ সালে ৬ কোটি ১৯ লাখ ৩০ হাজার, ২০১৩ সালে ৬ কোটি ৫২ লাখ ৬০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়। তবে ২০১৪ সালে উৎপাদন কিছুটা কমে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৬০ হাজার কেজি হলেও ২০১৫ সালে তা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। এটা দেশের চা শিল্পের জন্য অনেক বড় সুখবর। তবে পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের দেশে হেক্টরপ্রতি চা উৎপাদন এখনো অনেক কম। চা বোর্ডের সহযোগিতায় বাগান মালিকরা উদ্যোগী হলে চা উৎপাদনের এ ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব। ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে চায়ের সোনালি অতীতে ফিরে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
এদিকে ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে চা রফতানি হয়েছিল সর্বোচ্চ ৩ কোটি ৪০ লাখ কেজি। এর পর ধারাবাহিকভাবে কমেছে রফতানি। সর্বশেষ ২০১১ সালে রফতানি ২০ লাখ কেজির নিচে নেমে আসে। ২০১৪ সালে রফতানি হয় সর্বনিম্ন ১৩ লাখ কেজি।
দেশে ১৬৬টি বাগানে ৫৮ হাজার ৭১৯ হেক্টর জমিতে চা আবাদ হয়। হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ১ হাজার ২৭০ কেজি। সম্প্রতি চা বোর্ড দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় ৬০০ হেক্টর পাহাড়ি জমি ক্ষুদ্রায়তন চা চাষের আওতায় আনতে প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর ও লালমনিরহাটে ৫০০ হেক্টর এবং বান্দরবানে ১০০ হেক্টর। এ দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আগামীতে দেশে চার উৎপাদন বাড়বে ১২ লাখ কেজি।
দেশে ১৬৬টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজারে রয়েছে ৯০টি। এছাড়া হবিগঞ্জে ২৩, সিলেটে ২০, চট্টগ্রামে ২২, রাঙামাটি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি করে ও পঞ্চগড়ে নয়টি বাগান রয়েছে। ছোট পরিসরের চা চাষসহ দেশে চা বাগানের মোট ভূমি ১ লাখ ১৬ হাজার ২১৯ হেক্টর। এর মধ্যে ৫১ শতাংশ অর্থাৎ ৫৮ হাজার ৭১৮ হেক্টর জমি চা চাষের আওতায় রয়েছে। ৩৯ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে রাবার, বাঁশ, ধান, কাঁঠাল, লেবুসহ বিবিধ ফলের চাষ, পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত বনায়ন রয়েছে।
বাংলাদেশে চা উৎপাদন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৩ সালে রেকর্ড পরিমাণ ৬৬.২৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপন্ন হয়। গত ২০০৮ সালে চায়ের উৎপাদন ছিল ৫৮.৬৬ মিলিয়ন কেজি। ৫ বছরে চা উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৭.৬০ মিলিয়ন কেজি।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের পক্ষ থেকে বৃহদায়তন চা বাগানের পাশাপাশি ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সৃজনের মাধ্যমে দেশের চা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাঙ্গামাটি জেলায় ৫০ হেক্টর, খাগড়াছড়ি জেলায় ২৫ হেক্টর এবং বান্দরবান জেলায় ২২৫ হেক্টরসহ তিন পাবর্ত্য জেলায় ৩০০ হেক্টর এলাকায় চা চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ১০২৯.৩৩ লক্ষ টাকা ব্যয় সাপেক্ষে আগস্ট ২০০৩ হতে জুলাই ২০১৫ পর্যন্ত সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য ‘স্মল হোল্ডিং টি কালটিভেশন ইন চিটাগাং হিল ট্রাক্টস’ শীর্ষক প্রকল্প নেয়া হয়েছে। উক্ত প্রকল্পের আওতায় ৫২ জন স্মল গ্রোয়ার্স/হোল্ডার এ পর্যন্ত বান্দরবানে ১১০ হেক্টর, মানিকছড়িতে ৩.২০ হেক্টর এবং রাঙ্গামাটিতে ১.৮২ হেক্টর অর্থাৎ মোট ১১৫.০২ হেক্টর জমি চা চাষের আওতায় আনয়ন করেছে। উক্ত এলাকায় ২০১০ সালে চা পাতা চয়ন শুরু হয়েছে। ২০১৩ সালে ২৫,০০০ কেজি সবুজ চা পাতা চয়ন করা হয়েছে, তা থেকে ৫,৬১৮ কেজি মেইড টি তৈরি হয়েছে। যা পূর্ববর্তী বৎসরের তুলনায় ৪২.২৩% বেশি। বান্দরবানে উৎপাদিত ক্লোন চা এখন চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক নিলামে উচ্চমূল্যে বিক্রয় হচ্ছে যা ক্রেতা জনসাধারণের নিকট সমাদৃত হয়েছে।
দেশের পঞ্চগড় ও পার্বত্য বান্দরবান জেলায় সিএফসি অর্থায়নে ১টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র চা চাষিদের চা চাষে প্রশিক্ষণ প্রদান, ১০ লক্ষ চা চারা উত্তোলনপূর্বক ক্ষুদ্র চাষিদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ এবং ১০টি সবুজ চা পাতা সংগ্রহ কেন্দ্র ও ১০টি সমবায় কেন্দ্র স্থাপন, ২টি পিকআপ, ৩টি লাইট ট্রাক, ৩টি মটর সাইকেল ক্রয়, প্রভৃতি কাজ অন্তর্ভুক্ত করে সিএফসির অর্থায়নে একটি প্রকল্প বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। প্রকল্পটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ১,৯৯৪,৬৩০ মার্কিন ডলার। এ অর্থের মধ্যে সিএফসি ১,৮৪৩,০৩০ মার্কিন ডলার অনুদান হিসাবে অর্থায়ন করবে যার মধ্যে বাংলাদেশ চা বোর্ড পাবে ৬,০৮,৬২৩ মার্কিন ডলার। প্রকল্পের কাউন্টারপার্ট তহবিল হচ্ছে ১,৫১,৬০০ মার্কিন ডলার যার মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার অংশ ৯৫,৭০০ মার্কিন ডলার এবং বাংলাদেশ চা বোর্ডের অংশ ৫৫,৯০০ মার্কিন ডলার।
বান্দরবান জেলায় অবস্থিত চা উন্নয়ন প্রকল্প অফিসের জন্য ৪.৪৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ৪১৬ ফুট দীর্ঘ একটি সংযোগ সড়ক, চট্টগ্রাম জেলার আগুনিয়া চা বাগানে ৩.৯৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি বক্স কালভার্ট ও চট্টগ্রাম জেলার উদালিয়া চা বাগানে ৪.৩৮ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। মা-জান চা বাগানে প্রায় ৪.০০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে।
চা শিল্পের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার জন্য বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক পর্যটন শহর শ্রীমঙ্গলে পরিচালিত টি রিসোর্ট আঙ্গিনায় ২০০৯ সালে দেশের প্রথম একমাত্র টি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ মিউজিয়াম প্রায় দেড়শ বছর পূর্বে ব্রিটিশ আমলে চা বাগানগুলোতে ব্যবহৃত ৪০টি পুরানো আসবাবপত্র বিভিন্ন সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতার পূর্ব সময়ে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ব্যবহৃত চেয়ার, টেবিল এবং ব্রিটিশ আমলের চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য ব্যবহৃত পৃথক কয়েন (মুদ্রা), বিভিন্ন সামগ্রী, ব্রিটিশ আমলে লন্ডন থেকে আনা ওয়াটার ফিলটার, রিং কোদাল, তীর ধনুক, কেরোসিন চালিত ফ্রিজ, পুরাতন গাড়ির চেচিস, ইত্যাদি।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর এ পর্যন্ত বিটি ১ থেকে বিটি ১৮ নামে ১৮টি উচ্চ ফলনশীল ক্লোন অবমুক্ত করেছে। তাছাড়া বিটিআরআই কর্তৃক উচ্চ ফলনশীল বাই ক্লোনাল বীজ ৪টি এবং পলি ক্লোনাল বীজ ১টি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন ডিসিপিনে ৫৫টি গবেষণা কার্য চালু রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, কুয়েত, ওমান, সুদান, পাকিস্তান, ভারত, পোল্যান্ড, রাশিয়া, ইরান, আফগানিস্তান, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, বেলজিয়ামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চা রপ্তানি হচ্ছে। উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদেশে চা রপ্তানিও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশের সিলেট বিভাগ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশাপাশি পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়েও অর্গানিক পদ্ধতিতে চায়ের চাষ হচ্ছে এবং এ চা বিদেশি ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। চা উৎপাদন বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি সুখবর বলে বিবেচিত হচ্ছে। এ সাফল্যকে ধরে রাখতে চা উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। দেশের চায়ের যে সুনাম রয়েছে তা অক্ষুণœ রাখার দিকেও নজর দিতে হবে। চা উৎপাদন বৃদ্ধি প্রান্তিক চা চাষি ও চা শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি যাতে নিশ্চিত করতে পারে সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাই নজর দেবেন এমনটিও প্রত্যাশিত।
লেখক : প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক মন্ত্রী বাণিজ্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন