রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

বিশ্ব বিবেক নীরব কেন

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার | প্রকাশের সময় : ১৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী। এরা ইসলাম ধর্মের অনুসারী। বর্তমান মিয়ানমারের রোহিং (আরাকানের পুরনো নাম) এলাকায় বসবাসকারীরা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দের অর্থ হলো নৌকার মানুষ, যারা সমুদ্রজলে নৌকা ভাসিয়ে মৎস্য সম্পদ আহরণ করে জীবিকা অর্জন করেন। ২০১২ সালের এক হিসাবে অনুযায়ী ৮ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বসবাস করে। বিবিসির এক খবরে প্রকাশ, গত ৯ অক্টোবর থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত এক সপ্তাহে মিয়ানমারে ৬৯ জন রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর তারা হেলিকপ্টার থেকেও নির্বিচারে গুলি ছুড়েছে। খবরটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। রাখাইন প্রদেশে সম্প্রতি শুরু হওয়া বিদ্রোহ দমনের অংশ হিসেবেই এই হামলা চালানো হয়েছে বলে সেনাবাহিনী স্বীকার করছে। আর রোহিঙ্গা সূত্রগুলো বলছে, সেনাবাহিনী সেখানে অধিবাসীদেরকে হত্যার পাশাপাশি ধর্ষণও করছে এবং গ্রামের পর গ্রাম তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার ব্যবহার করে হামলা পরিচালনা করছে। ওই এলাকায় সাংবাদিক প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা ব্রিটিশদের কর্তৃত্বকে সহজে মেনে না নেবার কারণে বরাবরই তারা মুসলমানদের শত্রু মনে করতো। ফলে বার্মায় পুরোপুরিভাবে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার পর রোহিঙ্গারা যাতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে না পারে এবং মুসলমানদেরকে পরাস্ত করতেই রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘মগ’দেরকে প্রতিষ্ঠিত করা হয় সেখানে। তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা উত্তর বার্মার শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন অজুহাতে তাদের মিয়ানমার বা আরাকানের নাগরিক হিসেবে গ্রহণ না করে শুধু আরাকানের বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত করে। এই উপমহাদেশে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে ক’টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে, আরাকান তথা বর্তমান রাখাইন প্রদেশ তার অন্যতম। তদুপরি, মুসলিম শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে ২০০ বছরের অধিককাল স্থায়ী হওয়া সেই স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব আজ নেই। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জনের পর বহুদলীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলে সে সময়ের পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থান হলে তাদেরকে বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়। সরকারিভাবে সে দেশে তাদের বসবাসকারী হিসেবে উল্লেখ করে সাংবিধানিক ও আর্থসামাজিক অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়েছে।
বার্মা সরকারের নির্যাতনের কারণে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়ে ৫ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশ এবং প্রায় ৫ লাখ সৌদিআরবে বাস করার একটি পরিসংখ্যান উইকিপিডিয়া তুলে ধরেছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। ধর্মীয় কারণেও তাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। সালাত আদায়ে বাধা দেয়া হয়। নির্বিচারে হত্যা ও নারীদেরকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেয়াসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ দেয়া হয় না। তাদের সংখ্যা যাতে বাড়তে না পারে সে জন্য বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয় না। বৌদ্ধ রাখাইনদের টার্গেট হলো নিরস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্যাতনের মাধ্যমে নির্মূল করা। সেই লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার ও সেনাবাহিনী পরকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদেরকে দেশ থেকে বের করে দিতেই যত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। ¤্রাউক-উই শহরটি যেন গণহত্যার কূপে পরিণত হয়েছে। বার্মিজ সরকারপন্থী পত্রিকা ‘দ্যা নিউ লাইট অব মায়নমার’ সূত্রে জানা গেছে ৮টি মসজিদসহ ২০০০ রোহিঙ্গার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। (২৬ অক্টোবর)। ধারণা করা হচ্ছে, ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের আনুমানিক ১০,০০০ বসতি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অনেক রোহিঙ্গা প্রাণভয়ে পালাচ্ছে সাগরে কিংবা জঙ্গলে, তবুও রক্ষা হচ্ছে না। রাখাইন সন্ত্রাসীরা এবং কতিপয় সেনাসদস্যরা রোহিঙ্গা মেয়েদের তুলে নিয়ে ধর্ষণ করছে। বৌদ্ধরা নিজেদের অহিংস দাবি করলেও তারা সহিংসতার চরমে পৌঁছে গেছে। মুসলিমদের নির্যাতন ও হত্যার জন্য বৌদ্ধদেরকে জবাবদিহিতা ও শাস্তির আওতায় না আনায় তাদের সহিংসতা ক্রমশ বেড়েই চলছে। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের নির্বাসন ও ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপারে সংকিত হলেও তাদেরকে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। এই যদি হয় তাদের অবস্থা তাহলে তাদেরকে কারা শান্তি দিবে? এভাবেই জাতিসংঘ ও ওআইসির কর্মকা- বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ।
মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যা করা হবে আর প্রতিবেশী মুসলিমরা শুধু তাকিয়ে দেখবে! এ যেন নিষ্ঠুরতা। তবে এটিও সত্য বহিশক্তির চাপ না থাকায় তারা যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে। মুসলিম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানরা চুপচাপ না থেকে নির্যাতিত মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে নির্যাতন থেকে তাদের মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তারা যাতে নাগরিকত্ব ফিরে পায় সেই লক্ষ্যে সার্বিক ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন ও হামলার ঘটনা হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা ছাড়া অন্যান্য পত্রিকায় তাদের সংবাদও প্রকাশিত হয় না। এদের অবস্থাটা হলো এমন যে, মুসলিমদের বেলায় তারা প্রচার বিমুখ। অথচ মুসলিম সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কোনো সম্প্রদায়ের ওপর যখন কোনো হামলা হয় তখন সে বিষয়কে খুব গুরুত্বের সাথে প্রচার করা হয়। আর আমরা মুসলিমরা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের দুর্বিষহ জীবনযাপন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি কম যায় বলেই তাদের দুঃখ-কষ্ট বোঝার উপায় থাকে না।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুটিই প্রতিবেশী দেশ। এই দুই দেশের মধ্যে সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭১ কিলোমিটার। মধ্যযুগে আরাকান ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং সেই সময় এর পরিধি চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মধ্য যুগের এক পর্যায়ে আরাকান রাজ্যসভাই মুসলিমভিত্তিক বঙ্গীয় সাহিত্যচর্চার প্রাণ কেন্দ্র ছিল বলেই ড. এনামুল হকের তথ্য থেকে জানায়। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হবে কি-হবে না সে বিতর্কের শেষ হতে-হতে হয়তো রোহিঙ্গাদের সংখ্যা জ্যামিতিকহারে কমে আসবে। অসহায় নারী শিশু ও বৃৃদ্ধসহ খেটে খাওয়া অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী কী এভাবেই নির্যাতিত হতে থাকবে? আশ্রয়হীন এ মানুষগুলো বাংলাদেশ সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েও পায়নি তাদের সমাধান। আরাকানি মুসলমানদের সাথে বাংলাদেশের বন্ধন দীর্ঘদিনের। অথচ সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সে সম্পর্ক আজ ম্লান। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও ধর্মীয়সহ বহুমাত্রিক বন্ধনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে দেশের স্বার্থে, মুসলিম জনগোষ্ঠী হিসেবে মানবতার কল্যাণে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করার সুযোগ রয়েছে এখানে।
রোহিঙ্গারা মূলত মিয়ানমারের নাগরিক। বিশ্ববাসী এই চিরসত্যটি জানলেও মিয়ানমার সরকার তা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। প্রাণভয়ে সাগরপথে পালাতে চাইলেও তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাদেরকে আশ্রয় দেয়া হয় না কোনো দেশে। অসুস্থ হলেও চিকিৎসা নেই, স্কুলে যেতে পারছে না এ কেমন বর্বর রাষ্ট্র। ক্ষুধার্ত রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না খেয়ে মরছে। প্রতিবেশী দেশগুলো তাদেরকে গ্রহণ করতে রাজি হচ্ছে না। সার্বিক দিক বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, মুসলমান হওয়াই রোহিঙ্গাদের নির্যাতিত হওয়ার অন্যতম কারণ। আর এটি বিশ্ব শান্তির জন্য এক অশনি বার্তা। বাংলাদেশ সরকারের মতো কেউ কেউ ভাসমান নৌকায় শুধু খাবার আর পানীয় দিয়ে সাহায্য করার মধ্যদিয়ে তাদের দায়িত্ব এড়িয়েছেন, এমনটি যথাযথ হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। রোহিঙ্গাদেরকে স্থায়ীভাবে নিরাপদে বসবাসের একটি সুযোগ করে দিতে পারলে মুসলিম জনগোষ্ঠীটি আপন ঠিকানা খুঁজে পেত। জুলুম-নির্যাতন কমে আসত। শিক্ষাবঞ্চিতরা জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়ার উপায় বের করতে পারত। কোনো মুসলিম যদি অপর মুসলিমের কাছে সহযোগিতা চায় আর তার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যদি তাকে সহযোগিতা না করে তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অবশ্যই তাকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
সর্বোপরি, রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিটি মুসলমানের সার্বিক চেষ্টা করা উচিত। রোহিঙ্গারা আর কতকাল শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হবে। বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালন করেই কী দায় এড়ানো সম্ভব? রোহিঙ্গাদের কান্না বিশ্ব বিবেককে এখনও জাগ্রত করতে পারেনি। কিন্তু প্রশ্ন হলো বিশ্ব বিবেক এ ক্ষেত্রে নীরব কেন?
 লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
সধনফঁষশধযযধৎ@মসধরষ.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
M M Harun or Rashid ১৯ নভেম্বর, ২০১৬, ৮:০৯ এএম says : 0
হে আল্লাহ তুমি কাফেরদের কবল থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করো
Total Reply(0)
১৯ নভেম্বর, ২০১৬, ৯:০১ এএম says : 0
রোহিঙ্গারা মুসলিম এই কারণে বিশ্ব বিবেক নিরব।
Total Reply(0)
Muhammad Shamsul Islam ১৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১১:২২ এএম says : 0
সারা বিশ্ব থেকে আওয়াজ তুলুন এবং প্রতিবাদ অভ্যাহত রাখুন।
Total Reply(0)
মাহাবুর রাহমান ১৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১০:২৮ পিএম says : 0
হে আললাহ্ আপনি মুসলমান এক হওয়ার তাওফিক দান করুন আমিন
Total Reply(0)
Raihan ২০ নভেম্বর, ২০১৬, ৮:২৭ এএম says : 0
বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমার আকুল আবেদন প্রতিবেশি মুসলমানদেরকে যেন আচ্রয় দেয়
Total Reply(0)
Rakib ২০ নভেম্বর, ২০১৬, ২:১৮ পিএম says : 0
মানবতা মুসলিমদের জন্য প্রযোয্য নয়!
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন