চিকিৎসকদের মতে, বাংলাদেশে যত রোগীর মুখে ক্যান্সার হয়, তার শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগই সাদাপাতা ও তামকপাতা ব্যবহার করে থাকেন। তামাক ব্যবহারের ফলে অসুস্থতার চিত্রও ভয়াবহ। তার চেয়েও ভয়াবহ পরোক্ষ ধূমপানের বিষয়টি। ধূমপান না করেও নারী ও শিশুরা ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। তামাকে বিদ্যমান রাসায়নিক পদার্থ নারী ও শিশুর শরীরে নানা ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র (ডবিøউএইচও) মতে, পৃথিবীতে প্রতিরোধ করা সম্ভব এমন মৃত্যুর মধ্যে বেশি মৃত্যু ঘটে তামাক সেবনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের লাখো নারী ও শিশু ধূমপান না করেও প্রতিরোধযোগ্য এ মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে। ২০০৯ সালে গেøাবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক শতকরা ৩০ ভাগ নারী কর্মস্থলে এবং ২১ নারী জনসামগমস্থলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন। ধূমপান না করেও পরোক্ষ ধূমপান বা সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিংয়ের শিকার বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি নারী। তবে প্রকৃত চিত্র এর চেয়েও বেশি। কারণ অনেক ‘সচেতন’ পুরুষকে প্রায়ই বাসা-বাড়িতে ধূমপান করতে দেখা যায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে শতকরা ৪৩ ভাগ মানুষ তামাক সেবন করেন। এর মধ্যে পুরুষ শতকরা ৫৮ ভাগ আর নারী ২৯ ভাগ। পুরুষদের মধ্যে শতকরা ৪৫ ভাগ সিগারেট ও ২১ ভাগ বিড়ির মাধ্যমে ধূমপান করেন। এদের বেশিরভাগই দিনের কোনো না কোনো সময় বাসা-বাড়িতে নারী ও শিশুর সামনে ধূমপান করেন। এ ছাড়া জনসমাগমস্থল বা পাবলিক প্লেসেও ধূমপানের চিত্র নিত্যদিনের।
তামাক বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বাধুনিস-এর উপদেষ্টা বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা.আব্দুল হাই এ প্রসঙ্গে বলেন, অসেচতনতার অভাবে পরোক্ষ ধূমপানের বিষয়টি আমাদের সমাজে বেশি ঘটছে। পরোক্ষ ধূমপান থেকে নারী ও শিশুদের বাঁচাতে হলে জনসেচতনতা গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া তামাকজাত পণ্যের ট্যাক্স পর্যায়ক্রমে বাড়ালে তা ব্যবহারে অনেকেই নিরুৎসাহিত হবে। এতে করে তামাকজাত পণ্যের ব্যবহারও কমবে। তিনি বলেন, তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহারে সৃষ্টি রোগের নীরব মহামারি চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রত্যক্ষ ধূমপানের মতোই পরোক্ষ ধূমপানে ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ ও স্ট্রোক, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা এবং সন্তান জন্মদান সংক্রান্ত সমস্যা হয়ে থাকে। ডবিøউএইচও’র মতে, পুরুষদের ধূমপানের ফলে নারী ও শিশুরাও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। তামাক পণ্যের উৎপাদন কমানোর পাশাপাশি দাম বাড়িয়ে দিলে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে এর ব্যবহার কমতে পারে। ‘রিপোর্ট অন দ্য গেøাবাল টোব্যাকো এপিডেমিক’-এ উল্লেখ করা হয়েছে, তামাকে বিদ্যমান উপাদানগুলোর মধ্যে নিকোটিন, কার্বন মনোক্সাইড, বেনজোপাইরিন, হাইড্রোজেন সায়ানাইড, পোলিনিয়াম-২১০ প্রভৃতি রয়েছে। বিড়ি-সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্যে অ্যামোনিয়া, টার, মিথাইলসহ চার হাজারেরও বেশি ক্ষতিকর পদার্থ রয়েছে। ধূমপানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ফুসফুসের। পরোক্ষ ধূমপানেও এই ক্ষতির পরিমাণ স্বাভাবিক ধূমপানের মতোই। এ প্রসঙ্গে বিএসএমএমইউ’র কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, পৃথিবীতে ফুসফুসের যত ক্যান্সার হয় তার শতকরা ৯৫ ভাগই ধূমপানের কারণে হয়ে থাকে। পরোক্ষ ধূমপানেও এ ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা কোনো অংশে কম নয়। পরোক্ষ ধূমপান থেকে নারী ও শিশুদের বাঁচাতে আমাদের সবাইকে, বিশেষ করে ধূমপায়ীদের সচেতন হতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র জরিপে দেখা যায়, অধূমপায়ীদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ বাড়িয়ে দেয় পরোক্ষ ধূমপান। ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় শতকরা ২০ থেকে ৩০ ভাগ। পাশাপাশি শিশুদের ‘সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিন্ড্রোম’ বা এসআইডিএস নামে যে মারাত্মক রোগ দেখা দেয় তারও কারণ পরোক্ষ ধূমপান। পরোক্ষ ধূমপানের ফলে নারী ও শিশুরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ধূমপান না করেও ধূমপানের শিকার হওয়ার বিষয়টিকে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা। পরোক্ষ ধূমপান কমাতে হলে অফিস-আদালতে এমনকি প্রয়োজনে বাসা-বাড়িতেও স্মোকিং জোন স্থাপন করা উচিত। সন্তান ও নিজেকে বাঁচাতে নারীদের নিজেকেই এগিয়ে আসতে হবে। বাসা-বাড়ি কিংবা অফিসে কেউ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ করতে হবে। স্মোকিং জোন ব্যবহার করার পরামর্শ দিতে হবে।
ডবিøউএইচও’র রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে মোট ধূমপায়ীর ৬০ শতাংশ যে ১০টি দেশে বসবাস করে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্বে প্রতি ৬ দশমিক ৪ সেকেন্ডে একজন লোক মারা যায় ধূমপানজনিত কারণে। আগামী ২৫ বছরে বিশ্বে ২৫ কোটি শিশু-কিশোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপানে মারা যাবে বলে মনে করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ধূমপায়ীদের কাছে এখনও বিড়ি বেশ জনপ্রিয়। বিড়ি সেবনকারীদের শতকরা ৯৮ ভাগই গরিব ও অশিক্ষিত। তাদের মধ্যে সচেতনতারও বেশ অভাব। হরহামেশাই পরিবারের নারী ও শিশু সদস্যের সামনে ধূমপান করে। বাচ্চাদের মাধ্যমে বিড়ি ক্রয় ও ধরানো গ্রামাঞ্চলের একটি অতি সাধারণ দৃশ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘দ্য এমপাওয়ার প্যাকেজ’ শীর্ষক জরিপ বলছে, বাংলাদেশেসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বিড়ি বেশি সেবন করা হয়। বিড়িতে সিগারেটের চেয়ে তিনগুণ বেশি কার্বন মনোক্সাইড ও নিকোটিন থাকে। পাঁচগুণ বেশি থাকে ‘টার’। বিড়ি সেবনাকারীদের মুখগহŸরে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি তিনগুণ বেশি। চিকিৎসাবিদরা বলছেন, কোনো নারী গর্ভাবস্থায় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হলে ভ্রƒণ অবস্থায়ই শিশুটি মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হয়। পরোক্ষ ধূমপানের ফলে নারীর গর্ভপাতের ঘটনাও ঘটে থাকে। এছাড়া নারী তার প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার পাশাপাশি গর্ভেই সন্তান মারা যেতে পারে। যেসব নারী প্রতিদিন এক ঘন্টা করে ধূমপায়ীর সঙ্গে থাকেন তার স্তন ক্যান্সারের আশঙ্কা অন্যদের চেয়ে দ্বিগুণ।
‘বাংলাদেশে তামাক-সংশ্লিষ্ট অসুস্থতার প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা থেকে দেখা যায়, প্রতিছর দেশে ১২ লাখেরও বেশি লোক তামাক-সংশ্লিষ্ট অসুস্থতার শিকার হন। দেশে তামাক সংশ্লিষ্ট মৃত্যুর পরিমাণ প্রতিবছর ৫৭ হাজারেরও বেশি। সব ধরনের মৃত্যুর মধ্যে শতকরা ৯ ভাগই তামাক ব্যবহারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তামাকবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের মতে, বছরে তামাক-সংশ্লিষ্ট মৃত্যুর সংখ্যা দেশে এখন ৭৫ হাজার হতে পারে। এ মৃত্যুর হার কমাতে সচেতনতার পাশপাশি সরকারি-বেসরকারি পদক্ষেপের বিকল্প নেই। ২০০৭ সালে করা ডবিøউএইচও’র আরেক জরিপ বলছে, তামাক ব্যবহারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ফল হিসেবে দেশে প্রতিবছর তিন লাখ ৮২ হাজার লোক পঙ্গুত্ব বরণ করে। এর বিশাল অংশ নারী ও শিশু। তামাক ব্যবহারের বিশ্ব পরিস্থিতিও ভয়াবহ। প্রতি বছর ৫৪ লাখ লোকের প্রাণ কেড়ে নেয় তামাক। পৃথিবীতে বর্তমানে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১১০ কোটি।
বাংলাদেশে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন পাস হয় ২০০৫ সালে। আইনটি কার্যকর হয় ২০০৫ সালের ২৬ মার্চ থেকে। আইনের মাধ্যমে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়। আইন ভঙ্গ করলে অনধিক ৫০ টাকা অর্থদÐের বিধান রয়েছে। তবে বাস্তবে এ আইনের কার্যকারিতা খুব একটা চোখে পড়ে না। দেখা যায়, যারা প্রতিরোধ করবে বা জরিমানা করবে তাদের অনেকে ধূমপানে আসক্ত। ধূমপান ছেড়ে দিলে ধূমপায়ীর চেয়ে বেশিদিন বাঁচা যায়। ১০ বছর পরে যে মৃত্যু অবধারিত ছিল তা থেকে অনেক ক্ষেত্রে রক্ষা পাওয়া যায়। ধূমপানের ফলে ফুসফুসের ক্যানসার হলে ধূমপান বাদ দিলে মৃত্যুর আশঙ্কা ৩০-৫০ শতাংশ কমে যায়। ধূমপান ছাড়লে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হবার আশঙ্কা কমে। যত বেশি ধূমপান, তত বেশি ক্যান্সারের আশঙ্কা। যাদের শরীরে ইতিমধ্যে ক্যান্সার হয়েছে অথচ টের পায়নি, তারা ধূমপান ছেড়ে দিলে অন্য ধরণের ক্যান্সার থেকে বাঁচবে।
সাধারণ চিকিৎসক, দন্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ধূমপান ছাড়ার জন্য পরামর্শ দিতে পারে। নিকোটিনের পরিপূরক বিকল্প শুশ্রƒষা দিতে পারে। নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি নেবার পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি হতে পারে তা পূর্বে জানিয়ে দিতে পারে। ধূমপান ছাড়ার জন্য দিন ঠিক করে সংশ্লিষ্টদের সংকল্পবদ্ধ করতে পারে। কার ক্ষেত্রে নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি দরকার, আর কিভাবে নিকোটিন আসক্তি এড়ানো সম্ভব ব্যক্তি বিশেষে আলাদা আলাদা পরামর্শ দিতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন