এ যেন ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো এলাকা! চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীতে বেসরকারি মালিকানাধীন বিএম কন্টেইনার ডিপো এবং আশপাশের আড়াই বর্গকিলোমিটার এলাকার দৃশ্য তেমনই ভয়াবহ। পুরো এলাকাজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে ফায়ার সার্ভিসের নয় কর্মীসহ অর্ধশত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আগুনে দগ্ধ এবং আহত হয়েছেন আরো চার শতাধিক। নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাত ১১টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিশাল ডিপোতে আগুন জ¦লছিল। ডিপোতে বিভিন্ন কন্টেইনারে মজুদ থাকা বিপুল দাহ্য পদার্থ তথা কেমিক্যাল থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি আগুন নির্বাপণ ও উদ্ধার কাজে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ঘটনাস্থল এবং হাসপাতালগুলোতে স্বজনদের আহাজারি চলছে। প্রিয়জনের লাশের সন্ধানে দিগি¦দিক ছোটাছুটি করছেন অনেকে। আহতদের আর্তনাদ ও তাদের স্বজনদের কান্নায় ভারী হাসপাতালের বাতাস। ভয়ঙ্কর এমন দুর্ঘটনায় পুরো এলাকাজুড়ে বিভীষিকাময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক, নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। নিহতের সংখ্যা আরো বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শনিবার রাত ৮টার পর স্মার্ট গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিএম কন্টেইনার ডিপোর প্রবেশমুখে একটি কন্টেইনারে আগুনের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা আগুন নেভাতে ছুটে আসেন। ডিপোর কর্মীরাও তাদের সাথে যোগ দেন। স্থানীয়রাও ছুটে আসেন সাহায্য করতে। আগুন লাগার কিছুক্ষণ পর একটি কন্টেইনারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সেখানে থাকা ফায়ার সার্ভিস কর্মী, পুলিশ সদস্য, ডিপোর কর্মী, যানবাহন চালকসহ আগুন নেভাতে আসা সাধারণ মানুষ ছিটকে পড়েন। অনেকের শরীর খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর একের পর এক বিস্ফোরণের ঘটনায় ডিপোর আশপাশের কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। আশপাশের ঘরবাড়ির দরজা, জানালার কাচ ভেঙে পড়ে, উড়ে যায় টিনের চাল। রাতের আঁধারে ভয়াল পরিবেশে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। প্রথমে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ভূমিকম্প হয়েছে মনে করে লোকজন ঘর থেকে বের হয়ে আসে। এরপর একের পর এক প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয় সাগর তীরবর্তী পুরো জনপদ। এ সময় আতঙ্কে লোকজন দিগি¦দিক ছোটাছুটি শুরু করে। ঘরে ঘরে পড়ে যায় কান্নার রোল। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে নারী, শিশুসহ সাধারণ মানুষ। রাত যতই বাড়তে থাকে ততই বাড়তে থাকে বিস্ফোরণ। আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে পুরো এলাকা। কন্টেইনার থেকে ছড়িয়ে পড়া রাসায়নিকে দগ্ধ হয় পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ আশপাশের বাসিন্দারা। আগুনের তীব্রতায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা পিছু হটেন।
ততক্ষণে চট্টগ্রামের সবকটি ইউনিট থেকে ফায়ার সাভিস কর্মীরা সেখানে ছুটে যায়। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে পাশর্^বর্তী ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা থেকে ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন ইউনিট যোগ দেয়। রাতেই ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ করে। প্রথমে পানি সঙ্কট এবং পরে বিস্ফোরণের ভয়াবহতায় আগুন নেভানোর কাজ ব্যাহত হয়। রাসায়নিকসহ দাহ্য পদার্থ পুড়তে থাকায় পুরো এলাকায় গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ উদ্ধারকারীরা। আশপাশের বাসিন্দারাও গ্যাসআক্রান্ত হন। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছোটেন।
বিস্ফোরণে দগ্ধ এবং আহতদের এলাকায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। যানবাহন সঙ্কটের কারণে তাদের হাসপাতালে পৌঁছাতে দেরি হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের সব অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন যোগে আহতদের হাসপাতালে আনা হয়। রাত থেকে শুরু করে গতকাল দুপুর পর্যন্ত আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে আনতে দেখা যায়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে শত শত আহতদের আনা হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে রাতেই সকল চিকিৎসক ও নার্সকে হাসপাতালে ছুটে যেতে বলা হয়। বাতিল করা হয় স্বাস্থ্য খাতের সব ধরনের ছুটি। অগ্নিদগ্ধ এবং ছিটকে পড়ে আহতদের রক্তের প্রয়োজন দেখা দেয়।
প্রশাসনের আহ্বানে ছাত্র, যুবক থেকে শুরু করে স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠন রক্ত দিতে ছুটে যায়। র্যাব ও পুলিশ সদস্যরাও আহতদের রক্ত দেন। একসাথে এত বিপুল সংখ্যক দগ্ধ এবং আহত রোগী দেখেননি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা। সেখানে জরুরি বিভাগে দুই শতাধিক মানুষকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। গুরুতর আহত ১৮২ জনকে ভর্তি করা হয় বিভিন্ন ওয়ার্ডে। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, আহতদের বেশিরভাগই রাসায়নিক আগুনে দগ্ধ। বাকিরা বিস্ফোরণে ছিটকে পড়ে আহত হয়েছেন। অনেকের হাত-পাত ভেঙে গেছে। কারো মাথা ফেটে গেছে।
হাসপাতালে বেড সংকুলান না হওয়ায় বারান্দা, মেঝেতে রেখে রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। গুরুতর আহত তিন ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ ছয়জনকে ঢাকায় শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারী ইউনিটে প্রেরণ করা হয়। চমেক হাসপাতালের পাশাপাশি নগরীর পাঁচলাইশের পার্কভিউসহ বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আহতদের ভর্তি করা হয়। রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতাল কর্মীদের। রাতেই হাসপাতালে চারজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ভোর হওয়ার পর ডিপোর অভ্যন্তর থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একের পর এক লাশ উদ্ধার করা হয়।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে ১৩ জনের লাশ। বেশিরভাগ লাশের চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছেন অনেকে। তাদের পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। ঘটনাস্থল এবং হাসপাতালে নিখোঁজদের সন্ধানে তাদের স্বজনদের ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। হাসপাতালের মর্গে অসংখ্য মানুষের আহাজারি। নিখোঁজ স্বামীর খোঁজে স্ত্রী, পিতার খোঁজে সন্তান, ভাইয়ের খোঁজে ভাই, উ™£ান্তের মত ছুটছিলেন হাসপাতাল থেকে মর্গে। তাদের বুকফাটা আর্তনাদ আর আহাজারিতে ভারি হাসপাতালের বাতাস।
শনিবার রাতে লাগা আগুন গতকাল দিনভর জ¦লতে থাকে। কন্টেইনারগুলোতে রাসায়নিকের মজুদ থাকায় থেমে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। স্থানীয়রা জানান, রাতে আগুন লাগার পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রফতানি পণ্যবোঝাই কয়েকশ’ কাভার্ডভ্যান সেখান থেকে বের করে নেয়া হয়। তবে কন্টেইনার ভর্তি আমদানি-রফতানি পণ্য সরানো যায়নি। অগ্নিকাণ্ডের পর ডিপোর কর্মকর্তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, ডিপোর লোকজন না থাকায় কোন এলাকায় রাসায়নিক বোঝাই কন্টেইনার রয়েছে তা বোঝা যাচ্ছিল না। আর এ কারণে আগুন নেভাতেও বেগ পেতে হচ্ছিল।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মইন উদ্দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তারা ডিপো কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, ডিপোতে অরক্ষিত অবস্থায় বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেনর পার-অক্সাইড থাকায় একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটেছে। আর তাতে আগুনের ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। ডিপোতে কী পরিমাণ আমদানি-রফতানি পণ্য ছিল তার সঠিক কোন হিসাব কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে জানানো হয়নি।
তবে বেসরকারি ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডার সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন সিকদার ইনকিলাবকে জানান, ছয় হাজার টিইইউএস কন্টেইনার ধারণক্ষমতার ওই ডিপোতে আটশ’ আমদানি পণ্যবাহী এবং রফতানি পণ্যবাহী পাঁচশ’ কন্টেইনার ছিল। খালি কন্টেইনারের সংখ্যা ছিল তিন হাজার। দুর্ঘটনার পর থেকে ডিপো এলাকায় মালিকপক্ষের কাউকে দেখা না গেলেও এক ভিডিওবার্তায় দুর্ঘটনায় হতাহতদের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানানো হয়। নিহতদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যয় বহন করার ঘোষণা দেন ডিপো মালিক। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন পৃথক পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন