চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুনে খুলনা, যশোর, চাঁদপুর, রাঙামাটি, শেরপুর, ভোলা ও ফেনী জেলার ফায়ার সার্ভিসের কর্মী, এক কম্পউিটার অপারেটর ও বিএম কনটেইনার ডিপোর এক কর্মকর্তা নিহত হন। আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যে এ প্রতিবেদন।
খুলনা ব্যুরো জানায়, শেষ ইচ্ছা পূরণ হলো না ফায়ার ফাইটার শাকিল তরফদারের। ইচ্ছে ছিল আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল হলে মাকে নিয়ে হজ্বে যাবেন। কুরবানীর ঈদে মায়ের জন্য নতুন শাড়ি, বাবার জন্য পাঞ্জাবী, লুঙ্গি কেনা আর হলো না। গত শনিবার রাত ৯টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অর্গ্নি নির্বাপনের সময় নিহত হন খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সুখদাড়া গ্রামের শাকিল তরফদার। নিহত ফায়ার সার্ভিস কর্মী শাকিল তরফদারের জানাজা ও দাফন নিজ বাড়ি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সুখদাঁড়া গ্রামে গতকাল মঙ্গলবার সম্পন্ন হয়েছে।
এদিকে শাকিল তরফদারের মৃত্যুতে মা জেসমিন বেগম, বাবা আব্দুস সাত্তার তরফদার বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। খানিক পর, পর মা আর্তচিৎকার করে কেদে উঠছেন, বলছেন ‘তোমরা আমার সোনারে ফিরায় দাও’। বাবা আব্দুস সাত্তার তরফদার বললেন, ‘শাকিল তার মাকে হজ্ব করতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আগামী ঈদুল আযহায় তার গ্রামের বাড়িতে আসার কথা ছিল। শাকিলকে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গা ভরাট করে পাকা বাড়ি করতে চেয়েছিল। সব শেষ হয়ে গেলো।’ শাকিলের ভাই ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত মো. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, আগুন নেভাতে যাওয়ার আগে শাকিল শেষবার মাকে ফোন করেছিল। এ সময় সে দোয়া চেয়েছিল।
যশোর ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে নিহত ইব্রাহিমের লাশবাহী গাড়ির সাদা গ্লাসের উপর হাত দিয়ে ছেলের লাশের মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন মা দুলাপি বেগম। আর কান্নাকণ্ঠে বলছিলেন, আল্লাহ আমাকে কি পরীক্ষায় ফেললেন। গত সোমবার জানাজা শেষে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার নরসিংহপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
এদিকে জীবন সঙ্গীকে হারিয়ে নয় মাসের অন্তঃসত্বা স্ত্রী মুন্নি খাতুন যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। স্ত্রী মুন্নী খাতুন জানান, আমার অনাগত সন্তানকে কে দেখবে। এই জীবন রেখে কি লাভ। পাশেই বসা মুন্নীর বড়বোন রেহেনা খাতুন বলেন, মুন্নী নয় মাসের অন্তঃসত্বা। আগামী ২৮ জুলাই সন্তান ভূমিষ্ঠের সম্ভাব্য দিন। গত শনিবার রাত ৯টায় মুন্নীসহ তার মায়ের সাথে শেষ কথা হয় নিহত ইব্রাহিমের। কোরবানির ঈদে বাড়ি এসে সন্তানের মুখ দেখবে জানিয়ে ছিল। ছেলে হলে হাফেজ বানাতে চেয়েছিল ইব্রাহিম।
ইব্রাহিম প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের এক্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টের শিপিং সহকারী পদে চাকরি করতেন। একই প্রতিষ্ঠানের অন্য শাখায় কাজ করেন তার খালাতো ভাই নাজমুল হোসেন। তিনি বলেন, ৪ জুন রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে ইব্রাহিম আগুনে দগ্ধ হয়। তার মাথার পেছনে ও পেটে আঘাত ও আগুন লাগে। মুখ, টি-শার্ট ও মোবাইল ফোন দেখে তাকে শনাক্ত করি। উদ্ধারের সময় তার ফোনটি সচল ছিল।
স্টাফ রিপোর্টার, চাঁদপুর থেকে জানান, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ফায়ার সার্ভিসকর্মী ফায়ারম্যান লিডার ইমরান হোসেন মজুমদারের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে নিহতের নিজ বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার সিংআড্ডা গ্রামে জানাজা শেষে দাফন করা হয়।
জানাজার আগে চাঁদপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের উপ-সহকারী পরিচালক সাহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। জানাজায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ হাজারো মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে কর্মরত ফায়ারম্যান লিডার ইমরান হোসেন মজুমদার উদ্ধারকাজে গিয়ে কনটেইনার বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত হন। পরে পরিবারের লোকজন সেখানে গেলেও লাশ শনাক্ত করতে না পারায় লাশ ফিরিয়ে আনতে পারেননি। তবে সোমবার ডিএনএ পরীক্ষা শেষে রাতেই ফায়ার সার্ভিসের ইন্সপেক্টর জসীম উদ্দীনের তত্ত্বাবধানে লাশ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন নিহতের পরিবারের সদস্যরা।
স্টাফ রিপোর্টার, রাঙামাটি থেকে জানান, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ডিপোতে লাগা ভয়াবহ আগুন নেভাতে গিয়ে কন্টেইনার বিস্ফোরণে নিহত রাঙামাটির দুই অগ্নিযোদ্ধার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। নিহত মিঠুন দেওয়ান চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে এবং নিপন চাকমা সীতাকুণ্ডের কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে কর্মরত ছিলেন।
গত সোমবার দুপুরে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী নিপনকে রাঙামাটির আসামবস্তি শ্মশানে এবং মিঠুনকে রাঙাপানি শ্মশানে দাহ করা হয়। এর আগে শহীদ দুই অগ্নিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দিয়েছেন রাঙামাটি ফায়ার স্টেশনের সদস্যরা। শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান।
রাঙামাটি ফায়ার স্টেশনের সহকারী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম শেষকৃত্যের জন্য ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে উভয়ের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে সহায়তা তুলে দেন। এছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরও ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। রাঙামাটি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, এ পেশাটাই এমন চ্যালেঞ্জের। সব সময় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় আমাদের। কন্টেইনার দাহ্য পদার্থ ছিল এমনটা জানা থাকলে হয়তো এত প্রাণহানি ঘটত না।
শেরপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন সম্পন্ন হয়েছে ফায়ার ফাইটার রমজানুল ইসলাম রনির। জানাজায় রনির আত্মীয় স্বজনসহ স্থানীয় সহস্রাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় তার নিজ গ্রাম শেরপুর সদরের হেরুয়া বালুরঘাট এলাকায় জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।
এর আগে গতকাল সকাল সাড়ে ৬টায় রনির লাশ এসে পৌঁছে তার নিজ এলাকায়। এসময় শেরপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কর্মকর্তারা তাকে গার্ড অব অনার ও শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। এরপর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
ফেনী জেলা সংবাদদাতা জানান, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুনের ঘটনায় মোহাম্মদ ইয়াছিন নামে ডিপোর এক কর্মকর্তা নিখোঁজ রয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে তার ব্যবহৃত মুঠোফোন বন্ধ আছে। দুর্ঘটনার পর ডিপো এলাকা, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে ইয়াছিনের কোনো সন্ধান পায়নি তার পরিবার।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে নিখোঁজ ছেলের সন্ধানে অপেক্ষা করছেন বাবা বদিউল আলম। হাসপাতাল প্রাঙ্গণেই ছেলের অপেক্ষায় দিন কাটছে তার। ১০ বছর আগে ইয়াছিন ডিপোতে গাড়িচালকের সহকারী হিসেবে যোগ দেন। এরপর ধীরে ধীরে তিনি বিএম কনটেইনার ডিপোর পরিচালক হয়ে ওঠেন। গত শনিবার রাতে আগুন লাগার সময় তিনি ওই ডিপোতেই ছিলেন।
ভোলা জেলা সংবাদদাতা জানান, সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ডে নিহত কম্পিউটার অপারেটর হাবিবুরের লাশ গত সোমবার সকাল ৯টায় দাফন সম্পন্ন হয়েছে তার গ্রামের বাড়ি ভোলায়।
তার মায়ের সাথে মৃত্যুর পূর্বে সকালেও ফোনে কথা কইছি হাবিবের সাথে। হাবিব জিগাইছে মাগো কি খাইছো নাস্তা করছো, কি করো ইত্যাদি? এভাবেই অশ্রুচোখে ও বুকফাটা আহাজারির সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রামের নিহত কম্পিউটার অপারেটর হাবিবুর রহমানের মা হোসনে আরা বেগম।
নিহত হাবিবুর রহমান ভোলা সদর উপজেলার দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়ন ২ নং ওয়ার্ড দক্ষিণ বালিয়া বটতলা গ্রামের হরাজি বাড়ির মো. সিদ্দিক বেপারির মেয়ের ঘরের নাতি। হাবিবুরের বাবা শাহাবুদ্দিন পটুয়াখালীর বাসিন্দা ছিলেন। ছোট বেলায় বাবার মৃত্যু পর মায়ের সঙ্গে থাকতেন নানার বাড়িতে।
হাবিবুরের মামা মো. আলমগীর বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেলের মর্গ থেকে ময়নাতদন্ত শেষে হাবিবুরের লাশ তাদের কাছে হস্তান্তরেরর পর ভোলায় পৌঁছায়। হাবিবুরের লাশ সোমবার সকাল ৯টায় জানাজা শেষে তার গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।
ফেনী জেলা সংবাদদাতা জানান, অবশেষে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজ ফায়ারম্যান সালাউদ্দিন সবুজের লাশ শনাক্ত হয়েছে। এর আগে গত শনিবা রাত থেকে তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোনটিও বন্ধ ছিল। লাশ পাওয়ার খবরে তার পরিবারও পুরো এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। সালাউদ্দিন সবুজ ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের মাছিমপুর গ্রামের হাজী অছিম উদ্দিন ভূইয়া বাড়ির বাসিন্দা। ৬ বছর আগে সবুজ বিয়ে করেন। তার সাড়ে ৪ বছরের এক মেয়ে ও দেড় বছর বয়সী এক ছেলে রয়েছে।
গত সোমবার দুপুরে লাশের ডিএনএ পরীক্ষার পর সবুজের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের অফিসের সামনে সবুজের প্রথম জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। তারপর লাশ ফেনীর মাছিমপুর গ্রামের বাড়িতে নেওয়ার পর সেখানে রাত ১০টায় দ্বিতীয় জানাযা শেষে পারিবারিক কবরাস্থানে দাফন করা হয়।
চাটখিল (নোয়াখালী) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হওয়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ফায়ারম্যান মো. আলাউদ্দিনের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন সম্পন্ন হয়েছে। সে উপজেলার বানসা গ্রামের বড় মুন্সী বাড়ির সাবেক মেম্বার আব্দুর রশিদের ছেলে আলাউদ্দিন। গত সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় বানসা গ্রামের বড় মুন্সি বাড়িতে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে, সকাল সোয়া ৯টায় স্থানীয় কামাল পুর মোহাম্মদ হাশেম উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার আগে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের জেলা ও উপজেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বারগণসহ গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন