শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বিদ্যুতের দামে পিঠ ঠেকবে দেয়ালে

মো. জাহিদুল ইসলাম : | প্রকাশের সময় : ১৩ জুন, ২০২২, ১২:০১ এএম

নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। চাল, ডাল, তেল, আটা, ময়দাসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। ঠিক সে সময়ই বেড়েছে গ্যাসের দাম। আর এই গ্যাসের দাম বৃদ্ধির মাঝেই বিদ্যুৎতের দাম বাড়ানোর বিষয়টি স্পষ্ট করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে এ মুহুর্তে বিইআরসির দাম বাড়ানো ঠিক হবে না বলে মত বিশ্লেষকদের। সেই সঙ্গে এমন সিদ্ধান্ত নিলে সাধারণ মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে বলে মনে করেন তারা।

গত ৫ জুন আবাসিক খাতে গ্যাসের দুই চুলার দাম ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৮০ টাকা করা হয়েছে। আর এক চুলার দাম ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের বর্তমান দর ১২ দশমিক ৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা করেছে কমিশন। চলতি মাস থেকেই নতুন এই দর কার্যকর হবে।

এছাড়াও অন্যান্য গ্রাহকশ্রেণি যথা: বিদ্যুৎ (সরকারি, আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র); ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ (ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট, স্মল পাওয়ার প্ল্যান্ট ও বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র); সার; শিল্প; চা-শিল্প (চা-বাগান); বাণিজ্যিক (হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য) এবং সিএনজির ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটারে (মাসিক অনুমোদিত লোডের বিপরীতে) শূন্য দশমিক ১০ টাকা হারে ডিমান্ড চার্জ প্রযোজ্য হবে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎতে প্রতি ঘনমিটার ৫ দশমিক ২ টাকা, ক্যাপটিভ ও সার কারখানায় ১৬ টাকা, শিল্পকারখানায় ১১ দশমিক ৯৮ টাকা, মাঝারি শিল্পে ১১ দশমিক ৭৮ টাকা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১০ দশমিক ৭৮ টাকা, চা শিল্পে ১১ দশমিক ৯৩ টাকা, বাণিজ্যিক ২৬ দশমিক ৬৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে অপরিবর্তিত রয়েছে ফিড গ্যাস সিএনজির দাম, ৪৩ টাকা।

দরবৃদ্ধির ঘোষণায় বিইআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবু ফারুক বলেন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩ এর ধারা ২২(খ) ও ৩৪ এ প্রদত্ত দায়িত্ব ও ক্ষমতাবলে গ্যাস কোম্পানিগুলোর আবেদনের ভিত্তিতে গণশুনানি করা হয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যহার পুনঃনির্ধারণের প্রস্তাব সংবলিত আবেদনের বিষয়ে আগ্রহী পক্ষগণকে শুনানি প্রদানপূর্বক সকল তথ্যাদি পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণান্তে ওই লাইসেন্সসমূহ কর্তৃক ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের নতুন এই মূল্যহার পুনঃনির্ধারণ করা হলো।
তিনি আরও জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম বাড়ায় বিদ্যুৎতের দামও বাড়বে। তবে সেটি কত ভাগ বাড়বে তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় থাকাতে ভর্তুকির পরিমাণ দিন দিন বাড়াতে হচ্ছে।

এদিকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে গণশুনানির সিদ্ধান্ত আসার আগেই বিদ্যুৎতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এ প্রস্তাব জানিয়েছে তারা। এনিয়ে ১৮ মে গণশুনানিও করেছে বিইআরসি। বিপিডিবির প্রস্তাব-সরকার ভর্তুকি না দিলে পাইকারি মূল্যে প্রতি ইউনিটে ২ টাকা ৯৯ পয়সা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য দাঁড়াবে ৮ টাকা ১৬ পয়সায়। তবে এই খাতে সরকার ভর্তুকি দিলে দাম অপরিবর্তিত (প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ১৭ পয়সা) থাকবে। বিপিডিবির মতে-গ্যাসের বর্তমান দাম বিবেচনায় বিদ্যুৎতের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি হলে ৯ টাকা ১৪ পয়সা প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া ১২৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলে ৯ টাকা ২৭ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে গতবারের চেয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা কম বরাদ্দ রাখা ও বিইআরসি চেয়ারম্যানের বক্তব্যে অনেকটা স্পষ্ট করেই বলা যায় বিদ্যুৎতের দাম বাড়ছে। এখন সেটা দিন ক্ষণের অপেক্ষা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে বিদ্যুৎতের দাম বাড়ালে জনগণের ওপর ভয়াবহভাবে এর প্রভাব পড়বে। সাধারণ ও মধ্যবিত্তের জীবন হয়ে উঠবে দুর্বিষহ।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, এই মুহূর্তে বিদ্যুৎতের দাম বাড়ানো কিছুতেই ঠিক হবে না। সরকারের হাতে অনেক বিকল্প আছে। সরকার সেগুলা কাজে লাগাতে পারে। যদি এখন বিদ্যুৎতের দাম বাড়ায় তবে এর ভয়ানক প্রভাব পড়বে। এতে মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। গ্যাস বিদ্যুৎ ছাড়া তো মানুষ চলতে পারবে না। এজন্য গ্যাস বিদ্যুৎতের ব্যয় যোগান দিতে গিয়ে যার প্রভাব খাদ্যের ওপর পড়বে। খাদ্যে ব্যয় কমিয়ে দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎতের দাম বাড়লে এগুলোর প্রভাব অন্য জিনিসের ওপরও পড়বে। সবমিলে চাপটা সাধারণ মানুষেরই ওপর পড়বে বেশি।
এ প্রসঙ্গে ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশের (এফইআরবি) ভাইস চেয়ারম্যান সেরাজুল ইসলাম সিরাজ বলেন, আমি অনুরোধ করবো সরকার যেন বিদ্যুৎতের দাম না বাড়ায়। না বাড়ানোর পেছনে আমার যুক্তি হচ্ছে বিদ্যুৎতের দাম বাড়লে অনেক রকম প্রভাব পড়তে পারে। যার মধ্যে একটা হচ্ছে শহরাঞ্চলে অনেক বাসা আছে যেখানে মানুষ ভাড়া থাকে অনেকেই দুই তিনজন মিলে একটা মিটার ব্যবহার করে। সেখানে বাড়িওয়ালা তাদের কাছ থেকে ইউনিট হিসেবে একটা বিল নির্ধারণ করে দেয় সে হিসেবে বিল নেয়। এখন ধরুন বিদ্যুৎ বিল যদি এক হাজার টাকাও বাড়ে বাড়িওয়ালা তিন জনের কাছে তিনশত টাকা বেশি নেবে। যেখানে ভাড়াটিয়াদের কিছু করার থাকে না। শিল্প খাতে তো একটা বড় প্রভাব আছেই।

তিনি আরও বলেন, বিদ্যুতের ভোক্তা কিন্তু দেশের প্রত্যেকটা মানুষ। তার মানে বিদ্যুৎতের দাম বাড়ালে ১৬-১৭ কোটি মানুষের উপর এর প্রভাব পড়তেছে। সরকারের কাজ হচ্ছে জনগণের কল্যাণ করা। সরকারের হাতে অনেক বিকল্প আছে। সরকার চাইলে অন্য জায়গা থেকে ব্যবস্থা করতে পারে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎতের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই উল্লেখ করে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল কাঁচামাল গ্যাস, তেল, কয়লা। সবাই জানে, বিশ্ববাজারে এসব জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে এবং সেই আলোকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ইতোমধ্যে গ্যাসের মূল্য বাড়িয়েছে। কাঁচামালের মূল্য বাড়লে ফিনিশড প্রোডাক্টের মূল্য তো বাড়বেই। গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উপাদন করা হয়, গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় কমপক্ষে সেই অনুপাতে বিদ্যুৎতের দাম বাড়বে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে কয়লার দামও বেড়েছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় গত ২ বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। উৎপাদন ব্যয়কে সমন্বয় করতে হলে এর বিক্রয়মূল্য সমন্বয় করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎতের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই।

উল্লেখ্য, প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জন্য ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলতি বছরে (২০২১-২০২২) ছিল ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা কম পাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন