রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

নিজ দেশে পরবাসী রোহিঙ্গাদের করুণ কাহিনী

ড. এম এ সবুর | প্রকাশের সময় : ২৪ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন (আরাকান) প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন অব্যাহত আছে। সম্প্রতি দেশটির উত্তরাঞ্চল মংডুতে শতাধিক মুসলিমকে আগুনে পুড়ে এবং গুলি করে মারার খবর প্রকাশ পেয়েছে। চলতি বছরের ৯ অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, সীমান্ত রক্ষীবাহিনী, পুলিশ ও উগ্রবাদী বৌদ্ধরা এ হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। এ সময় তারা অনেক গ্রামের শত শত বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়েছে। অধিকন্তু আক্রান্ত অঞ্চলে মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও এনজিও কর্মীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে ফেইসবুক, টুইটারে পাঠানো নারকীয় হত্যা-ধ্বসযজ্ঞের কিছু ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। ২০১২ সালেও দেশটির রাখাইন বৌদ্ধরা মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালিয়ে প্রায় এক হাজার মুসলিমকে হত্যা করেছে। এ সময়ও তারা রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত কয়েকটি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। গত বছরেও নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গা মুসলিমকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। এছাড়া তারা অনেক নারী-শিশুকে পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে। সাম্প্রতিক এ নারকীয় হত্যা-ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লক্ষাধিক ব্যক্তি অনলাইনের মাধ্যমে মিয়ানমারের পররাষ্টমন্ত্রী ও এনএলডি‘র সভানেত্রী অং সান সু চি‘কে দেওয়া নোবেল শান্তি পুরস্কার ফেরৎ নেয়ার আবেদন করেছেন।
মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যের মুসলিম নিধন ও বিতাড়ন অভিযান নতুন নয়। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর হতেই বার্মিজ সরকার রাখাইন (আরাকান) রাজ্য থেকে মুসলিম বিতাড়ন অভিযান শুরু করেছে। এতে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকাসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছেন। আর মিয়ানমার সরকার কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়ে নিজভূমে পরবাসী করেছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমরা বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত-নিগৃহীত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। জাতিসংঘ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাধ্যতামূলকভাবে শ্রমে নিয়োজিত, চলাফেরার স্বাধীনতা হরণ, ভূমি অধিকার, শিক্ষা ও সরকারি চাকরি হতে বঞ্চিতসহ বিভিন্ন বিষয়ে বৈষম্য করছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে ।
রোহিঙ্গা মুসলামানদের বেশির ভাগ বাস করেন রাখাইন রাজ্যে। কিন্তু তাদেরকে নাগরিক বলে স্বীকার করে না সে দেশের সরকার। ফলে যাবতীয় নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় রোহিঙ্গা মুসলিমরা। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য কোন বিষয়েই সরকার কোন দায়িত্ব পালন করে না। অধিকন্তু তাদেরকে বিতাড়ন করে রাখাইন প্রদেশকে বৌদ্ধ অধ্যুষিত রাজ্যে পরিণত করতে মিয়ানমার সরকার রাখাইন বৌদ্ধদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। অথচ রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলিমদের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস-ঐতিহ্য, নিজস্ব সংস্কৃতি-ভাষা ও ধর্মীয় আদর্শ। তারা আরাকান রাজ্যের আদি জনগোষ্ঠী হিসেবেও পরিচিত। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়ায় তারা নিজ ভূম হতে বিতাড়িত! তাদের অনেকেই বাধ্য হয়ে শরণার্থী হিসেবে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছেন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সৌদী আরব, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালেশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
রোহিঙ্গা মুসলিমগণ আরাকানের প্রাচীন অধিবাসী। আরাকানের পূর্ব নাম ‘রোসাং’ বা ‘রোসাঙ্গ দেশ’। রোসাং বা রোসাঙ্গ শব্দের বিকৃতি উচ্চারণ আধুনিক ‘রোহিঙ্গা’। রোসাং বা আরাকান সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়ায় পূর্বকাল থেকেই বর্হিদেশের সাথে দেশটির ভালো যোগাযোগ ছিল। আরব ব্যবসায়ীরা প্রাচীনকাল থেকেই জলপথে রোসাঙ্গে যাতায়াত করতেন। এতে আরবদের সাথে তাদের ব্যবসায়িক লেন-দেনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সম্পর্কও স্থাপিত হয়। এতে ‘রোসাং’ অধিবাসীরা আরব ব্যবসায়িদের সংস্কৃতিতে প্রভাবিত হয় এবং ইসলামের সাম্য-সৌহার্র্দ্যে আকৃষ্ট হয়ে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এতে আরাকানে ধর্মান্তরিত মুসলিমের সংখ্যা বেড়ে যায়। লোককাহিনী থেকে জানা যায় খ্রিস্টীয় অস্টম শতকের মাঝামাঝিতে মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া নামক এক আরব মুসলিম সেনাপতি বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে রোসাঙ্গে আসেন এবং সে দেশের রাণী কৈয়াপুইকে বিয়ে করেন। পরে তিনি সৈন্য-সামন্ত নিয়ে রোসাঙ্গেই বসবাস করেন। তিনি যে পাহাড়ে বাস করতেন আজও তা ‘হানাফিয়া টঙ্কি’ এবং  কৈয়াপুই টঙ্কি’ নামে পরিচিত।
ইতিহাস থেকে জানা যায় খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের শুরুতে বর্মিজ রাজা আরাকানে আক্রমণ করেন। আক্রান্ত আরাকান রাজা প্রতিবেশী চট্টগ্রামের রাজার মাধ্যমে তৎকালীন গৌড়েশ্বর সুলতান জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। গৌড়ের সুলতান আরাকান রাজাকে সহযোগিতা করতে হাজার হাজার সৈন্য প্রেরণ করেন। এতে বর্মিজ রাজা পিছু হটতে বাধ্য হন এবং আরাকান রাজা পুণরায় ক্ষমতায় বসেন। আরাকান রাজা তার ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করতে গৌড়ের মুসলিম সৈন্যদের নিজ রাজ্যে বসবাসের সুযোগ দেন। এতে অনেক সৈনিক সেখানে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এভাবে আরাকানের মুসলিম সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। এতে আরাকান রাজশক্তির সাথে প্রতিবেশি চটিগাঁ ও বঙ্গদেশের সুসম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং উভয় দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্কেরও উন্নতি হয়। এজন্য তৎকালীন বাঙালি কবি আলাওল, দৌলত কাজি, মীর মরদান, আইনুদ্দিন প্রমুখ মুসলিম কবিকে আরাকান রাজদরবারের সভাকবি নিয়োগ দেয়া হয়।
১৭৮৪ সালের আগে আরাকান রাজ্য বার্মা বা ভারতের অর্ন্তভুক্ত ছিল না। ১৭৮৪ সালে বার্মিজরা আরাকান রাজ্যটি দখল করে হাজার হাজার আরাকানিকে হত্যা করে। এ সময় তারা আরাকানের অনেক মসজিদ-মন্দিরও ধ্বংস করে। বার্মিজদের অত্যাচারে তখন প্রায় দুই লক্ষ আরাকানবাসী চট্টগ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করে। এরপর তারা ১৮২৪ সাল পর্যন্ত বার্মিজ শাসন বজায় রাখে। এ সময় বৃটিশরা ভারত পেরিয়ে বার্মায় আগ্রাসন চালায়। ফলে ১৮২৪-১৮২৬ খ্রি. পর্যন্ত বৃটিশদের সাথে বার্মিজদের যুদ্ধ চলে। ইতিহাসে এ যুদ্ধকে প্রথম আ্যংলো-বার্মিজ যুদ্ধ বলা হয়। এ যুদ্ধে বার্মিজরা পরাজিত হলে ১৮২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ট্রিটি অব ইয়ান্দারো’ চুক্তির মাধ্যমে আরাকান রাজ্যটি বৃটিশ-ভারতের অর্ন্তভুক্ত হয়। আবার ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল বার্মাকে বৃটিশ-ভারত থেকে আলাদা করা হয়। এ সময় আরাকানের জনগণ রাজ্যটির স্বায়ত্বশাসন চায়। কিন্তু জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আরাকানকে বার্মার অর্ন্তভুক্ত করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪২ সালে আরাকানে রাখাইন বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলিমের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। এতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হাজার হাজার মুসলিম রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। আর  প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম আরাকান ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ সময় রাখাইন বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রায় তিন‘শ গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এতে হাজার হাজার আরাকানী মুসলিম রোহিঙ্গা বাস্তুহারায় পরিণত হয়। বৃটিশ থেকে বার্মার স্বাধীনতা লাভকালে ১৯৪৮ সালে রোহিঙ্গা মুসলিমরা স্বাধীন আরাকানের দাবিতে এক ব্যর্থ সশস্ত্র বিদ্রোহ করে। এতে তৎকালীন বার্মিজ সরকার মুসলমানদের উপর চরম নির্যাতন-নিপীড়ন চালায় এবং অনেক মুসলিমের ভূ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। আর তাদের চলাফেরা, শিক্ষা-সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয় । এরপর ১৯৬২ সালে জেনারেল নে-উইনের সামরিক সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের অবৈধ অভিবাসী আখ্যাত করে তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়নের চেষ্টা করে। আবার ১৯৭৪ সালে ‘ইর্মাজেন্সি ইমিগ্রেসন অ্যাক্ট’ করে বার্মা সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের জাতীয়তা কেড়ে নেয়। এরপর ১৯৮২ সালে ‘বার্মা সিটিজেনশিপ ল’ এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত রোহিঙ্গা মুসলিমদের বেশ কিছু মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নেয় বার্মা সরকার। ১৯৮৯ সালে বার্মার সরকার আরাকান রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর জাতীয়তাভিত্তিক ‘রাখাইন’ রাজ্য নামকরণ করে। এতে রোহিঙ্গা মুসলিম জাতিসত্তা মুছে দিয়ে রাখাইন বৌদ্ধ জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে। এভাবে বৃটিশ-বার্মায়, স্বাধীন বার্মায় ও আধুনিক মিয়ানমারে দীর্ঘ কয়েক দশক যাবৎ আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিজ দেশে পরবাসীতে পরিণত করা হয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে জোর করে বৌদ্ধ ধর্ম পালনে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ আছে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে। মুসলিম স্থাপনাসমূহ রাখাইন বৌদ্ধরা দখল করে নিচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে দিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে সামরিক স্থাপনা, সেতু, প্যাগোডা, স্কুল, কলেজ হাসপাতাল নির্মাণ এবং পুকুর খননের কাজ করায়। রোহিঙ্গা মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে সরকার বিভিন্ন শর্ত  ও করারোপ করে থাকে। অনেক মুসলিম মহিলা-তরুণী রাখাইন বৌদ্ধদের ধর্ষণের শিকার হয়।
প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, সীমান্ত রক্ষীবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় বৌদ্ধদের আক্রমণে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। সেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমরা চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে। অধিকাংশ মুসলিমের জীবনের নিরাপত্তা নাই। তারা চরম নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্যে অসহায় জীবনযাপন করছে। এহেন অবস্থায় জাতিসংঘ, ওআইসি, আসিয়ানসহ বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংস্থা ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে এগিয়ে আসতে হবে। রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গা মুসলিম বিতাড়ন ও নিধন অভিযান হতে মিয়ানমার সরকারকে বিরত রাখতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ফিরিয়ে দিতে হবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের মৌলিক অধিকার। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী ও মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারে।
য় লেখক : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আহ্বায়ক, ডক্টরস এসোসিয়েশন অব নন-গভর্নমেন্ট টিচার্স (ড্যাঙ্গট)
ফসধংড়নঁৎ০৯@মসধরষ.পড়স    

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন