বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

গার্মেন্টসে সম্ভাবনাময় দক্ষিণ-পশ্চিম

পদ্মা সেতুর সুবাদে খুলে গেছে স্বপ্ন পূরণের বহুমুখী দুয়ার পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বিশাল অর্থনৈতিক করিডোরে পরিণত হতে চলেছে : অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৩০ জুন, ২০২২, ১২:০১ এএম

দেশের ভৌগোলিক এলাকাওয়ারি সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের সমবন্টন ও সমভাবে বিকাশ প্রয়োজন। রফতানিমুখী প্রধান সেক্টর গার্মেন্টস শিল্পখাতের বেশিরভাগ কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বৃহত্তর ঢাকা, শহরতলী বা এর আশপাশ, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে। শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা আটকে আছে একই গণ্ডিতে। ১৯৭৭ সালে কালুরঘাটে ‘দেশ গার্মেন্টস’র হাত ধরেই চট্টগ্রামে রফতানিমুখী গার্মেন্টসের জন্ম। গার্মেন্টস শিল্প খাতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে। মধ্যম সারির ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত এবং প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব রয়ে গেছে।

সুলভে দক্ষ শ্রমিক স্বল্পতা নিরসনে গার্মেন্টস শিল্পের সুষম ভৌগোলিক বিস্তারের জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। বর্তমান ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও বিশেষ করে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে গার্মেন্টস কারখানা স্থাপন এবং এ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধার সমন্বয়ে উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। এসব সুপারিশ করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক খ্যাতনামা গ্লোবাল ম্যানেজম্যান্ট কনসালটিং প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানি’ এবং আন্তর্জাতিক অপর এক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নিয়েলসেন কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড’ পরিচালিত জরিপ প্রতিবেদনে।

এদিকে গত ২৫ জুন কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নের বাস্তব রূপায়নের মধ্যদিয়ে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সুবাদে খুলে গেছে শত স্বপ্ন পূরণের বহুমুখী ও নতুন দুয়ার। গার্মেন্টসহ দেশের বিভিন্ন শিল্প, কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং এর সুষম ভৌগোলিক বিস্তারের প্রয়োজনে সেই ‘ম্যাককিনসে’ ও ‘নিয়েলসেন’ জরিপ প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য এসেছে মহাসুযোগ। পদ্মা সেতুর সুবাদে দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম ও পশ্চিমাঞ্চলের অন্ততপক্ষে ১৯টি জেলা, প্রকারান্তরে বা পরোক্ষভাবে মোট ২৯টি জেলা বিভিন্নভাবে সুফল ও লাভবান হতে যাচ্ছে। এসব জেলা-উপজেলার সঙ্গে রাজধানীসহ দেশের মূল অংশের সরাসরি বৈপ্লবিক ও যুগান্তকারী যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। তুলনামূলক বেশি পিছিয়ে থাকা জেলা-উপজেলা-জনপদসমূহের আপামর জনসাধারণের ভাগ্য বদলে দিতে পারে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এখন প্রয়োজন সম্ভাবনার পরিকল্পিত ও সময়োচিত সদ্ব্যবহার।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিম ও পশ্চিমাঞ্চলকে দেশের মূল অংশের সাথে এক সূত্রে গেঁথেছে। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে এর সুবাদে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বিশাল অর্থনৈতিক করিডোরে পরিণত হতে চলেছে। পদ্মা সেতুর উভয় পাড় দিয়ে ভাঙ্গা, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, পটুয়াখালী, যশোর, চুয়াডাঙ্গাসহ বিশাল অঞ্চলজুড়ে শিল্প প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা গড়ে উঠবে। বিশেষ করে এ অঞ্চলে মজুরি কম থাকার সুবাদে গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানার প্রসার ঘটবে। এসব জেলা থেকে অত্যন্ত সহজে ও কম সময়ে পণ্য রফতানির জন্য মংলা সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে লিংক পাবে।
গার্মেন্টস শিল্প মালিক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরই গার্মেন্টস শিল্পসহ শ্রমঘন শিল্প খাতের জন্য সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। পদ্মা সেতুর ওপাড়ে দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম ও পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প স্থাপনের উপযোগী জমি ও সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যাবে। সেখানে পর্যাপ্ত গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ অবকাঠোমো সুবিধা নিশ্চিত করা হলে শ্রমঘন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। পদ্মার ওপাড়ে গার্মেন্টসহ শ্রমঘন শিল্প-কারখানা দেশের জিডিপি হার বৃদ্ধিতে অনন্য ভূমিকা রাখবে।

তিনি উল্লেখ করেন, সরকার দেশীয় শিল্পের উৎপাদনকে প্রাধান্য দিচ্ছে। উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের জন্য শ্রমঘন শিল্পের বিকল্প নেই। বর্তমানে অন্তত ২০ শতাংশ দক্ষ শ্রমিকের সঙ্কট বা ঘাটতি রয়েছে। পোশাক খাত ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। শিল্পের অধিকতর উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, দক্ষ শ্রমিক প্রয়োজন। দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজমান থাকায় বিদেশি ক্রেতারা আস্থা বজায় রাখছেন।
ম্যাককিনসে এবং নিয়েলসেন জরিপ প্রতিবেদনের সুপারিশে আরও বলা হয়, প্রধান রফতানি খাত গার্মেন্টস শিল্পে কমপ্লায়েন্সের শর্তাবলী পরিপূরণের সাথে সাথে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের চাহিদা বেড়েই চলেছে। এরজন্য সুলভে দক্ষ শ্রমশক্তির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। বেশিরভাগ শ্রমিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন গার্মেন্টস কারখানায় চাকরিকালীন সময়ে অথবা স্থানীয় বেসিক সুইং স্কুলগুলোতে।

গ্লোবাল ম্যানেজম্যান্ট কনসালটিং প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানি এবং নিয়েলসেন’র জরিপ প্রতিবেদনের সুপারিশে সুদক্ষ শ্রমিকের মাধ্যমে পোশাকপণ্যের বৈচিত্র্যকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, গৎ বাঁধা পোশাকপণ্য ক্রেতারা আর চাইছেন না। ক্রেতারা (বায়ার) বাংলাদেশে উৎপাদিত অধিকতর ফ্যাশন্যব্ল, বৈচিত্র্যপূর্ণ, নজরকাড়া এবং জমকালো পোশাকপণ্য ক্রয়ে আগ্রহী। শ্রমিকদের দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে উদ্ভাবনী ক্ষমতার ওপর তা অনেকাংশে নির্ভর করছে। এরজন্য পারদর্শিতা ও সক্ষমতা অর্জনে কারখানা মালিক-শ্রমিকদের অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। কারখানাগুলোর উৎপাদনশীলতার মান উন্নয়ন প্রয়োজন।

জরিপ প্রতিবেদনে মানবসম্পদ উন্নয়নের তাগিদ দেয়া হয়। এ বিষয়ে বলা হয়, দেশে গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি ছাড়াও মাঝারি সারির ব্যবস্থাপনায় (মিড লেভেল ম্যানেজমেন্ট) প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ মানবসম্পদের অভাব রয়েছে। স্থানীয় মেধার সদ্ব্যবহারের অভাবে বিদেশ থেকে মিডল ম্যানেজম্যান্ট আমদানির মাধ্যমে চাহিদা পূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। যা টেকসই কোন সমাধান নয়। তাছাড়া সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণেও এই বিদেশি মিডল ম্যানেজম্যান্টে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিয়েলসেন কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেডের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির প্রাণ গার্মেন্টস শিল্প দুর্দমনীয় যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৫ কোটি লোকের জীবন-জীবিকা জড়িত। ব্যাংক ও বীমা, পোর্ট-শিপিং, পরিবহন, শুল্ক-কর ও রাজস্ব, সেবাখাতসমূহ, প্রকৌশল খাত, জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি, আবাসন, হোটেল ও পর্যটনসহ অনেকগুলো খাত, উপখাত, লিঙ্কেজ মিলিয়ে গার্মেন্টস শিল্প ব্যাপক অথনৈতিক ও সামাজিক অবদান রাখছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন