ওরা বাঁচতে চায়, কিন্তু ওদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। ওদের বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দেয়া হচ্ছে। ওদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, হাত-পা বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। পাশবিক নির্মমতায় শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হচ্ছে ওদের হাত-পা-মাথা। ওদের আগুনে পোড়া দেহ, ছিন্নভিন্ন লাশ দাফন করার কেউ নেই। ওদের নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। কেড়ে নেয়া হচ্ছে সাথের সব অলংকার। ওদের বাসস্থানগুলো আজ ধ্বংস্তূপে পরিণত, নয়তো বিরান। শিয়াল-কুকুর চরছে সেগুলোতে। তাদের খাবার নেই, বাসস্থান নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই। তাদের পাশে কেউ নেই।
বিভিন্ন সূত্রের খবরে বলা হয়, সৈন্যরা বিভিন্ন পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে। লোকজনকে গুলি করে মেরে ফেলছে। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লোকজন যখন বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে তখন হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে গুলিবর্ষণ করে তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গারা যেখানে গিয়ে লুকাচ্ছে সেখানে, রাস্তা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় পথে-ঘাটে, খালে-নদীতে তাদেরকে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে। লোকজন নৌকায় করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে চাইলে তাদের নৌকার ওপর গুলি করা হচ্ছে। ওরা প্রাণ বাঁচাতে, সম্ভ্রম বাঁচাতে, একটু নিরাপত্তার আশায় ছুটছে সবচেয়ে কাছের যে দেশটিতে সে দেশের সীমান্তও ওদের জন্য বন্ধ। কি স্থল কি নৌপথÑ সকল পথ। ওদের কান্না জড়িত আর্তনাদ ভাসছে বাতাসেÑহে আল্লাহ! তুমি রক্ষা করো।
ওরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অধিবাসী। রাখাইন রাজ্যের সাবেক নাম আরাকান। আরাকান মানে ইতিহাস, আরাকান মানে মুসলিম প্রধান এলাকা। ওদের অপরাধ ওরা রোহিঙ্গা মুসলমান। ওরা যদি মুসলমান না হত তাহলে কিছুই হত না। ওরা কয়েকশ বছর ধরে আছে আরাকানের মাটিতে। ওরা মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের প্রতিহিংসার শিকার। তাই চলছে রোহিঙ্গা নির্মূলে সহিংসতা। বৌদ্ধধর্মের মূলমন্ত্র অহিংসা। সেই অহিংসার অনুসারীরা দেশটির শতাধিক জাতিগোষ্ঠির আর কারো প্রতিই বৈরি নয়, শুধু রোহিঙ্গারাই তাদের ভয়ংকর শত্রু। মিয়ানমারের মাটিতে তারা মুসলিম রোহিঙ্গাদের কোনো অবস্থাতেই বরদাশত করতে রাজি নয়। হয় মৃত্যু, নয় দেশত্যাগÑ রোহিঙ্গাদের জন্য একটিই পথ খোলা রেখেছে তারা। তাই বারো লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি। রোহিঙ্গাদের কোনো সামাজিক অধিকার নেই। তাদের সন্তানদের মিয়ানমারের কোনো সরকারি স্কুল কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার নেই। রোগে-দুর্ঘটনায় কোনো সরকারি হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় না। দেশের কোনো সরকারি চাকরিতে নেয়া হয় না রোহিঙ্গাদের। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের আর কোনো অঞ্চলের মুসলমানদের সাথে যোগাযোগ করতে দেয়া হয় না। কোনো রোহিঙ্গা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অন্য কোনো গ্রামে যেতে পারে না। রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েদের বিয়ে করতে হলে সরকারের লোকদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। কেউ সন্তান নিতে চাইলে জানাতে হয় কর্তৃপক্ষকে। তাদের কাউকে আটক করা হলে কোনো আইনি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ নেই। মিয়ানমারের কারাগারগুলোতে অসংখ্য রোহিঙ্গা বিনা বিচারে দিন কাটাচ্ছে বা বানোয়াট অপরাধে জেলের ঘানি টেনে চলেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ভূমিকা সেখানে পুতুলের চেয়ে বেশি নয়। তাদেরকে কিছু করতে দেয়া হয় না। একটি জাতিগোষ্ঠি এভাবেই ধ্বংস, মৃত্যু, নির্যাতন, নিপীড়ন, নির্মম নির্মূলীকরণের শিকার হয়ে নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে।
মরহুম সাংবাদিক, লেখক ও টিভির অনুষ্ঠান উপস্থাপক ফতেহ লোহানী বাংলাদেশে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আগমন ও মিয়ানমারে বিরাজমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে যে তীক্ষè মন্তব্যটি করেছিলেন তা মোটামুটি এ রকমঃ ‘পাখিদের নীড় আছে, ইদুরেরও গর্ত খোঁড়ার মাটি আছে, কিন্তু রোহিঙ্গাদের কোনো দেশ নেই।’
দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে চলছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী ধর্মীয়-রাজনৈতিক গ্রুপগুলোর এই নিষ্ঠুর নির্মূলীকরণ অভিযান। বলা দরকার, শত শত বছর আগে সাবেক আরাকান অঞ্চলে মুসলিমরা পৌঁছে। ইতিহাস বলে, এগারো শতকে আরাকান ভূখ-ে মুসলিমদের পদার্পণ ঘটে। ক্রমশ তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবার এক পর্যায়ে সে রাজ্যে তারা হয়ে ওঠে প্রভাবশালী। শাসন ক্ষমতায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে তারা। এ জন্য স্থানীয় বৌদ্ধরা তাদের প্রতি ঈর্ষার কারণে মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। সে বিদ্বেষ সংক্রমিত হয় আরাকান সন্নিহিত বৌদ্ধপ্রধান অঞ্চলে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সে বিদ্বেষ বয়ে চলেছে উগ্র বৌদ্ধরা। কয়েকশ’ বছর আরাকান ছিল স্বাধীন রাজ্য। জানা যায়, ১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা বোদাপাওয়া আরাকান দখল করেন। পরে ১৮২৬ সালে বার্মার সাথে যুদ্ধের পর ইংরেজরা আরাকান দখল করে। ঊনিশ শতকে ইংরেজরা বার্মা দখলের পর আরাকান ছিল স্বায়ত্ত শাসিত। কিন্তু ১৯৪৮ সালে বার্মার স্বাধীনতার সময় আরাকানের স্বাতন্ত্র্যময় পরিচিতি বিলুপ্ত হয়।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, স্কটিশ পদার্থবিদ, ভূগোলবিদ, প্রাণিতত্ত্ববিদ ও উদ্ভিদবিদ ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিলটন ১৭৯৯-১৮১৫ সাল পর্যন্ত ভারতে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের অধীনে চাকরি করার সময় ব্যাপক জরিপ কাজ পরিচালনা করেন। তিনিই প্রথম ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। পরে সেটিই প্রচলিত হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে বর্র্র্মী বৌদ্ধদের মুসলিম বিদ্বেষ নতুন নয়, বহু পুরনো। ইতিহাসে দেখা যায়, রাজা বাইন্নাঅং ১৫৫৯ সালে বাগো (বর্তমান পেগু) অধিকার করে সেখানকার মুসলমানদের কোরবানি দেয়া নিষিদ্ধ করেন। মধ্য আঠারো শতকেও আরেক রাজার আমলে এ নিষেধাজ্ঞা পুনরায় কার্যকর করা হয়। রাজা বোদাপাওয়া শূকরের মাংস খেতে অস্বীকার করায় ৪ জন ইমামকে হত্যা করেন। পরে অবশ্য তিনি এ অপকর্মের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। এ রকম আরো অনেক ঘটনা ঘটে। ব্রিটিশ আমলে মুসলিম বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। ১৯৩৮ সালে বার্মায় মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ১৯৩৯ সালে ইংরেজরা রাখাইন রাজ্যে বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে দীর্ঘ শত্রুতার অবসানের লক্ষে একটি কমিশন গঠন করেছিল। কমিশনের রিপোর্টে এ জন্য নানা কারণ চিহ্নিত করা হয়। মুসলিম বিরোধী সবচেয়ে ভয়াবহ দাঙ্গা হয় ১৯৪২ সালে। জানা যায়, এ সময় বর্মীরা বিভিন্ন স্থানে ৫ হাজার মুসলিম ও শুধু রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে ২০ হাজার মুসলমানকে হত্যা করে। ১৯৬২ সালে বার্মায় জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখল করার পর রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ ক্রমশ কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। এ অবস্থায় তাদের মধ্যে আত্মরক্ষার চেষ্টা শুরু হয় যা দমন করতে সামরিক জান্তা ১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গা নির্মূলীকরণ ‘কিং ড্রাগন অপারেশন’ চালায়। প্রায় সমগ্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি এর শিকার হয়। হত্যা, ধ্বংস, নির্যাতন, গ্রেফতার থেকে রেহাই পেতে বন্যা¯্রােতের মত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা ধেয়ে আসে বাংলাদেশে। বিপন্ন মানবতার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে সরকার তাদের সাময়িক আশ্রয় দেয়। সরকারি হিসেবে তাদের সংখ্যা আড়াই লাখ বলে উল্লেখ করা হলেও প্রকৃত সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। তাদের প্রায় সবাই এখনো বাংলাদেশেই অবস্থান করছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা জন্মভূমিতে ফিরে গেলেও বাকিদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকার সাড়া দেয়নি। উল্লেখ্য, ধর্ম এক হলেও তাদের ভাষা-সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। অতিরিক্ত জনসংখ্যা কবলিত বাংলাদেশের জন্য তারা এক বোঝা তো বটেই, তদুপরি তাদের একটি অংশ নানাবিধ অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িত হয়ে নানা অঘটন ও সমস্যার সৃষ্টি করছে। ওদিকে ১৯৯৭ সালেও মিয়ানমারে মুসলিম-বৌদ্ধ ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি হয় ও দাঙ্গা ঘটে। ২০০১ সালে পেগু এলাকায় দাঙ্গায় ২শ’রও বেশি মুসলমান নিহত হয়। তারপর ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট দাঙ্গায় ২৫০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গাকে হত্যা এবং বহু ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। দেড় লক্ষাধিক মানুষ হয় গৃহহীন। সে সময়কার গৃৃহহীন বহু রোহিঙ্গা মানবেতর পরিবেশে আজো বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক কোনো প্রচেষ্টা নেয়া হয়নি। বিগত বছরগুলোতে হতাশ, প্রাণভয়ে ভীত হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু সাগর পথে অন্যদেশে পাড়ি দেয়ার মরিয়া চেষ্টা করতে গিয়ে দুঃসহ দুর্ভোগের সম্মুখীন হওয়াসহ নৌকা, ট্রলার বা ছোট জাহাজডুবির শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্যের অবসান হয়নি।
রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সরকারের সর্বশেষ নির্যাতন-নিপীড়নের শুরু হয় দেড়মাস আগে। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যের এক পুলিশ ফাঁড়িতে গত ৯ অক্টোবর দুষ্কৃতকারীদের হামলায় ৯ পুলিশ নিহত হয়। তারপর থেকেই ঐ এলাকা ঘিরে ফেলে ঘরে ঘরে তল্লাশি চালাচ্ছে মিয়ামার সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও পুলিশ। শুরু হয় রোহিঙ্গাদের উপর নির্মম নির্যাতন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভিযোগ করেছে, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ থেকে আসা সন্ত্রাসীরা রাখাইন মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালাচ্ছে। এ অভিযোগ সম্পর্কে রোহিঙ্গা মুসলমানরা বলেন, এ অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। শুধু সৌদি আরব, বাংলাদেশ কিংবা মালয়েশিয়া নয়, বিশ্বের কোনো দেশ থেকে এসে কেউ এখানে সন্ত্রাস চালাচ্ছে না। তিনি বলেন, মিথ্যা কথা বলে ও মিথ্যা অজুহাতে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা করছে, ধর্ষণ করছে, তাদের সম্পদ লুট করছে। এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলকেও তারা সেখানে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।
এইচআরডব্লিউ ২০ নভেম্বর বলেছে, তারা স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করে গত ১০-১৮ নভেম্বর পাঁচটি রোহিঙ্গা গ্রামে ধ্বংস করা ৮২০টি স্থাপনা চিহ্নিত করেছে। সংস্থাটি বলছে, রোহিঙ্গাদের গ্রাম অবরোধ করে চালানো সেনা অভিযানকালে সর্বমোট ১২৫০টি বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অভিযানকালে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। এদিকে আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম মায়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের অবস্থাকে নরকের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, সেখানে গত প্রায় দেড় মাস ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে কমপক্ষে সাড়ে ৩শ’ জন নিহত হয়েছে। যে সব এলাকায় রোহিঙ্গাদের গ্রামে সেনাবাহিনী অভিযান চালাচ্ছে সেখানে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মীদের যেতে দেয়া হচ্ছে না। সেখানকার ব্যাপক সংখ্যক ঘরবাড়িতে আগুন, রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা এবং অস্ত্রের মুখে নারী ও কিশোরীদের ধর্ষণের খবর জানা গেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দু’দিন ধরে হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করার ফলে বহু লোক হতাহত হয়। তারা যখন জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে পালাচ্ছে তখনো তাদের ধাওয়া করা হচ্ছে, তাদের সাথে থাকা সব কিছু কেড়ে নেয়া হচ্ছে।
উদ্বাস্তু বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরু-র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, মায়ানমারকে যতটা চাপ দেয়া প্রয়োজন ততটা দেয়া হচ্ছে না। শুধুমাত্র সে কারণেই এই সমস্যা জিইয়ে ছিল এবং অবস্থা এখন আরো খারাপ হচ্ছে। আবরার বলেন, অতীতে চীনের কিছুটা চাপ ছিল। এখন সেটাও নেই। তিনি বলেন, মানুষগুলো যখন জীবনের ভয়ে ভীত হয়ে আরেক দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করছে, তখন শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশেরই আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন করার বিষয় রয়েছে। এটা একটা মানবিক সমস্যা।
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের কমিশন রোহিঙ্গা ইস্যুতে খুব একটা কাজ করতে পারবে বলে মনে করছেন না বিশ্লেষকেরা। ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতিতে মায়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মায়ানমার সরকারকে সেখানকার মানুষদের নিয়ম অনুযায়ী রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তারা যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। ২১ নভেম্বর শতাধিক উদ্বাস্তুকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না দিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। সে হিসেবে মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার কথা বাংলাদেশের।
এদিকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর গণহত্যা ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে মায়ানমারের নেত্রী অং সাং সু চির নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবি ক্রমাগত জোরালো হচ্ছে। পিটিশন ওয়েবসাইট চেঞ্জ ডট ওআরজি-তে জমা হচ্ছে একের পর এক আবেদন। আগের পিটিশন ছাড়া সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নতুন করে সহিংসতা শুরুর পর গত কয়েকদিনে বেশ কিছু নতুন পিটিশন জমা হয়েছে। সেই সঙ্গে পুরনো পিটিশনে স্বাক্ষরদাতাদের সাড়া বেড়েছে।
১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া সু চির বিরুদ্ধে পিটিশনগুলো করার কারণ হলো রোহিঙ্গা মুসলিম প্রশ্নে তার এমন আশ্চর্যজনক নীরবতা যা তার অনেক কট্টর সমর্থকের মনেও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ৮ই নভেম্বর মায়ানমারের ঐতিহাসিক নির্বাচনে সু চির দল কোনো মুসলিম ব্যক্তিকে প্রার্থী করেনি। দলের বিভিন্ন শীর্ষ নেতাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, তিনি মায়ানমারের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইচ্ছাকৃতভাবে মুসলিম প্রার্থীদের নিজ দল থেকে সরিয়ে দেন। সু চি’র বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ স্বাক্ষর আদায়কারী পিটিশনটি করা হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সহিংসতার প্রেক্ষাপটে পিটিশনটিতে এখন খুব দ্রুত স্বাক্ষরের সংখ্যা বাড়ছে। এরই মধ্যে ওই পিটিশনে লক্ষাধিক স্বাক্ষর সংগৃহীত হয়েছে। একটি পিটিশনে অন্তত দেড় লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ হলেই কেবল তা নোবেল কমিটিতে উপস্থাপন করা যাবে।
বলা দরকার যে মিয়ানমার সরকারের বর্তমান রোহিঙ্গা নিপীড়নের পাশাপাশি সাম্প্রতিক কালের রক্তক্ষয়ী মুসলিম বিদ্বেষ ও দাঙ্গার পেছনে যে ব্যক্তিটি প্রধান ভূমিকা পালন করছেন তিনি হচ্ছেন বিতর্কিত বৌদ্ধভিক্ষু অশিন ভিরাতু। মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণার কারণে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে কুখ্যাত তিনি। তার উস্কানিতে ২০১২ সালে অন্তত দুইশ’ রোহিঙ্গা মুসলিমকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা এবং দেড় লাখ রোহিঙ্গাকে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে জন্ম নেয়া এ উগ্রপন্থী ভিক্ষুর নেতৃত্বে ২০০১ সাল থেকে মুসলিম বিদ্বেষী ‘৯৬৯’ আন্দোলন গড়ে ওঠে। সে সুবাদে বৌদ্ধদের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি পান অশিন ভিরাতু। অপরাধমূলক কর্মকা-ের জন্য ২০০৩ সালে ২৫ বছরের কারাদ- হয় তার। তবে সাত বছর পরে মিয়ানমারের স্বৈর-সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে মুক্তি পান তিনি। জেল থেকে বেরিয়েই ফের মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণা শুরু করেন ভিক্ষু ভিরাতু। তার সাম্প্রদায়িকতায় দীক্ষিত হয় মিয়ানমারের অনেক বৌদ্ধ তরুণ। ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে ভিরাতুর উস্কানিতেই রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর হামলা ও ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুটপাটে ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
অসহায় রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বিশ^ নিশ্চুপ। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ঘিরে ফেলতে মিয়ানমারকে চায়। তারা নিশ্চুপ। যে ভারত ’৭১ সালে প্রায় ১ কোটি বাঙালি উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছিল তারা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে আছে। রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স আগ্রহহীন। সবচেয়ে সোচ্চার হতে পারত যে ওআইসি সেটিও নীরব। কার্যত গোটা বিশ^ সংকীর্ণ স্বার্থের দ্বন্দ্বে আজ এতটাই ব্যস্ত যে বিপন্নœ মানবতা এবং তা যদি হয় আবার মুসলমান, তাহলে কেউ আর তৎপর হতে রাজি নয়। তাই রোহিঙ্গারা সকল অর্থেই আজ অস্তিত্ব বিপন্ন এক অসহায় জাতিগোষ্ঠি। তাদের রক্ষা করার কেউ নেই, এটাই প্রমাণিত সত্য।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
যথসধযসঁফনফ@ুধযড়ড়.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন