জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল দিনে দিনে ইটভাটার চুলার মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে তীব্র তাপদাহ, দাবানল আর খরায় পুড়ছে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি অঞ্চল। বাংলাদেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব প্রকট আকারে দেখা দিচ্ছে। ভরা বর্ষা মৌসুমে চলছে খরা। কোথাও কোথাও বইছে মৃদু তাপপ্রবাহ। মাঝখানে দু’দিন বৃষ্টি হওয়ায় গরম কিছুটা কমলেও গতকাল থেকে আবার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। বৃষ্টি হলেও ভাপসা গরম কমছে না। গরমে হাঁসফাঁস মানুষের জীবন। এ অবস্থায় তাপপ্রবাহ কমার তেমন কোনো সুসংবাদ দিতে পারেনি আবহাওয়া অধিদফতর। দেশের আট বিভাগেই হালকা থেকে মাঝারি ও বজ্রসহ বৃষ্টির আভাস দিলেও রাজশাহী ও পাবনা জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃদু তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে এ অধিদফতর। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের ৮ বিভাগেই বৃষ্টি হয়েছে, তবে তা খুবই সামান্য। গতকাল সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে সাতক্ষীরায় ৩৫ মিলিমিটার। এসময়ে ঢাকায় সামান্য বৃষ্টি হয়েছে।
এটা শ্রাবণ মাস। বর্ষার ভরা মৌসুম। সারাদিন ঝরঝর বৃষ্টি থাকার কথা। কিন্তু হচ্ছে তার উল্টো। দেশের উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। অনাবৃষ্টির ফলে বিভিন্ন স্থানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পেয়ে দেখা দিচ্ছে স্থায়ী মরুকরণ। রাজশাহীর বরেন্দ্র এলাকায় বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। যদিও এর মধ্যে মানবসৃষ্ট কারণ, বিশেষ করে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবও দায়ী, তবে অনাবৃষ্টির ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত কমে যাচ্ছে। বৃষ্টির অভাবে রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে নদনদী, খালবিল শুকিয়ে গেছে। পানির অভাবে কৃষক পাট জাগ দিতে পারছে না। আউশ এবং আমনের চাষও ব্যাহত হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ইতোমধ্যে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি-বন্যা, শিলাবৃষ্টি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা, মরুকরণ, নদীভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেক বেড়ে গেছে। প্রকৃতিতে আবহাওয়ার বৈরী আচরণ খুবই স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বিগত কয়েক বছরে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত কয়েক বছর যাবত গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি থাকছে। যাকে মরুর তাপমাত্রা বলা হচ্ছে। তাপমাত্রার এই অস্বাভাবিকতার ফলে দিনে দিনে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। আবার কখনো বা অসময়ে দেশের কোন অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে।
কিছুদিন আগে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বড় ধরনের বন্যার পর আবার বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয় তাপদাহ। প্রচণ্ড গরমে দুর্বিষহ জনজীবন। প্রকৃতিতে যে তাপদাহ তাতে গ্রীষ্মের আবহাওয়াই যেন বিরাজমান। দেশের ১৭ জেলায় মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। এরই মধ্যে গত ১৬ জুলাই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে রাজশাহীতে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই অস্বাভাবিক তাপমাত্রা ভারি বৃষ্টিপাত ছাড়া সহসা কমছে না। বরং বৃষ্টির পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় তাপপ্রবাহ আবার বৃদ্ধি পাবে। এ সপ্তাহে আবারও রাজশাহী ও সিলেট বিভাগসহ অন্যান্য কয়েকটি জেলায় মৃদু তাপপ্রবাহ শুরু হতে পারে।
দুর্বিষহ গরমের মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। এসময়ে চলছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। তাপপ্রবাহ শুরু হলে বিদ্যুতের লোডশেডিং, জ্বালানি ও পানি সরবরাহের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। অধিক তাপমাত্রার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ফসল। এছাড়া অস্বাভাবিক গরমের কারণে সর্দি জ্বর, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ, কাশি ও নানান রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ারও শঙ্কা রয়েছে।
বিশিষ্ট জলবায়ু ও পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বেশ কিছু বিপদের মুখে পড়ছে বাংলাদেশ। বেশি প্রভাব পড়ছে পানি ও বাতাসের ওপর। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি। গত বছর দেশে সময়মতো পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় খরায় ভুগতে হয়েছে। এবছর ভরা বর্ষায়ও স্বাভাবিক বৃষ্টি নেই। দেশের তাপমাত্রাও বেড়ে গেছে। রাজশাহীতে এই সময়ে গরমের জন্য বাইরে বের হওয়া বেশ কষ্টদায়ক। এদিকে আবার আগস্ট- সেপ্টেম্বর দেখা দিতে পারে বন্যা। ২০১৭ সালে এমন সময়ে বন্যা হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন থেকে প্রতি ৫ বছর পর পর এমন বন্যা হবে, যা আগের ৩০ বছরের বন্যাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এখন আষাঢ়-শ্রাবণে বৃষ্টি কম হচ্ছে। এটি আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে। তবে বার্ষিক বৃষ্টিপাত বাড়বে। অন্যদিকে, সাগরের পানি বেড়ে যাওয়ায় লবণাক্ততার প্রভাব গোপালগঞ্জ পর্যন্ত এসেছে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট এরই মধ্যে লবণাক্ত। আবহাওয়ার এই বৈরী আচরণ কমাতে হলে কার্বণ নিঃসরণ কমাতে হবে। খালবিল, নদীনালা ও ডোবাগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। গ্রিন হাউস নিঃসরণ কমানো না গেলে সবার জন্য আরও ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে।
গবেষকদের বিশ্লেষণ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ২০৩৭ সাল নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণতা এখনকার তুলনায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। আর ২০৫১ সাল নাগাদ তা আরও ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে তীব্র তাপদাহ, দাবানল আর খরায় পুড়ছে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি অঞ্চল। আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে ভারত মহাসাগর অবধি আবহাওয়ার ওই অস্বাভাবিক অসহনীয় উষ্ণ আচরণে বিপন্ন হয়ে পড়েছে প্রাণীজগৎ। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশে গত সপ্তাহে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি ছিল। ১৯৪৮ সাল থেকে ২০২২ সালের আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করলে ৭০ থেকে ৭৪ বছরের ইতিহাসে চলতি জুলাই মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তীব্র তাপদাহ আর দাবানল। পুড়ছে ইউরোপ, ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে মরক্কোতেও দাবানলের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। তীব্র তাপদাহে গত এক সপ্তাহে ইউরোপে মৃত্যু হয়েছে দুই হাজারেও বেশি মানুষের। বিশ্বের আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থাগুলো বলছে, বিশ্বের অর্ধেকের বেশি এলাকাজুড়ে এখন তীব্র তাপদাহ বইছে। ইউরোপ থেকে শুরু করে চীন, মধ্যপ্রাচ্য, ইরান, ভারত, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়াজুড়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে।
তীব্র তাপদাহে ব্রিটেনে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে সরকার। তাপ বৃদ্ধির কারণে এবারই প্রথম ব্রিটেনে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে, ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে প্রবল বাতাস এবং চরম শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে দাবানল ছড়িয়ে পড়ে জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ফ্রান্সের অনেক স্থানীয় বাসিন্দা বিভিন্ন শহর ও গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। গত কয়েক দিনে ১০ হাজারেরও বেশি লোক ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিহাদ অঞ্চল ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এ ছাড়া চীনের পূর্বাঞ্চলীয় সাংহাই, নানজিং ও ঝিজিয়াংসহ বেশ কয়েকটি শহরে চলছে প্রচণ্ড তাপদাহ। গতকাল বাণিজ্যিক শহর সাংহাইয়ে তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ১৮৭৩ সালের পর শহরটিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এটি। প্রচণ্ড গরমে কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাবে ভারতের রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, ওডিশা, ছত্তিশগড় ও অন্ধ্রপ্রদেশের বেশির ভাগ শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে।
এ ছাড়া গত কয়েক যুগের মধ্যে ভয়াবহ তাপদাহ ও খরায় পুড়ছে পূর্ব আফ্রিকা। এই খরা গত বছর শুরু হয়ে এখনো চলছে। চার মৌসুম পরও সেখানে বৃষ্টির দেখা নেই। এ অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষ চরম অনাহারে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভারতীয় মহাসাগরের স্রোতের সঙ্গে সম্পর্কিত বসন্তকালীন বৃষ্টি এ অঞ্চলে পৌঁছানোর আগেই সমুদ্রে ঝড়ে পড়ছে, যার কারণে বৃষ্টি হচ্ছে না ভূমি অঞ্চলে। ইতালিতে খরার কবলে পড়ে দেশের উত্তরে অবস্থিত ‘পো’ নদীর পাশের পাঁচটি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে ইতালি। বলা হচ্ছে, বিগত ৭০ বছরের মধ্যে এটি দেশটির সবচেয়ে ভয়াবহ খরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন