॥ এক ॥
রাজনীতি মানুষের কল্যাণে একটি মহৎ বিষয় হলেও সবাই রজনীতি পছন্দ করেন না। এমনকি রাজনীতি করা ভাল মানুষের কাজ নয়, এমন ধারনাও প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে সমাজের এক শ্রেণির ধার্মিক মানুষ রাজনীতিকে শুধু অপছন্দই করেন না বরং যারা রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত তাদের প্রতি খারাপ ধারনাও পোষন করেন। অথচ আমাদের ইসলাম ধর্ম এ ধারনাকে মোটেও সমর্থন করে না। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা ইসলাম ধর্মের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োগ ছাড়া ইসলাম পূর্ণাঙ্গতা পায় না। কোন মুসলমানের অপরাজনীতির কারণে ইসলামী রাজনীতিকে অপছন্দ করা বা অস্বীকার করা ইসলাম ধর্মকে অপূর্ণাঙ্গ ধারনা করার শামিল। আর কোন মুসলমান ইসলামকে অপূর্ণাঙ্গ ধারনা করতে পারে না।
ইসলাম কেমন ধরনের রাজনীতিকে সমর্থন করে, এ নিয়ে হয়তো বিতর্ক করা যেতে পারে। কিন্তু ইসলামে রাজনীতি নেই, একথা শুধু মূর্খ এবং জ্ঞান-পাপীরাই বলতে পারে। কারণ, ইসলাম ধর্মের নবী বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজে একজন রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। মহানবী (সা.) এর একান্ত চার সহচর, ইসলামের প্রধান চার খলীফা হযরত আবু বকর (রা.), হযরত ওমর (রা.), হযরত উসমান গণী (রা.) এবং হযরত আলী (রা.) সবাই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তাদের শাসন ব্যবস্থা ইতিহাসে সোনালী যুগ হিসেবে খ্যাত। পরবর্তীতে কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বে ইসলামী খেলাফতব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলিম দুনিয়া তাদের গৌরবের খেলাফতব্যবস্থা হারিয়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি হারিয়েছে। বেশির ভাগ মুসলিম সা¤্রাজ্য উপনিবেশিক আগ্রাসী শক্তি গ্রাস করে নিয়েছিল। বর্তমানে বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে বিভিন্ন ধরনের শাসন ব্যবস্থা চলছে। কোথাও রাজতন্ত্র, কোথাও সামরিক একনায়কতন্ত্র, কোথাও উপনিবেশিক শাসন আবার কোথাও পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক শাসন চালু রয়েছে। একমাত্র ইরান ইসলামী শাসনব্যবস্থার দাবী করলেও বাকী মুসলিম বিশ্ব সেটাকে শিয়া শাসন হিসেবেই আখ্যায়িত করে থাকে। আজ গোটা দুনিয়ায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতি প্রকৃত মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে নেই। প্রায় সব মুসলিম শাসকই সা¤্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির তাবেদার ও ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করছে। অথচ যখন প্রকৃত মুসলমানের হাতে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল; খেলাফায়ে রাশেদার সেই যুগে বিশ্বের তৎকালীন দুই মহাশক্তি রোম ও পারস্য মুসলিম শক্তিকে সমিহ করতো।
ইসলামের রাজনীতি শুধু মুসলমানের স্বার্থ এবং কল্যাণচিন্তা নয় বরং গোটা সৃষ্টি জগতের কল্যাণ সাধনই হলো ইসলামী রাজনীতির দর্শন। যে রাজনীতির শিক্ষা দিয়ে রাব্বুল আলামীন রাহমাতুল্লিল আমীনকে (সা.) এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। ইসলামের রাজনীতি কোন রকম সাম্প্রদায়িকতা এবং সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করে না। বরং ইসলামের রাজনীতি সর্বজনিন ও বিশ্বজনিন আন্তর্জাতিকতাবাদকে ধারণ করে। দেশের এক শ্রেণির ধর্মবিদ্বেষী মানুষের আবদার হলো, ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি তথা ইসলামী রাজনীতি এদেশে চলবে না। কার্ল মার্কস-মাওসেতুং-এর রাজনীতি চলবে, লেনিন-স্টালিন-এর রাজনীতি চলবে, গান্ধী-আব্রাহাম লিঙ্কনের রাজনীতি চলবে আর মানবতার মুক্তিদূত বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)- এর রাজনীতি চলবে না, তাও মুহাম্মদ (সা.)- এর উম্মতদের মেনে নিতে হবে? যারা এদেশে মুহাম্মদ (সা.)-এর তরিকায় ইসলামের সুমহান আদর্শের আলোকে গণ-মানুষের হৃদয় জয় করে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চায়, তাদের অন্যায়টা কোথায়? এটাই ইসলামের রাজনীতি। এটা দোষনীয় কিছু নয়। এটা বরং প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী ফরিজা। এর সঙ্গে প্রচলিত সংঘাত, জিঘাংসা আর প্রতিহিংসার রাজনীতির বিস্তর তফাত। যুগের বিচক্ষণ ধর্মীয় আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক নেতা মরহুম সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই রহ. ইসলাম কায়েমের এ রাজনীতির নাম দিয়েছিলেন ‘পবিত্র এবাদতের রাজনীতি’। আরেক যুগ শ্রেষ্ট বুজুর্গ মরহুম মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. এ রাজনীতির নাম দিয়েছিলেন ‘তওবার রাজনীতি’। হযরত হাফেজ্জী হুজুরের তওবার রাজনীতিরই পরিণত রূপ হযরত পীর সাহেব চরমোনাই রহ.-এর ‘এবাদতের রাজনীতি’।
প্রচলিত ধারার ক্ষমতার রাজনীতিতে এ উপমহাদেশের পীর আউলিয়াগণ কখনোই খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তবে গণ-মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তারা যুগে যুগে নেতৃত্ব দিয়েছেন, অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছেন। উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলনে পীর-আউলিয়া এবং উলামা মাশায়েখের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে মাওলানা শাহ আব্দুল আজিজ, মাওলানা ইসমাঈল শহীদ, মাওলানা সৈয়দ আহমদ বেরলবী, মাওলানা এমদাদুল্লাহ মোহাজেরে মক্কী, দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতবী, কুতুবুল আলম মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী, শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী, শায়খুল ইসলাম মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী, মাওলানা নেসার আলী তিতুমীর, শাহ হায়দার আলী টিপু সুলতান, হাজী শরীয়তুল্লাহ, মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী, ফকির মজনু শাহ রহ. এর মতো পীর আউলিয়াদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁরা তাদের ভক্ত, মুরিদ ও শোষিত মজলুম মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে জালিম আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। উপমহাদেশের ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে প্রথাগত রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পৃক্ত হয়েছে অনেক পরে, একেবারে শেষের দিকে। প্রথম দিকে সব আন্দোলন সংগ্রাম এবং বিদ্রোহ বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পীর আউলিয়া এবং ওলামা শ্রেণী। যারা প্রথাগত রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না।
উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে সর্বাগ্রে পীর মাশায়েখগণ ঝাপিয়ে পরার কারণ ছিল ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা এবং সামাজিক নেতৃত্ব। উমাহদেশের মুসলিম সমাজে পীর আউলিয়াদের প্রভাব ছিল ব্যাপক। কারণ, পীর আউলিয়াদের দাওয়াত ও প্রচেষ্টার ফলেই উপমহাদেশে মুসলিম সমাজ বিকাশ লাভ করেছে। খাজা মুঈন উদ্দীন চিশতি, খাজা নিজামুদ্দীন, খাজা খান জাহান আলী, শাহজালাল ইয়ামেনী, শাহ পরান, শাহ মাখদুম, শাহ আমানত, শাহ আলী, শাহ নেয়ামতুল্লাহসহ জগত বিখ্যাত পীর আউলিয়াগণের চেষ্টা সাধনায় ভারত উপমহাদেশে ইসলাম ধর্মের বিস্তার লাভ করেছে। যে কারণে এখানকার মুসলিম সমাজে পীর আউলিয়াদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি। ব্যক্তিগত ও কিছুটা সামাজিকভাবেও এ অঞ্চলের মুসলিম সমাজ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত। কিন্তু ইসলামকে রাজনৈতিকভাবে বা রাষ্ট্র জীবনে গ্রহণ করতে অধিকাংশ মুসলমানই এখনো প্রস্তুত নয়। অথচ মানুষের প্রয়োজনে এবং মানুষের কল্যাণেই জীবনের সকল পর্যায়ে ইসলামের সুমহান বিধি বিধানের চর্চা হওয়া উচিৎ। আসলে আমরা মুসলমানরাই ইসলামের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করতে পারিনি। আমরা দীন ইসলামের খন্ডিত এবং সুবিধাবদী চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
হযরত পীর সাহেব চরমোনাই রহ. মুসলমানদেরকে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করার দাওয়াত দিতেন। তিনি গণ মানুষের সামনে দীনের পূর্ণাঙ্গ ধারনা প্রকাশ করতেন। দরদী হৃদয় নিয়ে পূর্ণাঙ্গ দীনের সাধনাই করেছেন তিনি আজীবন। দীন এবং দুনিয়াকে আলাদা করার সুবিধাবাদী প্রবনতাকে তিনি বরদাশত করতে পারতেন না। দীন এবং দুনিয়াকে আলাদা করার প্রবণতা থেকেই আজ ইসলামকে রাষ্ট্র থেকে, সমাজ থেকে, অর্থনীতি থেকে, সংস্কৃতি থেকে বিদায় করার চেষ্টা চলছে। অথচ এসব কিছুই দীন তথা ইসলামের বিষয়বস্তুর বাইরে নয়। কিছু উপাসনা আর আরাধনার মধ্যেই শুধু যারা ইসলামকে গন্ডিবদ্ধ মনে করেন; হযরত পীর সাহেব চরমোনাই রহ. তাদের ভুল ধারনা শুধরানোর জন্যে আজীবন চেষ্টা করে গেছেন।
তরিকতের লাইনে একজন প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক হয়েও তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ইসলামের আলোকে গড়ে তুলতে। তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন জীবনের সকল পর্যায়ে এবং এ সংগ্রামকে তিনি উত্তম এবাদত মনে করেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন