এ কে এম শাহাবুদ্দিন জহর : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রাণকেন্দ্র আমাদের এই বাংলাদেশ। এ দেশের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে কবি দিজেন্দ্রলাল বলেছেন, “সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।” বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “আমার সোনার বাংলা।” কবি জীবনান্দ লিখেছেন, “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।” বাংলার যে রূপ এসব কবি-সাহিত্যকরা দেখেছেন তা শুধু ছিল মাঠে-ঘাটে-বাটে কর্মরত বা চলমান বাংলার নিরাভরণ গৃহবধূর সাদামাটা রূপ। বাংলা যখন নববধূর সাজে সজ্জিত কিম্বা রূপসীতম, হৃদয় বিকল করা কুমারী কন্যা অথবা পার্টির সাজ পরিহিত সেই রূপ বা সৌন্দর্য তারা দেখেননি। এই কবিগণ কখনো সুন্দরবনে গিয়েছেন কিনা জানি না। তারা কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত ও পাহাড়ের মিলন মেলা, কুয়াকাটার রূপ আর সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ করেছেন কিনা তাও জানি না। তারা বেড়িয়ে আসেননি নীলগিরি কিম্বা কেওকারাডং পাহাড়, মোহনীয় রাঙ্গামাটি, বনের রানী বান্দরবান। এই জায়গাগুলোতে বাংলা যে আরও কত সুন্দর তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এগুলোতে বাংলা যেন ধরিত্রী নয়, স্বর্গরাজ্য অমরাবতী।
বাংলার এই রূপসুষমা ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র নদনদীগুলো। প্রকৃতি এই নদনদী বাংলাকে দিয়েছে উদার হস্তে। নদনদী সুন্দরের প্রাণ বলেই মানুষ নৌকা ভ্রমণ পছন্দ করে। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পদ্মার বুকে ‘বোটে’ ঘুরে বেড়াতেন অহর্নিশ। কিন্তু সেই নদনদী এখন পানিশূন্য শীর্ণকায় খালে পরিণত হয়েছে। উজানে ভারতকর্তৃক পানি আটকানোর ফলেই মূলত নদনদীগুলোর এ দশা। এছাড়াও রয়েছে একশ্রেণির স্বার্থান্ধ, দেশ-প্রেম বিবর্জিত ব্যক্তিদের নদনদীর জায়গা দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক। ৩০ বছর আগেও এক সাহিত্যিক লিখেছিলেন, “বুড়িগঙ্গার শীতল নিতল উতল জল”। এখন কোনো সাহিত্যিক নয়, সাংবাদিকেরা লেখেন, সব রকমের বর্জ্য পদার্থে ভরা, পুতি দুর্গন্ধময়, বিবর্ণ ও বিকৃত রঙের বুড়িগঙ্গা নিয়ে। বুড়িগঙ্গার জোয়ার-ভাটায় জেগে ওঠা ও মরে যাওয়া খালগুলো সেই কবেই হয়ে গেছে শেষ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আরেক উপাদান বনভূমি। এই বনভূমি আগে বাংলাদেশে ছিল তার মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগেরও বেশি। ১৯৭১-এর আগে এ পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ ভাগে। এখন নাকি দাঁড়িয়েছে ১১ ভাগে। এই ১১ ভাগেরও বেশিরভাগ শুধু নামেমাত্র। এগুলোর গাছগুলো কেটে নেয়া হয়েছে প্রশাসনের ছত্রছায়ায়। পড়ে আছে শুধু ধূধূ প্রান্তর। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এখানে বনানী, নদনদী এবং সমুদ্র একাকার হয়ে সৃষ্টি করেছে সৌন্দর্যের ভা-ার। সেই বনও আজ বিলুপ্তির পথে। ফারাক্কা বাঁধের হিং¯্র ছোবলে পড়ে সুন্দরবন তার শ্রী-হারাচ্ছে দ্রুত। এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্যই বুঝি নির্মাণ করা হচ্ছে ভারতের স্বার্থে ও অর্থে সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে রামপাল পাওয়ার প্লান্ট। সুন্দরবনের বৈচিত্র্যময় নানা জীব এখন বিলুপ্তির পথে বিলুপ্তির পথে রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং বিরল জাতের ডলফিনও।
প্রকৃতি কিন্তু বাংলাদেশকে দিয়েই চলছে তার আশির্বাদ। তাইতো সুন্দরবনের পরিবেশের মতো সমুদ্রগর্ভে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন ভূখ-- সোনার চর, রূপার চর, ডিমের চর, পক্ষির চর, নিঝুম দ্বীপের মতো অগনিত চর, দ্বীপ ও সমুদ্র বক্ষে জেগে ওঠা ভূমি। কিন্তু এগুলোতে বনায়ন না করে করা হচ্ছে দখলবাজি ও বসতি স্থাপন। হায়রে প্রকৃতি প্রেম।
রাজধানী ঢাকার আশপাশের সৌন্দর্য আর নেই। “সাভারের লাল মাটি, ছোট ছোট টিলা, শাল কাঁঠালের বন” কথাটি আর কোনো কবি বলবে না। ঢাকার গাঁ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ভাওয়াল গড়ের গাছপালা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এ বনের বেশিরভাগ হয়ে গেছে দখলকৃত অথবা নানা কলকারখানা সৃষ্টির দ্বারা বিধ্বস্ত। মধুপুর গড়ে এক সময়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগার পর্যন্ত বাস করত। এখন সেখানে মধুর চাকের মৌমাছির পর্যন্ত দেখা মেলে না। প্রকৃতির সৌন্দর্য পরিলক্ষিত হয় পাহাড়ে। কিন্তু বাংলাদেশের পাহাড়গুলো ক্রমাগত কাটা পড়ছে। ঢাকার অতি নিকটবর্তী নরসিংদীর পূর্ব-উত্তরের পাহাড়িয়া পরিবেশ এবং অসম রাজার গড় সংরক্ষণের অভাবে বিলিয়মান প্রায়। ঢাকা থেকে বাস যোগে মাত্র দুই ঘণ্টার পথ কুমিল্লা সিটির বেষ্টনি লালমাই পাহাড় নানা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে এবং অবৈধভাবে মাটি কেটে ইতিহাসের পাতায় নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস চলছে। সবুজ পাহাড়গুলো হয়ে পড়েছে ন্যাড়া পাহাড়ে। পাহাড়ি সিটি চট্টগ্রাম এবং পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালীকে পাহাড় কেটে কেটে সৌন্দর্যহানি করার চক্রান্ত চলছে। সমুদ্র উপকূলে যেসব বনজ গাছপালা জন্মে সমুদ্র এলাকাকে করেছে শ্রীভূষিত, সেগুলোও সাবাড় করে ফেলা হচ্ছে অকাতরে।
বিশ্বে পাটের চাহিদা কমে গেছে। তাই কৃষক পাট চাষ তেমন করে না। পাটের সবুজ বন আর কারো হৃদয় কাড়ে না। বিদেশি সয়াবিন তৈলের আর্বিভাবে সরিষার তেল বাজার হারিয়েছে। তাই দৃষ্টিনন্দিত হলুদ সর্ষে ক্ষেতের দৃশ্য ঠিক আগের মতো পরিলক্ষিত হয় না। বাংলার খালবিল নিচু ভূমি বরষায় প্লাবিত হয় এবং সেখানে প্রস্ফুটিত হয় রাশিরাশি লাল, নীল ও সাদা রঙ্গের শাপলা ফুল। জলাভূমির পানি শূন্যতা ও গাছ তুলে ফেলার কারণে সেই শাপলা ও পদ্মফুল এখন আর আগের মতো পরিলক্ষিত হয় না। হাকালুকি হাওরসহ বিভিন্ন হাওরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পূর্বে জলজ গাছের বনভূমি ছিল। এ বনভূমি হাওরের রূপ বাড়াত। কিন্তু এখন সে বন কেটে শেষ করে ফেলা হয়েছে।
আগে বাংলার গ্রামেগঞ্জে, আনাচে-কানাচে ছিল অসংখ্য ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গল। সেখানে বাস করত রং-বেরংয়ের নানাজাতের পাখি। ফুটত কত জংলি ফুল। জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে সেই ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গল হারিয়ে গেছে। ¯্রােত হারিয়ে নদনদীগুলো এখন কচুরিপানার আবাসস্থল। গবাদিপশুর জন্য ঘাস তুলে নেয়ায় পায়ে চলা পথে বা বড় রাস্তার ধারে এখন আর সবুজ ঘাস পর্যন্ত দেখা যায় না।
জীবনানন্দ দাস যদি এখন বেঁচে থাকতেন তিনি কি আবারও লিখতে পারতেন, “ডুমুরের গাছে চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড় পাতাটির নিচে বসে আছে ভোরের দোয়েল পাখিÑ চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের অশ্বত্থের করে আছে চুপ, ফনিমনসার ঝোপে সটিবন তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে।” অথবা কি লিখতেন, ‘সোনালী ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়, শ্যামার নরম গান শুনেছিল।”
বাংলার সৌন্দর্য বাংলার সম্পদ। এ সম্পদ আমাদের রক্ষা করতে হবে। হারানো সম্পদগুলোকে ফিরিয়ে আনতে হবে। সে জন্য দেশ প্রেমিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দেশকে গণতন্ত্রের ধারায় নিয়ে আসতে হবে।
য় লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন