উপকূলীয় জেলা বরগুনায় একটানা কয়েকদিন যাবত প্রবল বর্ষণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। লোকালয়ের পাশাপাশি বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ায় নিমজ্জিত হয়েছে আমনের বীজতলা। তলিয়ে গেছে অসংখ্য মাছের ঘের। মাত্রাতিরিক্ত জোয়ারের পানি বৃদ্ধি ও অত্যাধিক বৃষ্টিপাতের কারণে নির্ণয় এলাকার ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বাসিন্দারা।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় বরগুনায় ২৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বঙ্গোসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় অতি বর্ষণ সৃষ্টি হচ্ছে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক মাহতাব হোসেন জানান, অতি বর্ষণে বরগুনার পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর—এই তিনটি নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে তিন ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে অতি বর্ষণের সঙ্গে ঝড়ো হাওয়ায় সৃষ্ট ঢেউয়ে জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে উপকূলীয় নদী তীরবর্তী এলাকার লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বরগুনার ছয় উপজেলার মধ্যে আমতলী, তালতলী, পাথরঘাটা ও বরগুনার সদরের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। ডুবে গেছে অসংখ্য মাছের ঘের।
তালতলী উপজেলার চরপাড়া গ্রামের আমজাদ আলী হাওলাদার বলেন, ‘পায়রা নদীতে ঢেউয়ের পরিমাণ আগেকার চেয়ে অনেক বেশি। পানির স্রোতেরও গতি তীব্র। নদী ভাঙ্গনের খেলা যেভাবে শুরু হয়েছে তাতে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাইতে বেশি দিন সময় লাগবে না।
পাথরঘাটা উপজেলার বিষখালী নদী তীরের বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, ‘দেওইর (বৃষ্টি) পানতে মোগো বাড়িঘর সব ডুইব্বা যাইতেছে। বাসার মইদ্দে পানি হানছে, এহন ঘরে বন্দি হইয়া পড়ছি মোরা।’
আমতলী উপজেলার নীলগঞ্জ গ্রামের মৎস্য চাষী জাহিদুল ইসলাম মিঠু মৃধা বলেন, প্রবল বৃষ্টির কারণে ঘের তলিয়ে কয়েক লক্ষ টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছি। বৃষ্টির মাত্রায় এভাবে অব্যাহত থাকলে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাব।
বরগুনার বড়ইতলা ফেরিঘাটের খেয়াচালক নাসির মিয়া বলেন, ‘বিষখালী নদীর এই এলাকায় জোয়ারের পানি অনেক বাইড়া গ্যাছে। ফেরির গ্যাংওয়েসহ সংযোগ সড়ক তলাইয়া গ্যাছে। মোরা খেওয়া চালাইন্না বন্দ রাকছি।’
এদিকে গত চার দিনের টানা ভারী বর্ষণে ফসলের মাঠ প্লাবিত হয়েছে। নিমজ্জিত হয়েছে আমনের বীজতলা। এছাড়া আমনের চাষাবাদও বন্ধ রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলায় এক লাখ ২২ হাজার ৯৯৪ হেক্টর জমিতে আমন চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এসব জমিতে আমন আবাদের জন্য ১৫ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে বীজতলা করা হয়। কিন্তু প্রবল বর্ষণের কারণে অধিকাংশ এলাকার বীজতলা এখন ডুবে আছে। এতে বীজতলার চারাগুলোতে পচন ধরার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া আমনের আবাদের মৌসুমে জমির চাষাবাদও বন্ধ হয়েছে।
বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, ‘আবাদ করনের জন্য বীজতলা তৈরি করেছিলেন প্রবল বৃষ্টির কারণে বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে এরকম অব্যাহত থাকলে পুনরায় তাদের পক্ষে চাষাবাদ করা সম্ভব হবে না।
কৃষকরা আরও জানান, প্রতি মন বীজ ধান ২ হাজার টাকা দরে ক্রয় করে তারা চাষাবাদ করেছিলেন। প্রবল বৃষ্টির কারণে তাদের বীজতলা ডুবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এত অধিক পরিমাণে টাকা দিয়ে বীজধান কিনে পুনরায় চাষাবাদ করা অনেক কৃষকের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাছাড়া গত বছর একর প্রতি যে পরিমাণ চাষাবাদ খরচ হতো তাদের দ্বি-গুণ এ বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত টাকা খরচ করে চাষাবাদ করা লাভজনক হবে না বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
অতি বর্ষণে কৃষকের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকূলীয় বরগুনা জেলার মাছ চাষিরা। বিশেষ করে নদী তীরবর্তী এলাকার ঘেরগুলোর অধিকাংশই বর্ষণের পানিতে ডুবে আছে। এসব ঘেরের মাছ জাল দিয়ে কোনোমতে আটকে রেখেছেন চাষিরা। তবে অধিকাংশ মৎস্য চাষিরা তাদের মাছ রক্ষা করতে পারেননি।
সদর উপজেলার আয়লা পতাকাটা ইউনিয়নের মৎসৎচাষি মনিরুল ইসলাম জসিম বলেন, ‘আমার ঘেরের অনেক মাছ বেরিয়ে গেছে। কোনোমতে জাল দিয়ে আটকে রাখার চেষ্টা করছি। বৃষ্টি না কমলে মাছ রক্ষা করার কোনও উপায় নেই।’
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী কায়সার আহমেদ বলেন, ‘আমাদের ২২টি পোল্ডারের ৮০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বেশকিছু এলাকায় ভাঙন কবলিত হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে আমরা সেসব এলাকার বাঁধ রক্ষায় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, 'উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের এলাকার খোঁজ-খবর রাখার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। অতি বর্ষণের কারণে সৃষ্ট প্লাবনের শিকার বাসিন্দাদের সরকারের পক্ষ থেকে যথাসম্ভব আশ্রয় ও খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন