শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

আল্লামা জালালুদ্দিন আলকাদেরী (রহ.)-এর জীবন ও কর্ম

প্রকাশের সময় : ২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১:২৫ এএম, ২ ডিসেম্বর, ২০১৬

মাওলানা মুহাম্মদ রেজাউল করিম
জন্ম ও মৃত্যু দুটোই আল্লাহর নিয়ামত। জন্মিলে তাকে অবশ্যই মৃত্যুর স্বাদ লাভ করতে হয়। পবিত্র কোরআন মাজিদে আল্লাহপাক এরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক আত্মা (নফস) মৃত্যুর স্বাদ লাভ করবে।’ এ মৃত্যু যদি হয় আল্লাহ এবং তদীয় রাসূল (দ.)- এর আদর্শ ও দ্বীন প্রচারের জন্য, তাহলে সে জীবন ও মৃত্যু দুটোই কল্যাণময়।
চট্টগাম জেলার পটিয়াস্থ চরকানাই গ্রামে আল্লামা জালালুদ্দিন আলকাদেরী (রহ.)-এর জন্ম। পিতা মরহুম আলহাজ অলি আহমদ চৌধুরী সরকারি কর্মকর্তা এবং মাতা মরহুমা সুফিয়া খাতুন অত্যন্ত দীনদার ও গুণবতী ছিলেন।
তিনি বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৯৭০ সালে কামিল হাদিস প্রথম শ্রেণী এবং ১৯৭১ সালে কামিল ফিক্হ প্রথম শ্রেণী ও সরকারি কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি কর্মজীবনের প্রথমে ১৯৭১ সালে দেশের বৃহত্তম দ্বীনি ও আধ্যাত্মিক সংস্থা আঞ্জুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত দেশের শীর্ষস্থানীয় দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার মুহাদ্দিস পদে যোগদান করে ১৯৮০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ সালের ১ মে একই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ পদে পদোন্নতি লাভ করে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করে অবসর গ্রহণ করেন।
তিনি একজন দক্ষ প্রশাসক, গুণী শিক্ষক ও বরেণ্য শিক্ষাবিদ ছিলেন। তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা, কর্মতৎপরতা, গভীর প্রজ্ঞা, সুনিপুণ ব্যবস্থাপনা, সময় নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ণতা সর্বমহলে প্রশংসিত। তিনি ছিলেন লক্ষ ছাত্রের প্রিয় শিক্ষক ও একান্ত অভিভাবক। মহানবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (দ.)-এর তিরোধানের পর দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব হক্কানী-রাব্বানী ওলামায়ে কিরামের উপর। জাহেরী ও বাতিনী ইলমের অধিকারী ওলামায়ে কিরামই সত্যিকার নায়েবে রাসূল। অধ্যক্ষ আল্লামা জালালুদ্দিন আলকাদেরী (রহ.) ছিলেন একজন প্রকৃত আলিমে রাব্বানীর প্রতিচ্ছবি। শরীয়ত, তরিক্বত, মারিফত ও হাকিকতের ইলম চতুষ্ঠয়ের গভীর তত্ত্বজ্ঞান ও রহস্যের ধারক ছিলেন তিনি ।
শুধু জাহিরী ইলম মানুষকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করে। তাই ইমাম গাজ্জালী (রহ.) এর মতে, ‘হক্কানী-রাব্বানী পীরের হাতে বায়াত হয়ে জাহিরী ও বাতিনী ইলম অর্জন করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে হয়।’ হজরত মুছা (আ.) নবী হয়েও হজরত খিজির (আ.)-এর নিকট হতে গুপ্ত রহস্য ও তত্ত্বজ্ঞান অর্জন করেছিলেন। অধ্যক্ষ আল্লামা জালালুদ্দিন আলকাদেরী (রহ.) যুগশ্রেষ্ঠ তাপস, গাউসে জামান, আলে রাসূল, রাহনুমায়ে শরীয়ত ও ত্বরিকত, আল্লামা হাফেয ক্বারী শাহসূফি সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.)-এর নূরানী হাতে বায়াত হয়ে আজীবন নিজ পীর মুর্শেদের ত্বরিকা (কাদেরীয়া ত্বরিকা) ও সিলসিলার খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন।
নবী করিম (দ.) এরশাদ করেন, “বনি ইসরাইল ৭২ দলে বিভক্ত ছিল। আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। তন্মধ্যে একদল ব্যতীত সবাই জাহান্নামী।” নাযাতপ্রাপ্ত দল হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত তথা সুন্নি জামাত। এ জামাতের প্রারম্ভে রয়েছেন নবীজি (দ.) এবং সর্বশেষ ইমাম মাহাদী (আ.)। আল্লামা জালালুদ্দিন আলকাদেরী (রহ.) সুন্নি মতাদর্শ প্রচার ও প্রসারে জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করেন।
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, “তোমরা (মানুষকে) হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আল্লাহর পথে আহ্বান কর।” অধ্যক্ষ আল্লামা জালালুদ্দিন আলকাদেরী (রহ.) একজন অনলবর্ষী বক্তা হিসাবে সুমধুর ভাষায়, সুললিত কণ্ঠে মানুষকে সুন্নিয়তের পতাকা তলে আহ্বান করে গেছেন সব সময়।
দেশের একজন খ্যাতিমান আলিম হিসাবে তিনি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ বোর্ডস অব গভর্নর, বাংলাদেশ জাতীয় খতিব কাউন্সিলের সভাপতি, বাংলাদেশ জমিয়তুল মোদার্রেছীন কেন্দ্রীয় পর্ষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট, জাতীয় ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য, আহলে সুন্নাত সম্মেলন সংস্থা (ওএসি)’র উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনন্য মুখপত্র মাসিক তরজুমানের সম্পাদক ছিলেন।
আহলে বায়াত তথা নবীজির বংশধরদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা ঈমানের দাবি। রাসূলে করিম (দ.) আহলে বায়াতকে হজরত নূহ (আ.) কিশতির সাথে তুলনা করে বলেছেন, “যারা এ কিশতিতে আরোহন করবে তারা নাযাতপ্রাপ্ত হবে, আর যারা বিরোধিতা করবে তারা ধ্বংস হবে।” অধ্যক্ষ আল্লামা জালালুদ্দিন আলকাদেরী (রহ.) চট্টগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদে ১৯৮৬ সাল হতে শোহাদায়ে কারবালার স্মরণে ১০ দিনব্যাপী শাহাদাতে কারবালা মাহফিল প্রবর্তন করে আজীবন এ মাহফিল পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। আহলে বায়াতের প্রতি তাঁর ভক্তি, শ্রদ্ধা ও মমত্ত্ববোধ ছিল অকৃত্রিম।
তিনি শুধু একজন বরেণ্য আলিম ও দক্ষ প্রশাসক ছিলেন না; একাধারে লেখক, গবেষক, ইসলামী চিন্তাবিদ ও উচ্চস্তরের মুসলিম দার্শনিক ছিলেন। তাঁর লিখিত বহু গ্রন্থের মধ্যে দরসে কোরআনে কারীম অন্যতম। সম্মোহনী নেতৃত্ব¡ আল্লাহ প্রদত্ত করুণা। অধ্যক্ষ আল্লামা জালালুদ্দিন আলকাদেরী (রহ.) সম্মোহনী নেতৃত্বে¡র অধিকারী ছিলেন। যারা তাঁকে একবার দেখেছে, তার প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছে।
ইশকে রাসূল (দ.) ঈমানের মূল। নবীজির প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মমত্ব¡বোধ পরকালে নাযাতের উছিলা। অধ্যক্ষ আল্লামা জালালুদ্দিন আলকাদেরী (রহ.) ছিলেন একজন সত্যিকার আশেকে রাসূল (দ.)। তিনি সকল মাহফিলে হজরত ইমাম আবদুর রহমান যামী (রহ.), দার্শনিক ড. আল্লামা ইকবাল (রহ.), হজরত ইমাম শরফুদ্দিন বুসরী (রহ.), হজরত সৈয়্যদ আজিজুল হক শেরেবাংলা (রহ.) ও আলা হজরত ইমাম আহমদ রেযা (রহ.) এর শে’র ও না’ত পরিবেশন করে দর্শক ও শ্রোতাদের নবীপ্রেমে বিভোর করতেন। তিনি কয়েকবার হজব্রত পালন ও নবীজির যিয়ারতে ধন্য হন।
একজন গুণী শিক্ষক হিসাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার-এর শিক্ষামন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০০১ ও ২০০৪ সালে শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়ে সম্মাননা ও স্বর্ণপদক লাভ করেন। উল্লেখ্য, বর্ণিত সালে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অত্র মাদরাসার ফকিহ্ মুফতি আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়ে সম্মাননা ও স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন।
মহানবী (দ.) এরশাদ করেন, “তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ, যার চরিত্র সুন্দর”। অধ্যক্ষ আল্লামা জালালুদ্দিন আলকাদেরী (রহ.) ছিলেন একজন সুন্দরতম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিত্ব¡। তাঁর সুন্দর আচরণ, মধুর ভাষা ও মমত্ববোধ মানুষকে বিমোহিত করত।
খতিবে বাঙ্গাল, বিশ্ব বরেণ্য এ আলিমে রাব্বানী ২ ছেলে ৫ কন্যা, লক্ষকোটি ভক্ত, ছাত্র ও পীর ভাই-বোনদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে ৭০ বছর বয়সে ২৬ নভেম্বর ২০১৬ রাত ১০টায় ঢাকাস্থ বারডেম হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে মাওলায়ে হাকিকীর ডাকে সাড়া দেন। যে জীবনের শুরু হয়েছিল ‘মসলকে আলা হজরত’ তথা সুন্নিয়ত প্রচারের মাধ্যমে; শেষনিঃশ্বাসও ত্যাগ করেছেন ‘মসলকে আলা হজরতের’ উপর। কতইনা সুন্দর  এ জীবন।
এ মনীষীকে ঢাকাস্থ কাদেরীয়া তৈয়্যবিয়া আলীয়া মাদরাসায় প্রথম জানাযা, বায়তুল মোর্কারম জাতীয় মসজিদে দ্বিতীয় জানাযা, চট্টগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদে তৃতীয় জানাযা ও তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মস্থল প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়ার ময়দানে স্মরণকালের বৃহত্তম চতুর্থ জানাযা শেষে জামেয়া সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতে উচ্চ মকাম দান করুন-আমীন।      
লেখক : সহকারী অধ্যাপক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান),জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, ষোলশহর, চট্টগ্রাম

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন