আল ফাতাহ মামুন : প্রায় ২০০ বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ (সরকারি) করার উদ্যোগের প্রথম ধাপে ২৩ প্রতিষ্ঠানের নাম কিছুদিন আগে চূড়ান্ত করা হয়। সরকারি কলেজ নেই এমন সব উপজেলায় উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির নীতিগত সিদ্ধান্ত থেকে উদ্যোগটি নেয়া হয়েছে। নির্বাচিত ২৩ প্রতিষ্ঠানের একটি ময়মনসিংহ ফুলবাড়িয়া কলেজ। ১৯৭২ সালে স্থাপতি কলেজটিতে সাতটি বিষয়ে অনার্স পড়ানো হয়। বর্তমানে এখানে পাঁচ হাজার ৩০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। অভিযোগ ওঠেছে, রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাবের কারণে পুরনো ও বড় কলেজ বাদ দিয়ে তুলনামূলক ছোট ও নতুন কলেজ সরকারি তালিকাভুক্ত হয়েছে। ফুলবাড়িয়া কলেজের বিপরীতে মননোয়ন পাওয়া বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিব মহিলা কলেজটি ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৩০০।
উপজেলার পুরনো ও বেশি ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করছে, এমন কলেজ জাতীয়করণ না করে যদি নামকাওয়াস্তে প্রতিষ্ঠিত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়, স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের মধ্যে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। সঙ্গত কারণেই জাতীয়করণ থেকে বঞ্চিত কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ জাতীয়করণের দাবিতে বেশ কিছু দিন ধরেই আন্দোলন চলছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য! এ ধরনের একটি অরাজনৈতিক ও জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট যৌক্তিক আন্দোলন দমনে পুলিশ নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে। কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে শিক্ষকদের বসার রুমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পিটিয়েছে পুলিশ। সেদিনের সহিংসতার শেষ হয়েছে দুজন নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে। রোববার ঘটে যাওয়া এ ঘটনাকে নির্মম ও বেদনাদায়ক বললেও কম বলা হবে মনে করে সচেতন বিবেক।
পুলিশের মারমুখী আচরণ এবং বেধড়ক পিটুনিতে কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের একজন শিক্ষক মারা গেছেন। এর সঙ্গে সাধারণ একজন ভ্যানচালক পথচারীও মারা গেছেন। আরো বহু শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রী আহত হয়েছেন। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, পুলিশ কলেজের ভেতরে গিয়ে শিক্ষকদের ওপর লাঠিপেটা করেছে। এখন তারা বলছে, ওই শিক্ষক আগেই হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন। প্রশ্ন হলো- হৃদরোগে আক্রান্ত একজন শিক্ষককে কীভাবে পুলিশ লাঠিপেটা করল? শুধু তা-ই নয়, ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ নিহত শিক্ষকের লাশও ক্যাম্পাসে নিয়ে আসতে দেয়নি! শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানোরও সুযোগ পেলো না- এ কেমন নির্মমতা! এ কেমন বর্বরতা? কী নির্দয় আচরণ।
অন্যান্য ক্ষেত্রে অভিযানের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে ধরনের সাফাই গেয়ে থাকে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতেই নাকি পুলিশ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মিছিলে বাধা দেয়। কিন্তু কতটা শান্তি রক্ষা হলো? তাদের বাধার কারণেই শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল ছোড়েন। মিছিলে বাধা দেয়ার আগে পুলিশ কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তথা উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভা চেয়ারম্যান প্রমুখের সঙ্গে আলোচনা করেছিল কি? জাতীয়করণের দাবিতে ময়মনসিংহের আন্দোলনরত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কী অপরাধ করেছিলেন যে হত্যাকা-ের মতো ঘটনা ঘটাতে হবে? কার বা কীসের স্বার্থে ‘শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা’র অজুহাতে দুটি প্রাণ কেড়ে নিতে হলো এবং আহত করা হলো অনেককে- এ প্রশ্ন এখন সবার।
ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ জাতীয়করণের এই আন্দোলন শুধু একটি কলেজ জাতীয়করণের আন্দোলন নয়, বরং অন্যায়ের প্রতিবাদও ছিল। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা পুরনো কলেজকে বাদ দিয়ে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত একটি কলেজ জাতীয়করণ করেছে। এ ক্ষেত্রে নিয়মকানুন মানা হয়নি। এ নিয়ে আন্দোলনকারীরা স্থানীয় সংসদ সদস্যের এমন কাজের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আমরা জানি, স্কুল-কলেজ জাতীয়করণে স্থানীয় সংসদ সদস্যরাই প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন। ফুলবাড়িয়ায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় প্রশাসন যে কঠোরভাবে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করেছে, এর পেছনেও সংসদ সদস্যের ভূমিকা থাকা বিচিত্র নয়।
দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ফুলবাড়িয়াতে বড় ধরনের বাড়াবাড়ি হয়েছে। একশ্রেণির পুলিশ যে কাউকেই মানুষ মনে করে না, এ ঘটনায় তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। অতীতে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ এমন ছিল, যখন সবাই ছাত্রদের স্নেহের চোখে দেখত। এমনকি পুলিশও ছাত্রদের প্রতি ছিল নমনীয়। আর শিক্ষকরা তো সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের কাছেই ছিলেন শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। আজ সেই মূল্যবোধ একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। যেসব পুলিশ ওই দিন ছাত্রদের ওপর লাঠি চালিয়েছেন, তারা কোনোকালে ছাত্র ছিলো বলে মনে হয়নি। মনে হয় না তারা কোনো শিক্ষকের কাছে কখনো পাঠ নিয়েছে। নিলে শিক্ষকদের ওপর অমন নির্মম লাঠিচার্জ করতে পারতো না তারা। পুলিশের লাঠিতে শিক্ষকসহ দু’জনের নিহত হওয়ার ঘটনায় আমাদের নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। পুলিশের বেপরোয়া আচরণ, মারকুটে স্বভাব, নানাবিধ দৌরাত্ম্য, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অপরাধপ্রবণতা রীতিমতো উদ্বেগজনক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। পুলিশকে এখন মানুষ বিশ্বাস করে না, আস্থায় নিতে চায় না। পুলিশ মানে আতঙ্ক, এরকম একটা বোধ তৈরি হয়েছে সবার মনে। যা একটি সভ্য দেশের জন্য বড় বেমানান।
ফুলবাড়িয়ায় শিক্ষকসহ যে দুজন মানুষ মারা গেলেন, তাদের ফিরিয়ে আনা যাবে না। কিন্তু দায়ী ব্যক্তিদের বিচার হলে অন্তত ভবিষ্যতে এ ধরনের অঘটন এড়ানো সম্ভব হবে। অতীতেও শিক্ষকদের ওপর করা অত্যাচার-নির্যাতনের সুষ্ঠু বিচার হয়নি। এর কারণ হলো, এসব ঘটনার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল। যে রাষ্ট্র শিক্ষা গুরুর মর্যাদা দিতে জানে না- সে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ যে কতটা অন্ধকার তা কেবল চিন্তাশীল ও বিশ্লেষকরাই ভালো বলতে পারবেন। কয়েকদিন আগে একজন শিক্ষককে কান ধরানোর প্রতিবাদে এক দল তরুণ কান ধরে প্রতিকী প্রতিবাদ জানিয়েছে। এবারো কি তারা শিক্ষক হত্যার প্রতিবাদে পুলিশি নির্যাতনে বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠবেন নাকি ‘দাড়িওয়ালা শিক্ষক’ বা অন্যকোন ট্যাগ/অজুহাত দিয়ে নীরব রইবেন- প্রশ্ন রইলো তরুণ সমাজের প্রতি।
লেখক : শিক্ষার্র্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ধষভধঃধযসধসঁহ@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন