তামান্না জেসমিন রিভা। রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি। নিজেকে কলেজের প্রিন্সিপালের চেয়েও ক্ষমতাধর মনে করেন তিনি। থাকেন কলেজের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের ১১০৭ নাম্বার কক্ষে। হল কর্তৃপক্ষ ও কলেজ কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় থেকে করে বেড়ান নানা অপকর্ম। কখনো সাধারণ শিক্ষার্থীদের রুমে গিয়ে তাদের থেকে চাঁদা দাবি করেন আবার কখনো হুমকি দেন হল থেকে বের করে দেয়ার। এসব ঘটনা জেনেও চুপ থাকেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। যেন এই কলেজে একাই একশো রিভা।
স¤প্রতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে করা আচরণ নিয়ে একটি অডিও ভাইরাল হয় রিভার। যেখানে নিজেকে কলেজের প্রিন্সিপালের চেয়েও ক্ষমতাধর দাবি করতে শোনা যায় রিভাকে। শিক্ষার্থীদের অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিতেও শোনা যায় উক্ত অডিও রেকর্ডে। এ ঘটনায় মূল ধারার গণমাধ্যমগুলোতে অনেকগুলো সংবাদ প্রচার হলেও রিভার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ কিংবা ছাত্রলীগের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে। ফলে পার পেয়ে যান রিভা।
এ ঘটনার পর গত মঙ্গলবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় ঘন্টা সংশ্লিষ্ট দুই শিক্ষার্থীকে নিজ কক্ষে আটকে রেখে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করেন রিভা। এর আগে অডিও ফাঁসের ঘটনায় জড়িত আরো দুইজনকে হল থেকে বের করে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। তাদেরকে এই মর্মে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয় যে, উক্ত অডিও রেকর্ড করার পেছনে কলেজ ছাত্রলীগের আরেক নেত্রী সুমনা মীমের ষড়যন্ত্র ছিল।কিন্তু বাস্তবে ওই শিক্ষার্থীরা নিজে থেকেই ওই রেকর্ড করেছিল বলে জানা যায়।
একই দিন সন্ধ্যায় সাড়ে ৬ ঘন্টা রুমে আটকে রেখে নির্যাতনের বর্ণনা সংক্রান্ত একটি ভিডিও ভাইরাল হয় গণমাধ্যমে। যার একটি ক্লিপ রয়েছে ইনকিলাবের হাতে। ভিডিওতে দেখা যায় দুই শিক্ষার্থী ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নির্যাতনের বর্ণনা দেন। তারা বলেন, স্বীকারোক্তি নেয়ার এক পর্যায়ে তাদেরকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে ভাইরাল করার হুমকিও দেন রিভা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্যাতনের বর্ণনা সংক্রান্ত এ ভিডিও গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর এবার হল ছাড়তে হলো বাকি দুই শিক্ষার্থীকে। ওছাড়াও নির্যাতনের তথ্য গণমাধ্যমে দেওয়ার অভিযোগে কয়েকজন ছাত্রলীগ নেত্রীকেও কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে হল প্রশাসন। এতসব নির্যাতনের ঘটনার পরেও রিভার বিচার না করে উল্টো শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দেওয়ায় হতবম্ব হয়েছে শিক্ষার্থীরা। কলেজ প্রশাসনকে এসব ইস্যুতে তাদের অবস্থান জানতে চাইলে তারা গণমাধ্যমে কথা বলতে অপারগতা দেখান বারংবার। গতকাল বৃহস্পতিবার একটি গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাতকার কলেজ প্রিন্সিপাল সুপ্রিয়া ভট্টাচার্যকে বলতে শোনা যায়, এসব ঘটনায় কোনো লিখিত অভিযোগ না পাওয়ায় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি কর্তৃপক্ষ।
নেটিজেনরা এসব ঘটনার সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলতে দেখা যায়, ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের এই নেত্রী কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে এসব অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন। এসব ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নিরবতার তীব্র সমালোচনাও করছেন ছাত্রলীগেরই একটি অংশ। এই ঘটনা ছাড়াও অতীতে অনেক বিতর্কিত কর্মকাÐের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে রিভা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলে জানিয়েছেন ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজ ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানান, রিভা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের অনুসারী। এছাড়া ইডেন কলেজের সার্বিক দায়িত্বে থাকা সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বেনজির হোসেন নিশির কাছের হওয়ায়, তার ছত্রছায়ায় রিভা এসব কর্মকাÐ নির্দ্বিধায় চালিয়ে যাচ্ছেন।
শুধু ছাত্রলীগই নয়, রিভার কর্মকাÐে কলেজ কর্তৃপক্ষও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদেরই হল থেকে বের করে দেয় কলেজ প্রশাসন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ইনকিলাবকে বলেন, এই কমিটি হওয়ার পরে মিছিল-মিটিংয়ে শিক্ষার্থীদের জোর করে নিয়ে যান রিভা। অসুস্থতার কথা বললেও কোনো ধরনের ছাড় দেন না তিনি। উল্টো তিনি, আইসিইউতে থাকলেও প্রোগ্রামে যেতে হবে বলে হুমকি দেন। এসব সমস্যা নিয়ে কর্মসূচিতে গিয়ে অসুস্থ্য হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। শোক দিবসে ধানমন্ডি ৩২-এ প্রোগ্রামে যাওয়ার পর এক শিক্ষার্থী হিট স্ট্রোক করে তিন ঘণ্টা বেহুশ হয়ে ছিলো। তাকে পরবর্তীতে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
শুধু শিক্ষার্থী নির্যাতনই নয়, রিভার বিরুদ্ধে রয়েছে হলের সিট বাণিজ্য, হল ও কলেজ ক্যান্টিন, ওয়াইফাই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং কলেজ সংলগ্ন ফুটপাতের দোকানগুলোতে চাঁদাবাজির অভিযোগ। জানা যায়, রিভার নেতৃত্বে গত এক মাসেই ওয়াইফাই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, কলেজ ও হল ক্যান্টিন এবং ফুটপাতের দোকান থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যে চলছে অন্ত:কোন্দল।
কলেজের একটি ক্যান্টিন থেকে রিভার অনুসারীরা ১ লাখ ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। এটি দিতে না চাইলে তার ক্যান্টিন বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয় তারা। পরে সেই ক্যান্টিন মালিক তার স্ত্রীর চিকিৎসার টাকা থেকে বড় অংকের একটা অংশ তাদের হাতে তুলে দেন। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও রেকর্ড এই প্রতিবেদকের কাছে এসেছে। তবে ভুক্তভোগীর নিরাপত্তার স্বার্থে তার নাম প্রকাশ করা হয়নি।
সভাপতি হওয়ার পর রিভার ইডেন কলেজের পাঁচটি হলের পঞ্চাশটি রুমের নিয়ন্ত্রণ আসে। এসব রুমে প্রথম বর্ষের কেউ উঠতে গেলে তাকে ১৫-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। মাস্টার্স শেষ করে হলে থাকতে হলে অবস্থাভেদে ২-৩ হাজার টাকা করে দিতে হয়। দুই হাজার টাকার কমে রিভা কারো কাছে সিট ভাড়া দেন না বলে জানিয়েছেন তার নিয়ন্ত্রণাধীন রুমে উঠা শিক্ষার্থীরা। এসব রুমে সব মিলিয়ে তিনশো›র বেশি শিক্ষার্থী থাকছেন বলে জানা যায়।
রিভা কর্তৃক শিক্ষার্তী নির্যাতনের প্রতিবাদে বুধবার সকাল নয়টায় কলেজে বিক্ষোভ মিছিল ও সংবাদ সম্মেলন করার কথা জানিয়ে গণমাধ্যমে একটি বার্তা পাঠান ইডেন কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়টি রিভা জেনে গেলে সব হলে তার নেতাকর্মীদের ফটকে অবস্থান নেওয়ার কথা বলেন। এতে ভয়ে শিক্ষার্থীরা এ কর্মসূচি পালন করতে পারেনি বলে জানান। সকালে ব্যর্থতার পর সন্ধ্যার দিকে আবার মিছিল করার প্রস্তুতি নিলে রিভা একই কাজ করেন। রিভার ভয় ও প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে মুখ খুলতে পারছেন না সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এসব বিষয়ে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা বলেন, এসবের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এসব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ। আমি আর নিতে পারছি না এসব।
ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেত্রী কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেনজির হোসেন নিশি বলেন, যেসব বিষয় উঠে এসেছে তা কোনোভাবেই সংগঠনের কারো থেকে কাম্য নয়। কিন্তু আগস্ট মাসে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়া আমাদের গঠনতন্ত্রে নেই বলে এখন কিছু করতে পারছি না। আগস্ট মাস শেষ হলে আমরা গঠনতান্ত্রিক উপায়ে বিষয়টি নিয়ে একটা সমাধানে আসব।
সার্বিক বিষয়ে ইডেন কলেজ প্রিন্সিপাল সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে একাধিকবার মুঠোফোনে ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন