জাতীয় পার্টি এখন কোন পথে? আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটি কোন দিকে হেলে পড়বে দলটি? ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো এবারও ক্ষমতার ‘উচ্ছিষ্ট ভোগ’ রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করবে; নাকি গণমানুষের ভোটের অধিকারের পক্ষ্যে থাকার নাটক করবে? এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক চলছে। নেটিজেনরা নানান মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছেন। দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রায় বছরখানেক ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৮১ বছর বয়সি রওশন এরশাদ দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে না জানিয়ে ২৬ নভেম্বর কাউন্সিলের আহ্বান করেছেন। এ কাউন্সিল ডাকার পরের দিন দলটির সংসদ সদস্যরা জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে জি এম কাদেরকে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে নিয়োগ দেয়ার আবেদন করেছেন। জাতীয় সংসদে বর্তমানে রওশন এরশাদবিরোধী দলীয় নেতা ও জিএম কাদের উপনেতা। এ নিয়ে দলটির ভেতরে তোলপাড় চলছে। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এ নিয়ে উৎসুক রহস্য।
জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী জাতীয় পার্টি জন্মের পর থেকে খুবই কম সময় গণমানুষের পক্ষ্যে থেকেছে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম এইচ এম এরশাদের ‘আনপ্রেডিকটেবল’ চরিত্রের কারণে দলটির প্রতি মানুষের বিশ্বাসের এই ঘাটতি। প্রবাদের ‘রাজা মিয়ার মাথায় বল কোন পক্ষের গোলপোষ্টে যাবে’ বলা মুশকিল, দলটির এই অবস্থা। ’৯০-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে জাতীয় নির্বাচন এলেই আলোচনায় চলে আসে জাতীয় পার্টি কোন শক্তির সঙ্গে থাকবে? এক সময় তৃণমূল পর্যায়ে কর্মী-সমর্থক থাকলেও ‘সুবিধাবাদী’ কৌশল এবং ‘ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগ’ দলটির গণভিক্তি কার্যত দুর্বল হয়ে গেছে। ফলে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে এখন দলটির প্রার্থী করার মতো নেতাকর্মী খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে জাতীয় নির্বাচনে ‘ফ্রন্ট ও জোট’ সংস্কৃতির সুবিধায় দলটি জাতীয় সংসদে বিরোধীদল হিসেবে রয়েছে। কিন্তু দলটির নেতারাও মাঝেমধ্যে স্বীকার করেন ‘জাতীয় পার্টির স্বাতন্ত্র পরিচিতি ক্রাইসিসে’ রয়েছে। দেশ-বিদেশের কেউ দলটিকে বিরোধী দল মনে করেন না; কেউ ডাকে সরকারের ‘নাচের পুতুল’ কেউ বলেন, ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাগুলো চায় সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতারাও তাদের দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে, আসন্ন নির্বাচন ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো বিজয়ী হওয়া সহজ হবে না। দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবারও জাতীয় পার্টিকে নিজেদের পাশে চেয়েছে। কিন্তু দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সম্প্রতি সময়ের বক্তব্য ক্ষমতাসীন দলের নীতি নির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলেছে। জিএম কাদের ‘ভারতপন্থি নেতা’ হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি গণমানুষের পক্ষ্যে অবস্থান নিয়ে বক্তৃতা বিবৃতি দিচ্ছেন। যা সরকারের বিপক্ষে যাচ্ছে এবং আগামীতে তাকে (জিএম কাদের) নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হতে পারে আশঙ্কায় দলের নেতৃত্বে রওশনকে বসিয়ে আওয়ামী লীগের ‘নাচের পুতুল’ করে রাখার চেষ্টা চলছে। ফলে জাতীয় পার্টিতে ফের ভাঙনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তাছাড়া রওশন এরশাদ ঘোষিত কাউন্সিল উপলক্ষে গঠিত কমিটিতে নাম রয়েছে পার্টির কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, আবু হোসেন বাবলা, মুজিবুল হক চুন্নু, সালমা ইসলাম। অথচ এরা সবাই জিএম কাদেরের সঙ্গে মিটিং করছেন এবং সংসদীয় দলের বৈঠক করে স্পিকারের কাছে জিএম কাদেরকে সংসদ নেতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফলে কে জিএম কাদেরের পক্ষে আর কে রওশন এরশাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির এক নেতা বলেছেন, দলটির সিনিয়র নেতা সবাই সুবিধাবাদী। এরা সরকারের উচ্ছিষ্ট খেতে যেমন চায়; তবে সরকার পড়ে গেলে জিএম কাদেরের সঙ্গে থাকবে।
জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, জাতীয় পার্টি খুবই ভালোভাবে চলছে। আমাদের দলে কোনো বিরোধ নেই। সবাই এক আছে এবং একসঙ্গে থাকবে। অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে চিন্তা করার কিছুই নেই।
এদিকে গতকাল দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের এমপি বলেছেন, রওশন এরশাদের নাম ব্যবহার করে তৃতীয় পক্ষ কোনো একটা এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। রওশন আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র, তিনি আমাদের শ্রদ্ধার আসনেই আছেন। রওশন এরশাদ শারীরিকভাবে অসুস্থ। তিনি সংসদে অংশ নিতে পারছেন না। বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারছেন না। আবার কখনো কখনো বেগম রওশন এরশাদকে দিয়ে কিছু মহল এমন কিছু বক্তব্য, বিবৃতি ও বিজ্ঞপ্তি দেয়ার ব্যবস্থা করছেন যা সার্বিকভাবে দলীয় অবস্থানের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। জাতীয় পার্টির সংসদীয় কমিটির সদস্যরা মনে করছেন অসুস্থতা ও বয়সের কারণে তিনি বিরোধী দলীয় নেতার ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না। কোনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতাসীন করতে নয়, আমরা দেশের মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য রাজনীতি করছি। কারো লেজুড়বৃত্তি করতে জাতীয় পার্টির রাজনীতি নয়। আমরা নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে রাজনীতির মাঠে থাকতে চাই।
জাতীয় পার্টিতে স্বামী-স্ত্রীর লড়াই, দেবর-ভাবির লড়াই, দেবর-পরিত্যাক্ত ভাবির লড়াই ইত্যাদি শব্দ অতি পুরোনো। ক্ষমতার গর্ভে জন্ম নেয়া দলটি কার্যত ‘মেরুদণ্ডহীন’ দলে পরিণত হয়েছে। এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির পুণর্জন্ম ঘটে ১৯৯১ সালে পহেলা জানুয়ারি। এরশাদ কারাবন্দি, গুলশান পার্কে মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে দলটি পথচলা শুরু করে। মিজান চৌধুরী কার্যক দলটির কাণ্ডারি হয়ে উঠেন। ১৯৯৩ সালে দলটি প্রথম ভাঙনের মুখে পড়ে। শামসুল হুদা চৌধুরী ও ডা. আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি জাতীয়তাবাদ গঠন করা হয়। অতপর, ১৯৯৭ সালে এরশাদ জেল থেকে বের হয়ে আসার পর নেতৃত্বে বিরোধে মাঠের আন্দোলনে অংশ নেয়া দলটি ১৯৯৮ সালে ভাঙনের মুখে পড়ে। কাজী জাফর আহমদ ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সম্মেলন করে পৃথক জাপা গঠন করেন। অতঃপর দলের মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রী অথচ এরশাদের নেতৃত্বে দল মাঠে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে চার দলীয় জোটের শরিক হিসেবে আন্দোলনে। এরশাদ মন্ত্রিসভা থেকে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে পদত্যাগ করার নির্দেশনা দিলে তিনি সে নির্দেশ অমান্য করে মিজানুর রহমান চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও নিজে মহাসচিব হয়ে দলকে দ্বিখণ্ডিত করে জাতীয় পার্টি (জেপি) গঠন করেন। বেগম খালেদা জিয়া, এইচ এম এরশাদ, অধ্যাপক গোলাম আজম ও সাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের যৌথ নেতৃত্বে চার দলীয় জোট আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পর সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়ে জামায়াতের সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করে। এরপর ফের বিএনপি বিরোধী আন্দোলনে এইচ এম এরশাদ আন্দোলনের (আওয়ামী লীগ) পক্ষে এবং রওশন এরশাদ ক্ষমতাসীন বিএনপির পক্ষে অবস্থান নেন। প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের বিপক্ষে এরশাদ অবস্থান নিলেও রওশন এরশাদ বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেন। তারেক রহমানের কাছে সে সময় রওশন এরশাদ কত টাকা নিয়েছেন তা নিয়ে পরে মুখরোচক গল্প শোনা গেছে। এক পর্যায়ে রওশন এরশাদ নিজেই দলের চেয়ারম্যান ও গোলাম মসিহকে মহাসচিব করে দল দ্বিখণ্ডিত করেন। এইচ এম এরশাদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারকে জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ সময় অদৃশ্য চাপে এরশাদ দলের চেয়ারমান পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেন। ওই সময় রওশন এরশাদ বিএনপির সঙ্গে ৪০ আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে স্বামী এইচ এম এরশাদ ও স্ত্রী রওশন এরশাদের মধ্যে একের পর এক বিরোধ লেগেই ছিল। তারা দীর্ঘ ২০ বছর পৃথক বাসায় বসবাস করেন। ওয়ান ইলেভেনের দু’বছর পর ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের নির্বাচনে এইচ এম এরশাদ ও রওশন এরশাদ আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে এরশাদের অংশগ্রহণের ঘোষণায় দলে ঘটে আরেক ভাঙন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ চলে যান এরশাদকে ছেড়ে; গঠন করেন জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর)। তিনি পরে যান ২০ দলীয় জোটে। কাজী জাফর, ড. টিআইএম ফজলে রাব্বী চৌধুরী, মোস্তফা জামাল হায়দাররা চলে যাওয়ার পর এরশাদ ও বেগম রওশন এরশাদের দ্বন্দ্বে দলটিতে দেখা দেয় অস্থিরতা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ দল। কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা, না করা নিয়ে দলের এরশাদ ও বেগম রওশন এরশাদের মধ্যে বিরোধ ওঠে তুঙ্গে। ‘পাতানো নির্বাচনে অংশ নিলে জনগণ মুখে থুথু দেবে’ এমন বক্তব্য দিয়ে এরশাদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন এবং ২১৭ প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। কিন্তু রওশন এরশাদ পর্দার আড়ালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে মোটা অর্থের বিনিময়ে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। দলে স্পষ্টত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরশাদপন্থি ও রওশনপন্থি দুটি উপদলের মধ্যে রওশনপন্থিরা ভোটে গিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসেন। এরশাদ একটি আসন থেকে নির্বাচিত হলেও ভোটে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেয়া তার অন্য অনুসারীরা জিততে পারেননি। ওই সময় এরশাদকে বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসা থেকে জোর করে তুলে নিয়ে একটি বিশেষ হাসপাতালে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত আটকে রেখে বাধ্যতামূলক চিকিৎসা দেয়া হয়। স্বামীকে আটকে রেখে নানা নাটকীয়তা ঘটিয়ে রওশন এরশাদ নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। নির্বাচনের পর এরশাদ ‘বাধ্যতামূলক’ চিকিৎসা থেকে ছাড়া পেয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানান, ভারতের ওই সময়ের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা শিং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার স্বার্থে তার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার পরামর্শ দেন। পরামর্শ না শোনায় তাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে এক মাস ধরে হাসপাতালে বাধ্যতামূলক চিকিৎসা দেয়া হয়। নির্বাচনের পর এরশাদকে ছেড়ে দেয়া হলেও রওশন এরশাদকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলী নেতা করা হয়। রওশনের অনুরোধে গোলাম মসিহকে সউদী আরবের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর থেকে জাতীয় পার্টির স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট হারিয়ে হয়ে যান আওয়ামী লীগের নাচের পুতুল। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে সহযোগী সংগঠনের মতোই আসন সমঝোতা করে এক সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেন। ওই সময় এরশাদ গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। দেশের এবং বেশির ভাগ সময় সিঙ্গাপুরে হাসপাতালের বেডে সময় কাটিয়েছেন এরশাদ। নির্বাচনের পর এরশাদকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা করা হলেও অসুস্থতার কারণে তিনি মাত্র একদিন সংসদ অধিবেশনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান। এরশাদ যখন গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে মাসের পর মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তখন স্ত্রী রওশন এরশাদ তাকে দেখতে যাননি। স্বামী-স্ত্রীর বিরোধের মধ্যেই এইচ এম এরশাদ তার ভাই জিএম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেন। এ নিয়েও রওশন এরশাদের সঙ্গে বিরোধ বাঁধে। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর রওশন অনুসারীরা দলে প্রভাবশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু জি এম কাদের হন দলের চেয়ারম্যান। রওশন এখন অসুস্থ। তিনি দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে দেশের বাইরে চিকিৎসাধীন। এই পরিস্থিতিতে দলের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি জি এম কাদেরের হাতেই। যদিও রওশনপন্থি হিসেবে এককালে পরিচিতি পাওয়া মুজিবুল হক চুন্নু এখন দলের মহাসচিব এখন। ৮১ বছর বয়সি রওশনের ফুসফুসের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) টানা ৮৪ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর গত বছর থাইল্যান্ড যান। সেখানে চিকিৎসা নিলেও সংসদ সদস্য পদ ধরে রাখতে বাজেট অধিবেশনে একদিন অংশ নিতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দেশে ফিরেছিলেন। বাসায় না উঠে হাসপাতাল থেকে সংসদে হাজিরা খাতায় সই দিয়ে তিনি ফের বিদেশে চিকিৎসার জন্য চলে যান। এর মধ্যে এইচ এম এরশাদের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী বিদিশা পৃথক জাতীয় পার্টি গঠন করেন। তিনি এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকী ও জন্মদিন পালন করছেন এবং এরশাদ ট্রাস্ট পরিচালনা করছেন। এর মধ্যে গত ৩১ আগস্ট জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে না জানিয়েই দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নতুন কাউন্সিলের আহ্বান করা হয়েছে। এ কাউন্সিল আগামী ২৬ নভেম্বর ২০২২ সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বর্তমানে থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসিহ রওশন এরশাদ স্বাক্ষরিক একটি চিঠি গণমাধ্যমকে পাঠান। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘আগামী ২৬ নভেম্বর জাতীয় পার্টির দশম কাউন্সিল আহ্বান করেছেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। সম্মেলন প্রস্তুত কমিটি গঠন করে রওশন এরশাদকে আহ্বায়ক করে ৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করেছেন। ওই কমিটিতে সদস্য সচিব করা হয়েছে গোলাম মসিহ। কাউন্সিল আহ্বানের চিঠিতে বলা হয়, আমি বেগম রওশন এরশাদ (এমপি) বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে জাতীয় পার্টির গঠনতান্ত্রিক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পার্টির দশম কাউন্সিল আহ্বান করছি। অন্যদিকে জি এম কাদেরের কার্যালয় থেকে জানানো হয়, দলের গঠনতন্ত্রের ধারা ১২ এবং উপধারা ১/২ অনুযায়ী কাউন্সিলের তারিখ, স্থান ও সময় প্রেসিডিয়াম কর্তৃক নির্ধারিত হবে। তা ছাড়া জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান যিনি প্রেসিডিয়াম এরও সভাপতি কর্তৃক কাউন্সিল অনুষ্ঠানের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। এর বাইরে কারও কাউন্সিল আহ্বানের এখতিয়ার নেই। দলটির কয়েকজন নেতা জানান, তারা গোলাম মসিহের দিয়ে কাউন্সিলের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশকে সন্দেহের চোখে দেখছেন।
কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএমএম আলম জাতীয় পার্টিতে যোগদান অনুষ্ঠানে রওশন এরশাদ জাপার কাউন্সিল ডাকার এখতিয়ার রাখেন না বলে পার্টির মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নুর দেয়া বক্তব্যের তীব্র বিরোধীতা করে গোলাম মসিহ বলেন, জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ধারা (২০) এর উপধারা (১) এর ক্ষমতাবলে পার্টির কাউন্সিল ডাকার সর্বময় ক্ষমতা প্রধান পৃষ্ঠপোষক সংরক্ষণ করেন। চুন্নুর প্রদত্ত বক্তব্য ধৃষ্টতামূলক ও শালীনতা বির্বজিত। তিনি ভুলে গেছেন, বেগম রওশান এরশাদের নেতৃত্বে চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্দেশনা মতে জাতীয় পার্টি ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে, তিনি মন্ত্রিত্বের দরজা দেখা তো দূরের কথা, এমপি হওয়ার সুযোগও পেতেন না।
আওয়ামী লীগ আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের জাতীয় পার্টিকে তাদের বি-টীম হিসেবে পেতে চায় এ জন্য রওশনের নেতৃত্বে দলকে দ্বিখণ্ডিত করার চেষ্টা করছে বুঝতে পেরে, পহেলা সেপ্টেম্বর জাতীয় পার্টির সংসদীয় দল পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দিয়েছে। রওশন এরশাদ আগামী ২৬ নভেম্বর দলের কাউন্সিল ডাকার একদিনের মধ্যেই জাপার সংসদীয় দল বৈঠক করে এই সিদ্ধান্ত নেয়ায় দলের মধ্যে বিভক্তি প্রকাশ হলো। এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, বিরোধীদলীয় নেতা অনেকদিন ধরে অসুস্থ। তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে সংসদেও ঠিকমতো আসতে পারছেন না। এজন্য সংসদীয় দল এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের সঙ্গে জি এম কাদেরের দ্বন্দ্ব পুরোনো। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নানা বৈঠকে দু’জন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। ৩ বছর আগে এরশাদের মৃত্যুর পর দলে কর্তৃত্ব নিয়ে জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের বিরোধে দলটি আবার ভাঙনের মুখে পড়ে। তখন সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে সমঝোতা হয়। সেই সমঝোতায় রওশনকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পাশাপাশি দলে প্রধান পৃষ্ঠপোষকের পদ দেওয়া হয়। আর কাদের দলের চেয়ারম্যানের পদ রাখার পাশাপাশি সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার আসন নেন।
আওয়ামী লীগের অনুকম্পায় সংরক্ষিত আসনসহ সংসদে সদস্য সংখ্যা ২৬ জন হলেও গণবিরোধী রাজনীতির কারণে দুটি নির্বাচন (২০১৪-২০২৮) নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে নজিরবিহীন সাফল্য দেখায় জাতীয় পার্টি। আন্দোলনের মুখে পতনের পর ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ৩৫টি আসন পায়। প্রায় দুই ডজন আসনে সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়। মোট ভোট পায় ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩২টি আসন লাভ করে। ২০০১ সালে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করে দলটি মাত্র ১৪টি আসন পায়। দুর্নীতির কারণে ওই নির্বাচনে এরশাদ প্রার্থী হতে পারেননি। শতকরা হারে ভোটের হার ছিল ৭ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের শরিক হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৭টি আসনে বিজয়ী হয়। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। সেই ভোটে আওয়ামী লীগের সমর্থনে জাতীয় পার্টি আসন পায় ৩৪টি। ভোটের শতকরা হার দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৩১ ভাগ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচনে আবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে জাতীয় পার্টি পায় ২৭টি আসন।
এখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাতাস হাওয়ায় উড়ার মধ্যে দলটি কোন পথে যায়, সেটাই এখন দেখার জন্য দেশবাসী অপেক্ষা করছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন