প্রবাদে রয়েছে ‘ওনি মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন’। এই প্রবাদটি যেন সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্য যুঁথসই উদাহরণ হয়ে গেছে। এইচ এম এরশাদ যেন মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন। ১৯৯৮ সালে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি স্ত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে দীর্ঘ ১৮ থেকে ২০ বছর লড়াই করছেন। এমনকি স্বামী-স্ত্রী দীর্ঘ এই সময় পৃথকভাবে বসবাস করেন। ২০০৭ সালে স্ত্রী তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে নিজেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। এমনকি স্বামী-স্ত্রীর বিরোধেই ২০১৪ সালে ‘পাতানো নির্বাচনে গেলে মানুষ আমার মুখে থুথু দেবে’ ঘোষণা দিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় নির্বাচনের আগে জোর করে ধরে নিয়ে হাসপাতালে এক মাস চিকিৎসা নিতে বাধ্য করা হয়। এমনকি ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে তাকে চিকিৎসা নিতে ‘সিংগাপুর-ঢাকা’ যাতায়াতে প্লেনেই বেশি অবস্থান করতে হয়।
জাতীয় পার্টি পুনঃজন্ম লাভ করে মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের পহেলা জানুয়ারি। সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের মুখে কারাবন্দি এরশাদ জেল থেকে চিঠি পাঠিয়ে জিনাত মোশাররফকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য করার নির্দেশনা দেন। তাকে রওশন এরশাদ বাধা দিলে রওশন এরশাদকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করতে বাধ্য হন। এ সময় জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী এরশাদকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, ‘আপনার এই অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের জন্য সারাজীবন আফসোস করবেন’। ১৯৯৭ সালে কারামুক্তির পর এরশাদ যত দিন বেঁচে ছিলেন আফসোসই করেছেন। ২০০৬ সালে জনগণের ভোটের দাবিতে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের পক্ষে এরশাদ যখন অবস্থান নেন; তখন রওশন এরশাদ সে সময়ের ক্ষমতাসীন বিএনপির পক্ষ্যে অবস্থান গ্রহণ করেন। বনানীর ‘হাওয়া ভবন’এ ছিল তার অবাধ যাতায়াত। ওই যে স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ শুরু হয় তা এরশাদের মৃত্যু পর্যন্ত ছিল। এমনকি রওশন এরশাদ ২০০৭ সালে স্বামী এরশাদকে দল থেকে বহিষ্কার করে নিজেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
এরশাদের মৃত্যুর পর দলের চেয়ারম্যান পদে অসীন হন জিএম কাদের। বড়ভাই এরশাদ মৃত্যুর আগে ছোটভাই জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান পদ উইল করে যান। এরপর জাতীয় পার্টির দীর্ঘদিন চলা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার লড়াইয়ের রুপান্তর ঘটে দেবর-ভাবির লড়াইয়ে। এরশাদের মৃত্যুর পর থেকেই এ লড়াই চলছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় পার্টি তুমি কার? এইচ এম এরশাদের জাতীয়তাবাদী ধারা ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী জনগণের পক্ষ্যের নাকি ক্ষমতাসীন সরকারের নাচের পুতুল হয়ে হালুয়া-রুটি খাওয়ার পক্ষে? তুমি স্বাতন্ত্র হয়ে থাকবে নাকি আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগের মতো সরকারের আঙ্গুলের নির্দেশে চলবে? এ নিয়ে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যেই চলছে বিতর্ক। দলটির সিনিয়র নেতাদের অনেকেই স্বীকার করেছেন ‘জাতীয় পার্টি এখন পরিচিতি ক্রাইসিসে ভুগছে’।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দল কোন দিকে থাকবে তা নিয়ে অন্তর্কোন্দল এবং দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আওয়ামী লীগের অনুকম্পার ওপর ভর করে পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে দলকে ক্ষমতার কাছাকাছি রাখবেন নাকি জনজণের ভোটের অধিকারের দাবিতে মাঠে নামবেন তা’ নিয়ে চলছে দেবর-ভাবির লড়াই। বিএনপি নেতাদের সঙ্গে এক টেবিলে জিএম কাদেরের বসা এবং দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কাউন্সিলের ঘোষণা নিয়েও চলছে নানা বিতর্ক। রওশন এরশাদকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতার পদ থেকে অব্যাহতির আবেদন এবং পরবর্তীতে মসিউর রহমান রাঙ্গার ডিগবাজি নিয়ে চলছে নানা। সমীকরণ।
রওশন এরশাদ প্রায় এক বছর ধরে থাইল্যান্ডে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার প্রহর গুণছেন। তিনি নভেম্বর মাসে দেশে ফিরবেন। রওশন এরশাদের সঙ্গে তার সাবেক সতীন বিদিশা সিদ্দিকও রয়েছেন বলে জানা গেছে। তার ডাকা আগামী ২৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য কাউন্সিলের প্রস্তুতিও চলছে জোরেশোরে। সিলেট, গাজীপুরসহ ১২ জেলায় কাউন্সিলের প্রস্তুতি কমিটিও হয়েছে। কাউন্সিল সফল করতে জেলায় জেলায় যাচ্ছেন রওশনপন্থী নেতারা। যদিও দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা রওশনের ডাকে সাড়া দেননি। অন্যদিকে জিএম কাদের প্রতিদিনই জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিতের দাবি এবং সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলছেন।
রওশনপন্থীদের দাবি, জাপা থেকে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন দলের এমন নেতারা যোগাযোগ না করলেও তৃণমূল থেকে আসছে ব্যাপক সাড়া। কিন্তু কাদেরপন্থীদের দাবি যারা দল থেকে পরিত্যাক্ত হয়েছেন তারাই রওশনের পক্ষ্যে রয়েছেন।
অন্যদিকে কাউন্সিলের তোড়জোড়কে পাত্তাই দিচ্ছেন না জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের। কাউন্সিল ও রওশন এরশাদকে নিয়ে যারা মুখ খুলছেন তাদের বহিষ্কার কিংবা আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন না দেওয়ার বার্তা দেয়া হচ্ছে। এরোই মধ্যে রওশন এরশাদ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকবেন। ইভিএমের মাধ্যমের নির্বাচনে অংশ নেবেন। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্যদিকে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, জাতীয় পার্টি আর কারো দালালি করবে না। এরশাদ প্রতিষ্ঠিত দল আর জনগণের কাছে আর দালাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে না। এরশাদ প্রতিষ্ঠিত দলটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকবে নাকি জনগণের ভোটের দাবিতে মাঠে নামবে এই ইস্যুতে রওশনের পক্ষ নেয়ায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ দলের সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় মসিউর রহমান রাঙ্গাকে। এর তিনদিন পর ১৭ সেপ্টেম্বর অব্যাহতি দেওয়া হয় চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধাকে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর জিএম কাদেরের উপদেষ্টা ও বরিশাল মহানগর জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক মহসিন উল ইসলাম ওরফে হাবুলকে দল থেকে কারণ দর্শানোর শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়। শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রংপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান একেএম আব্দুর রউফ মানিক আর ২ অক্টোবর ময়মনসিংহ জেলা জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. কে আর ইসলামকে পার্টি থেকে অব্যাহতি দেন দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
এর আগে হঠাৎ করেই গত ৩০ আগস্ট রওশন এরশাদ ২৬ নভেম্বর ডাকেন দলের কাউন্সিল। যদিও জিএম কাদেরের দাবি কাউন্সিল ডাকার এখতিয়ার রওশন এরশাদের নেই। রওশন এরশাদের ডাকা সম্মেলনের প্রস্তুতি সমন্বয়ের জন্য দলের ৬ জন কো-চেয়ারম্যানকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করা হয়। তারা হলেন- দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, আবু হোসেন বাবলা ও সালমা ইসলাম। কিন্তু এসব নেতা এখনো জিএম কাদেরের সঙ্গে রয়েছেন। তবে কাজী ফিরোজ রশিদ কোন পক্ষ্যে রয়েছেন তা এখনো পরিষ্কার নয়। কারণ রওশনের পক্ষ থেকে জিএম কাদেরকে উপনেতার পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে কাজী ফিরোজ রশিদকেও পদে বসানোর চিঠি স্পীকারকে দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যে গত ৬ অক্টোবর রওশনপন্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে জানায় কাউন্সিলের প্রস্তুতি চলছে। ওই সময় রওশন এরশাদের ধারণ করা বক্তব্য শোনানো হয়। রওশন এরশাদ বলেন, আমি দেশে আসবো নভেম্বর মাসে। আওয়ামী লীগের অধীনে ইভিএমে নির্বাচনে অংশ নেব। আমরা ফাইভ জি ব্যবহার করছি, এখন ইভিএম ব্যবহার করতে মানা কোথায়? কারণ, যারা ইলেকশনে জিতে যায় তারা বলে, ইলেকশন ফেয়ার হয়েছে; আর যারা হেরে যায় তারা বলে ইলেকশন ফেয়ার হয়নি। ইভিএমের মাধ্যমে তারা ভোট কারচুপি করেছে। অবশ্যই ইভিএমের মাধ্যমে ইলেকশন করব।
অন্যদিকে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের জাতীয় পার্টির কাউন্সিল ঘোষণা প্রশ্নে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আমি জাতীয় পার্টির মহাসচিব, আমার জানা মতে কোনো কাউন্সিল নেই। কে কোন কাউন্সিল করলো, এটা নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই, সম্পর্কও নেই।
এইচ এম এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি নিয়ে তার ভাই জিএম কাদের ও স্ত্রী রওশন এরশাদের মধ্যে যে টানাটানি হচ্ছে তা নিয়ে দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে শেকড় পর্যায়ের নেতারা বিরক্ত। তারা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরছেন। তবে বেশির ভাগ নেতার বক্তব্য জিএম কাদের যে জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন সেটাই দলকে সুসংগঠিত করতে পারে। আর কিছু সুযোগ সুবিধা নিয়ে দলকে আওয়ামী লীগের বি-টীম হিসেবে নাচের পুতুল হলে এরশাদের গড়া দলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। তবে বেশির ভাগ নেতাকর্মীরা জানান দল কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে তারা এখনো অন্ধকারে রয়েছেন। স্যার (এরশাদ) মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন। না হলে এখন তাকে স্ত্রীর সঙ্গে লড়াই করে হয় হাসপাতালে বাধ্যতামূলক চিকিৎসা নিতে হতো নয়তো জেলে যেতে হতো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন