বাংলা ব্যাকরণের ভাব সম্প্রসরণে ‘গরীবের বউ সবার ভাবি’ নামে একটা শব্দ রয়েছে। প্রবাদটি এ রকম গরীবের বউ সুন্দরী হলে তিনি যেন সবার ভাবী হয়ে যায়। এইচ এম এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির অবস্থা হচ্ছে সেই রকম। সারাদেশে দলটির কিছু নেতাকর্মী এবং জাতীয় সংসদে কয়েকটি আসন থাকায় দলটিকে নিয়ে খেলা হচ্ছে; সবাই নিজেদের ‘ভাবি’ হিসেবে পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
আবার দলটিতে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যেও নানান অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে। এতে করে এরশাদের দুর্নাম ‘আনপ্রেডিস্টেবল’ শব্দটির নতুন ভাব আবির্ভাব ঘটেছে। দলটির একটি অংশ সরকারের ‘নাচের পুতুল’ অভিনয়ের মাধ্যমে ‘কিছু পাওয়ার’ প্রত্যাশায় মরিয়া। আবার কেউ কেউ জনগণের কাতারে যাওয়ার নাটক করছেন। মাঝখানে তৃতীয় পক্ষ থেকে এরশাদ পরিবারের দুই বটবৃক্ষ বেগম রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। দলের কান্ডারি হিসেবে পরিচিত প্রবীন রাজনীতিক মিজানুর রহমান চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে যাওয়া এবং ১৯৯৮ সালে এইচ এম এরশাদ দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে জাতীয় পার্টির নীতি-আদর্শ বোঝাই কঠিন হয়ে গেছে। তবে এইচ এম এরশাদ মৃত্যুর আগে ছোট ভাই জিএম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান পদ ‘উইল’ করে গেছেন। এখন রওশন এরশাদকে ঘিরে দল থেকে পরিত্যাক্ত এক ঝাঁক সুবিধাভোগী সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। অসুস্থ বয়োব্দ্ধৃা রওশন তাদের থামাতে পারছেন না। অন্যদিকে তিনি পুত্র রাহগির আলমাহি সাদকে কো-চেয়ারম্যান করা পদে বাসানোর চেস্টা করছেন। জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান হলেও দলটি আসলে কে চালায় সে সম্পর্কে নেতাকর্মীরা অন্ধকারে।
সম্প্রতি জিএম কাদেরের উপর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত। এ নিয়ে নি¤œ আদালত হাইকোট, আপিল বিভাগ হয়ে সেই ‘নিষেধাজ্ঞা’ বলবৎ রয়েছে। এর মধ্যেই দলটির নেতৃত্ব নিয়ে চলছে নানান নাটক। আসলে জাতীয় পার্টি কে চালায় তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। যদিও দলটির সুবিধাবাদী নেতারা জাপার একের পর এক নাটক ও বিরোধকে ‘দেবর ভাবি’র বিরোধ এবং পারিবারিক মান অভিমান হিসেবে চালিয়ে দিলেও দেশের রাজনীতিতে দলটি দাবার ঘুঁটি হয়ে গেছে।
দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী জাতীয় পার্টির কোনো নিজস্বতা নেই। দলটি গত ১০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এরশাদ ভক্তরা এটার নাম দিয়েছেন আওয়ামী লীগের বি-টীম। এরশাদ নিজেই এবং বর্তমানের কয়েকজন নেতা প্রকাশে বহুবার বলেছেন পরিচয় ক্রাইসিসে ভুগছে। তারপরও দলটির নীতি নির্ধারকরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দলটির মুরুব্বী মানেন। কিছুদিন আগে দলটির বহিস্কৃত ও পরিত্যাক্ত নেতারা একত্রিত হয়ে জাতীয় কাউন্সিলের ডাক দিয়েছিলেন। পরে সেটা স্থগিত করা হয়। একজন বহিস্কৃত নেতা জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আদালতে মামলা করেছেন। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার রওশন এরশাদ, জিএম কাদের ও রওশন পুত্র রংপুর-৩ আসনের এমপি রাহগির আলমাহি এরশাদ সাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন। সেখানে কি আলোচনা হয়েছে সেগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। তবে দলটির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে একের পর এক নাটক চলছে।
দলটির নেতৃত্ব ইস্যুতে সর্বশেষ নাটক হয় গত ১৪ ডিসেম্বর বুধবার রাতে। রাত পৌনে ১০টার দিকে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়েছে এমন প্রেস বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে দেয়া হয়। কিন্তু পৌনে এক ঘণ্টা পর বিরোধীদলীয় নেতার প্রেস উইং পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বেগম রওশন এরশাদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার ঘোষণাটি স্থগিত করা হয়েছে।
রওশনপন্থিরা বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, দলীয় কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে জাপার সংখ্যাগরিষ্ঠ কো-চেয়ারম্যানের সমর্থনে বিরোধীদলীয় নেতা রওশনকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জি এম কাদের নিষেধাজ্ঞা মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রওশন এরশাদ দায়িত্ব পালন করবেন। বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, জাপার কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এবং সালমা ইসলামের মতামতে আইনি জটিলতা নিরসন না হওয়া পর্যন্ত রওশন এরশাদ দায়িত্বে থাকবেন।
রওশনপন্থিদের বিজ্ঞপ্তিতে আরো দাবি করা হয়, প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম এবং নাছরিন জাহান এমপি (রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী) ও রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তবে শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
পরে দ্বিতীয় বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার ঘোষণাটি স্থগিত করা হয়েছে। কেনো ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হলো আর কেনোই বা স্থগিত করা হলো, তা নিয়ে মুখ খোলেননি রওশনপন্থি গোলাম মসিহ, কাজী মামুনুর রশীদ কেউ।
জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, দলের কাউন্সিলে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবে। ২০ (২) উপধারার খ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে দলীয় চেয়ারম্যান সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান বা কো-চেয়ারম্যানদের মধ্যে একজনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মনোনীত করতে পারবেন। অন্যথা প্রেসিডিয়াম সদস্যদের একজনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পারবেন। এ নিয়ে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের বলেছেন, গঠনতন্ত্রে তো পরিষ্কার ভাবে বলাই আছে, একমাত্র জি এম কাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মনোনীত করার ক্ষমতা রাখেন। রওশন এরশাদ জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগই নেই। তাঁকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা অবৈধ ও গঠনতন্ত্র বিরোধী। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা স্থগিতেরও মূল্য নেই।
জাতীয় পার্টির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, জাতীয় পার্টির বৈধ চেয়ারম্যান জিএম কাদের। দলের যে কয়জন সিনিয়র নেতা (কো-চেয়ারম্যান) রয়েছেন তারা সবাই জিএম কাদেরের পক্ষ্যে থাকলেও ভিতরে ভিতরে সরকারের সুযোগ সুবিধার প্রত্যাশায় রয়েছেন। জাতীয় পার্টির নেতারা বাইরে কে কি বললেন সেটা নিয়ে দলটির কর্মকৌশল বোঝা যাবে না। পর্দার অন্তরালে কি হচ্ছে সেটাই খবর। বর্তমানে পরিত্যাক্ত নেতারা রওশন এরশাদকে ব্যবহার করে কিছু করে খাওয়ার চেষ্টা করছেন। এ জন্যই এতো নাটক। তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকার চেস্টা করছেন। কিন্তু রাজনীতির বাতাস উল্টে গেলে আওয়ামী লীগ এদের হারিকেন দিয়ে খুঁজেও পাবে না। তখন দেখা যাবে এরা তারেকের লোকজনের সঙ্গে ঘুরছে। জাতীয় পার্টি থেকে পদত্যাগ করেছেন এমন একজন নেতা বলেন, দেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি দু’দলেরই ভাবি হচ্ছে জাতীয় পার্টি। কিন্তু জাতীয় পার্টি কাল খালু নির্বাচন না এলে বোঝা যাবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন