সোমবার ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৩ রবিউল সানী ১৪৪৬ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

জাতীয় পার্টির ‘প্রাণ’ আওয়ামী লীগে

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০১ এএম

‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ, সুরের বাঁধনে/ তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। কবির কবিতার মতোই জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রাণ বেঁধেছে। ফলে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিতের দাবিতে রাজপথের আন্দোলন, সংগ্রামে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা, জেল-জুলুম-মামলা-হামলা-কারাগার কোনোটির ভয় নেই জাতীয় পার্টির। জনগণের অধিকার রাস্তায় লুটোপুটি খেলেও ক্ষমতার হালুয়া-রুটির সামান্য উচ্ছিষ্ট পেলেই খুশি। ফলে কোলের শিশু যেমন বাবা-মায়ের কোলে নিরাপদ; জাতীয় পার্টি তেমনি নির্ভাবনায়। চলার পথে ঝড়ঝঞ্ঝায় পড়লে বাবা-মায়ের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেলেও সন্তানকে বুকে আগলে রাখেন। জাতীয় সংসদের গৃহপালিত বিরোধী দল এবং টিআইবির ভাষায় ‘সরকারের নাচের পুতুল’ জাতীয় পার্টিকে রাজনৈতিক ডামাডোলে ‘আগলে’ রাখার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। বিনিময়ে জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বি-টীম হিসেবে দেশে-বিদেশে ভুমিকা রাখবে। বিনিময়ে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট পাবে। পর্দার আড়ালে এমন সমঝোতা হওয়ায় দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ এমপি ও চেয়ারম্যান জিএম কাদের এমপির বিরোধ মিটে গেছে। আগামী ১৯ জানুয়ারি জিএম কাদেরের বিরুদ্ধের মামলার নিষ্পত্তির দিন ধার্য করেছেন আদালত। এর আগে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেবর জিএম কাদের ও ভাবি রওশন এরশাদ একসঙ্গে দেখা করেছেন এবং ৯ জানুয়ারি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। ১১ জানুয়ারি সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান নিরপেক্ষ নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশী চাপ রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে জাতীয় পার্টিকে ‘ঘাবড়াবেন না’ পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

২০১৪ সাল থেকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগের ‘নাচের পুতুল’ খ্যাত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের হঠাৎ করে জনগণের দাবি দাওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিপ্লবী হয়ে উঠেন। সরকারের দুর্নীতি, অর্থনৈতিক দূরবস্থা, মেগা প্রকল্পে দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে ‘গরম গরম’ কথাবার্তা বলে নিজেকে জনগণের নেতা হিসেবে পরিচিত করে তোলার প্রয়াস পান। কিন্তু অসুস্থ রওশন এরশাদ বিদেশে থেকেই জাতীয় পার্টিকে ‘সরকারের আজ্ঞাবহ’ দল হিসেবে পরিচালিত করার দৃঢ় অবস্থান নেন। ফলে পৈত্রিক সম্পত্তি হিসেবে জাতীয় পার্টির কর্তৃত্ব নিয়ে দেবরভাবির বিরোধ বেঁধে যায়। এ অবস্থায় রওশন এরশাদ বিদেশে থেকেই ২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির কাউন্সিল আহবান করেন। দলের এমপিরা এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতার পদ থেকে রওশনকে সরিয়ে চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নাম প্রস্তাব করা হয়। এ নিয়ে নাটক-পাল্টা নাটকের পর গত বছরের ৮ নভেম্বর জিয়াউল হক মৃধা এবং ১৬ নভেম্বর মশিউর রহমান রাঙ্গা জিএম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান পদের দায়িত্ব পালনের অব্যহতি চেয়ে আদালতে মামলা করেন। আদালত জিএম কাদেরের ওপর দলীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই মামলা জজ আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ হয়ে ফের জজ কোর্টে ফিরে আসে। গত ১১ জানুয়ারি ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ মাসুদুল হকের আদালতে মামলা দুটি খারিজের আবেদনের ওপর বাদী ও বিবাদী পক্ষের শুনানি হয়। এ বিষয়ে আদেশের জন্য আগামী ১৯ জানুয়ারি দিন ধার্য করেছেন আদালত।
এর আগে ৯ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ এমপি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এমপি এক যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তারা দুজনেই ঐক্যবদ্ধ আছেন। জাতীয় পার্টিতে কোনও বিভক্তি নেই। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ‘কিছুদিন ধরে গণমাধ্যমে জাতীয় পার্টির বিভক্তি সম্পর্কিত বিভ্রান্তিকর কিছু খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ এমপি ও আমি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এমপি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে, জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভক্তির প্রশ্নই ওঠে না। বরং আমরা দুজনেই ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের মরহুম নেতা সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে বদ্ধ পরিকর।’ এতে আরো বলা হয়, ‘আমরা দুজনেই পার্টিকে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। সংবিধান অনুযায়ী অনুষ্ঠেয় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণ করবে এবং সে লক্ষ্যে ৩০০ আসনেই প্রার্থী প্রদান করার জন্য পার্টিকে সুসংগঠিত করার প্রত্যয় ঘোষণা করছি। আমরা পার্টির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে পার্টিকে আরো শক্তিশালী করার আহŸান জানাচ্ছি।’

আগামী দিনের ক্ষমতার উচ্ছিষ্টের প্রত্যাশায় দেবর-ভাবির বিরোধ নিষ্পত্তির মধ্যেই জাতীয় পার্টির নেতাদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-জাতিসংঘসহ বিদেশীদের সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরামর্শ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বে ৫৪টি দলের যুগপৎ আন্দোলনে প্রকম্পিত রাজপথের দৃষ্ট দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠেন। গত কয়েক মাস থেকে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে জনসমাগম, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগ মাঠের জনসমুদ্রের দৃশ্য, ১১ জানুয়ারি বিএনপির নেতৃত্বে গণঅবস্থান কর্মসূতিতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর যুগপৎ কর্মসূচি পালন। একই দিনে পাল্টা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্মসূচি পালন এবং রাজপথ দখলে রাখার ঘোষণায় ভীত হয়ে পড়েন ২০১৪ সাল থেকে ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী জাতীয় পার্টির এমপিরা। তাদের আশঙ্কা যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-জাপান-কানাডা-ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী দেশ ও জাতিসংঘের চাপে সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো পাতানো নির্বাচন করতে পারবে না। নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রয়োজনে বিদেশী চাপে বাধ্য হয়েই বর্তমান সরকারকে নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তখন জাতীয় পার্টির কি হবে? তাছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজপথে বিএনপিকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করলে রক্তারক্তি ঘটনা ঘটলে ওয়ান ইলেভেনের মতো সরকার ক্ষমতা দখল করতে পারে। এ আশঙ্কা থেকেই গত ১১ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির এমপি ফখরুল ইমাম ‘ওয়ান-ইলেভেনের’ কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন রাখেন, এক-এগারোর দেশের যে পরিস্থিতি আমরা জানি, আমাদের দেশে প্রজ্ঞাবান নেতা আছে, অনুধানের ক্ষমতা যে ক্ষমতা- এক এগারোর আসবে না আবার; তবুও আমার জিজ্ঞাসা, সব পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার লক্ষ্যে পা বাড়ানোর বোধ হয় এখনই সময়। আপনি (প্রধানমন্ত্রী) কী মনে করেন?’ জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফখরুল ইমামকে না ঘাবড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘ঘাবড়ানোর কিছুই নেই, এটুকু বলতে পারি। ঘাবড়াবেন না, আমরা আছি না? কোনো চিন্তা নেই।’ প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসবাণী শুনেই জাতীয় পার্টির সুবিধাভোগী নেতা ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের হিরক রাজার দেশে সিনেমার মতো ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে/ শাখে শাখে পাখি ডাকে/ কত শোভা চারিপাশে’ আজকে মোদের বড়ই সুখের দিন’ অবস্থা। গত দু’দিন দলটির বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে দেশের রাজনীতি এবং জাতীয় পার্টির অবস্থান সম্পর্কে কথা বললে, তারা জানান, জাতীয় পার্টি ২০১৪ সালে আত্মপরিচয় হারিয়েছে। কিছু সুবিধাবাদী নেতার ব্যাক্তিগত স্বার্থের জন্য জনগণের সঙ্গে দলটির সম্পর্ক রাখেনি। দলটে আওয়ামী লীগের বি-টীম বানিয়েছে। অপ্রিয় হলেও সত্য এখন জাতীয় পার্টির প্রাণ হচ্ছে আওয়ামী লীগ। সত্যিকার অর্থে জিএম কাদের জনগণের অধিকারের কথা বলুক আর কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় জনগণের অধিকার আদায়ে বিপ্লবী কথাবার্তা বলে নাটক করুক দলটির কোনো নিজস্বতা নেই। আওয়ামী লীগ যেভাবে চাইবে জাতীয় পার্টি সেভাবেই চলবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন