সরকারী দপ্তর ও প্রকল্প কার্যক্রমের জন্য বিভিন্ন কোম্পানীর মাধ্যমে আউটসোর্সিংয়ে জনবল নেওয়া হয়। সেই জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়াকে বানচালকে করছেন একটি চক্র। জাল অভিজ্ঞতা সনদ দিয়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প আটকানোর পাঁয়তারা করছে একটি চক্র । নতুন টেন্ডারের জন্য পুরাতন কাজের অভিজ্ঞতা সনদে ব্যবহার করা হয়েছে মৃত ব্যক্তির স্বাক্ষর। অথচ অভিজ্ঞতা সনদের সেই প্রকল্পের পরিচালক গত ২০২০ সালে মারা গেছেন। মৃত্যুর প্রায় ১বছর পর সেই পিডির স্বাক্ষর জাল করে ২০২১ সালে ব্যবহার করেছেন অর্থ প্রাইভেট লিমিটেড। বাংলাদেশ আউটসোসিং এসোসিয়েশনের পরিচালক মাজহার’ল ইসলামের দেওয়া যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর বরাবর এক লিখিত অভিযোগ এসব তথ্য জানা গেছে। জাল স্বাক্ষরকারীর অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে।
গত বছরের ৩ আগস্ট প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহিষ উন্নয়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়) প্রকল্প পরিচালক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম ‘অর্থ করোরেশন’কে একটি অভিজ্ঞতা সনদ দেন। সেখানে প্রতিষ্ঠানটির কাজের মান সন্তোজ জনক লেখা হয়। সেই অভিজ্ঞতা সনদ লেখার ধরণ ঠিক থাকলেও প্রকল্প পরিচালকের স্বাক্ষর ও সীল নিয়ে আপত্তি বাদে। কারণ তিনি সেই স্বাক্ষরের এক বছর পূর্বেই মারা গেছেন। ২০২০সালে ১০মে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ডা. মো. রফিকুল ইসলাম রাত ১০টায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন।
ডা. মো রফিকুল ইসলামের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পাদ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. ইফতেখার হোসেন। তিনি বলেন, মহিষ উন্নয়ন প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ডা. রফিকুল ইসলাম ২০২০সালের ৫মে মারা গেছেন। বর্তমানে প্রকল্পের পরিচালক ডা. মো. মুহসীন তরফদার রাজু অভিজ্ঞতা সনদের বিষয়ে সঠিক যাছাই করে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রকল্পের পিডিকেএকটি চিঠি দিয়েছেন। সেখানে আর্থ প্রাইভেট লিমিটেড বিষয়টি সঠিক নয়, বরং প্রকল্পটি পাথমার্ক এসোসিয়েটস লিমিটেড সাথে চুক্তিবদ্ধ বলে জানান।
সূত্র মতে, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে ব্যাপক প্রযুক্তি নির্ভর সমন্বিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা (৩য় পর্যায়ে) প্রকল্পের আউটসোসিং জনবল সংগ্রহে ব্যাপারে টেন্ডার দেন মন্ত্রণালয়। সেখানে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অংগ্রহণ করেন। তার মধ্যে অর্থ প্রাইভেট লিমিটিডও আছে। প্রকল্পে জনবল সংগ্রহে কোম্পানী ও ভাড়ায় ১টি গাড়ি সংগ্রহ অনিয়মের অভিযোগ করেন দুইটি প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো- গাল্ফ সিকিউরিটি সার্ভিস লিমিটেড ও অর্থ প্রাইভেট লিমিটেড। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৮ আগস্ট মন্ত্রণালয় দুই সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছন। তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন- যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব কাজী মোশতাক জহির ও সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আব্দুল মালেক। ৫কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিলের নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে ব্যাপক প্রযুক্তি নির্ভর সমন্বিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা (৩য় পর্যায়) প্রকল্পে ৫লটে ৪৮টি কোম্পানী টেন্ডারে অংশ নেন। সেখান থেকে ৫টি কোম্পানীকে নোয়া (কাজের অনুমতি) দেয়া হয়।
সেই তদন্ত কমিটির ঘোষণার পরপর অর্থ প্রাইভেট লিমিটেড নামে বেশ কয়েকটি অভিযোগ উঠেছে। মন্ত্রণালয়ে এরই মধ্যে কয়েকটি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ সূত্র মতে, অর্থ প্রাইভেট লিমিটিডের কাজল বিশ্বাস নিজেই জাল অভিজ্ঞতা সনদ দিয়ে দরপত্র জমা দিয়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের আউটসোর্সিং জনবলের নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য ভুয়া আবেদন করে স্থগিত করে রাখতে চায়। অথচ আর্থ প্রাইভেট লিমিটেড যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে ব্যাপক প্রযুক্তি নির্ভর সমন্বিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা (৩য় পর্যায়) প্রকল্পে যেসব অভিজ্ঞতা সনদ জমা দিয়েছে তা সবই ভুয়া। যে প্রকল্প পরিচালকের স্বাক্ষরের ২০২১ সালের অভিজ্ঞতা সনদ জমা দিয়েছে। টেন্ডার না পেয়েই প্রতিষ্ঠানটি এমন অভিযোগ তুলেছেন বলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো দাবী করছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে অর্থ প্রাইভেট লিমিটেড ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজল বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা সেই টেন্ডারে অংশ নিয়েছিলাম। আমাদেরকে ননরেসপন্সিপ করছে।’ জাল অভিজ্ঞতা সনদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ২২টি অভিজ্ঞতা সনদ দিয়েছিলাম। তার মধ্যে মহিষ উন্নয়ন প্রকল্পের টা ছিল। যুব উন্নয়নের প্রকল্প পরিচালক ৪ আগস্ট ৫টি কোম্পানীকে নির্বাচিত কাজের জন্য চিঠি দিয়েছেন। আমি যখন অভিযোগ করেছি তখন আমার বিরুদ্ধে ইস্যু তৈরী করার জন্য উনি (প্রকল্প পরিচালক) ২২ আগষ্ট আমার কাগজপত্র সঠিক আছে কী না তার জন্য চিঠি দেয়। যা পিপিআর এর আইন লঙ্ঘন। সে এটা করতে পারে না। জাল অভিজ্ঞতা সনদটি তাদের কোম্পানী থেকে দেওয়া হয়নি বলেও তিনি দাবী করেন। বাংলাদেশ আউটসোসিং এসোসিয়েশনের পরিচালকের অভিযোগের বিষয়ে জানেন না বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমি মূলত আউটসোসিংয়ের ব্যবসায়ী না। আমি গর্ভমেন্ট ঠিকাদার। সব কিছুর একটা ফাস্ট টাইম আছে, মনে করেন আমার এই কাগজটা ভুয়া। আপনার কথা মতো মেনে নিলাম। কিন্তু যারা অভিযোগটা দিয়েছে তারা প্রথম যেদিন লাইসেন্স করে সরকারের পিপিআর আইন অনুযায়ী, তিন/এক বছরে অভিজ্ঞতা চায়। তাহলে অভিযোগকারীরা জীবনের প্রথম যে কাজ টা পেয়েছে কী ভাবে? এই আইনটা পরিবর্তন করতে হবে।’
জানা গেছে, শুধু অর্থ প্রাইভেট লিমিটেড নয়- তার সঙ্গে আরো বেশ কয়েকজন সদস্য রয়েছেন, যারা কাজ না পেলেই অভিযোগ তুলেন বিভিন্ন প্রকল্পে। তাদের অধীনে রয়েছে একাধিক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। তারা এরই মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের আওতায় বিভিন্ন উপজেলায় আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া আটকে রেখেছে প্রায় ৮ বছর। এছাড়া পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারী ও গৃহগণনা প্রকল্পের নিয়োগ প্রক্রিয়াও আটকে রেখেছিল বহু বছর।
বাংলাদেশ আউটসোসিং এসোসিয়েশনের পরিচালকের অভিযোগ সূত্রে, আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়াকে জিম্মি করে রাখছে বিএনপি-জামাত ঘরানোর কিছু ব্যবসায়ী। বিএনপি জামাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর বেড়াজালে একের পর এক থমকে যাচ্ছে সরকারের উন্নয়নমূলক প্রজেক্ট। তাদের একটি সিন্ডিকেট আউটসোর্সিং-এ দরপত্রে অংশগ্রহণ করে; যদি তারা কাজ পায় তখন বলে সকল নিয়ম মানা হয়েছে, আর যদি তারা কাজ না পায় তখন তারা বলে এখানে অনিয়ম হয়েছে। তারা সিপিটিইউতে আবেদন করে স্থগিতাদেশ দিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়।
এ প্রসঙ্গে দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে ব্যাপক প্রযুক্তি নির্ভর সমন্বিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা (৩য় পর্যায়ে) প্রকল্পের পরিচালক ড. এস এম আলমগীর কবীর বলেন, আমরা অভিজ্ঞতা সঠিকতা যাচাইয়ে জন্য চিঠি দিয়েছিলাম। জানতে পারি সেই প্রকল্পের পরিচালক মারা গেছেন ২০২০ সালে কিন্তু সেখানে স্বাক্ষর ২১ সালের। এটা আমাদের ডকুমেন্টে আছে। প্রয়োজনে সেই প্রজেক্টের পিডির সাথে কথা বলতে পারেন। কাজ দেওয়ার পর কাগজ যাছাইয়ের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা আগেই দিয়েছি। অর্থ কোম্পনী যে মহিষ উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করেননি এটা সঠিক। তার কাগজপত্রগুলো সঠিক না। তদন্ত চলছে জানিয়ে তিনি বর্তমানে প্রকল্প নিয়ে আর কিছু বলতে চায়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন