পরম কৌশুলী ও চিরস্থায়ী শক্তির অধিকারী আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত পৃথিবীর খলীফা মানুষকে ইহসান বা সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। ব্যক্তিজীবন হতে শুরু করে জাতীয় জীবনের সকল অঙ্গনে ইহসান বা সদাচরণ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব তিনি মানুষের ওপর প্রদান করেছেন। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই আল্লাহপাক ন্যায়পরায়ণতা এবং ইহসান বা সদাচরণের নির্দেশ প্রদান করেন। (সূরা নাম্ল : ৯০)। এই আয়াতে কারীমায় ‘ইহসান’ অর্থাৎ সদাচরণ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আরবী ‘ইহসান’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছেÑ সুন্দর করা, পরিচ্ছন্ন করা, উত্তম ও পরিপাটি করা। ব্যবহারিক অর্থে ইহসান বলতে ব্যক্তিজীবনে ও বিশে^র যাবতীয় সৃষ্টির সাথে সদাচরণ সুলভ আচরণ করাকে বোঝায়। আল কুরআনের বিশ্লেষণ অনুসারে ইহসান দু’ভাবে সম্প্রসারিত হতে পারে। প্রথমত, মানুষ স্বীয় কর্ম, চরিত্র ও অভ্যাসকে সুন্দর, মার্জিত ও পরিচ্ছন্ন করে গড়ে তুলতে পারে। এতে করে নিজের জীবন যেমন সুন্দর ও মনোহর হয়, তেমনি অপরের জীবনেও নেমে আসে অনাবিল শান্তি ও নিরাপত্তা।
দ্বিতীয়ত, কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সাথে সদাচরণ অর্থাৎ ভালো ব্যবহার ও উত্তম আচরণ করা। এই নিরিখেই মহান আল্লাহপাক মানুষকে নির্দেশ করেছেন : তুমি সদাচরণ করো, যেমন আল্লাহপাক তোমার প্রতি সদাচরণ (ইহসান) করেছেন। (সূরা কাসাস : ৭৭)। তাছাড়া হাদিসে জিব্রাঈলে পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) ইহসানের অর্থ এভাবে করেছেন : ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে, যেন তুমি তাঁকে দেখতেছ। যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তাহলে মনে এই একীন রাখবে যে, তিনি তোমাকে দেখতেছেন।’
এর সারমর্ম হচ্ছে, আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করা দরকার, যেন ইবাদতকারী তাঁকে দেখছে। যদি ইবাদতকারী আল্লাহর উপস্থিতির এমন অনুভূতি অর্জন করতে না পারে, তাহলে প্রত্যেক ইবাদতকারীর এই বিশ^াস থাকা উচিত যে, আল্লাহপাক তাকে অবশ্যই দেখছেন। কেননা, আল্লাহপাকের এলেম বা জ্ঞান এবং দৃষ্টিশক্তির বাইরে কোনো কিছুই থাকতে পারে না। এটাই ইসলামী বিশ^াসের একটি প্রধানতম অঙ্গ।
সুতরাং হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী বোঝা যায় যে, এতে ইবাদতের ইহসান এবং যাবতীয় কাজকর্ম স্বভাব-চরিত্র অভ্যাস ও রীতি-নীতির ইহসান সম্পৃক্ত আছে এবং এগুলোকে প্রার্থিত উপায়ে পরিশুদ্ধ করা ও সর্বাঙ্গ সুন্দররূপে ফুটিয়ে তোলাকে বোঝানো হয়েছে। তাছাড়া বিশ^াসী ও অবিশ^াসী, মুসলমান ও কাফের মানুষ ও জীবজন্তু, উদ্ভিদ ও বৃক্ষরাজি নির্বিশেষে সব কিছুর সাথে উত্তম আচরণ করার বিষয়টিও এই আদেশের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাই, ইমাম কুরতুবী (রহ.) যথার্থই বলেছেন যে, উল্লিখিত আয়াতে কারীমায় ইহসান শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই উপরোক্ত উভয় প্রকার অর্থ এবং হাদিসে জিব্রাঈল (আ.)-এর দিক নির্দেশনা ও এতে শামিল রয়েছে।
লক্ষ করলে বোঝা যায় যে, প্রথম প্রকার ইহসান অর্থাৎ কোনো কাজকে সুন্দর করা, মনোহর করার পরিসর খুবই ব্যাপক এবং বিস্তৃত। মোটকথা, ইবাদত কাজকর্ম, চরিত্র, পারস্পরিক লেনদেন ইত্যাদিকে সুন্দর করাও এর অন্তর্ভুক্ত। এই ব্যাপকতার শেষ কোথায় তা নিরূপণ করা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়।
বস্তুত, ইহসানের আর্দেশ হলো কর্মের স্তরে। তাই, আমলী জিন্দেগীর সকল অঙ্গনে, সকল ক্ষেত্রে, ইহসানের উপস্থিতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ জন্য কোনো কোনো তাফসিরবিদ বলেন : ইহসান হচ্ছে অপরকে তার প্রাপ্য অধিকারের চাইতে বেশি দেয়া এবং নিজের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ না করা। এমনকি, কিছু কম হলেও তা গ্রহণ করে নেয়া। অনুরূপভাবে কেউ যদি তোমাকে হাতে এবং মুখে কষ্ট দেয়, তবে তুমি তার ওপর সমান প্রতিশোধ গ্রহণের পরিবর্তে ক্ষমা করে দেয়াটাও ইহসানের আওতাভুক্ত।
এতে বোঝা যায় যে, পুণ্য কর্মের মাধ্যমে মন্দ ও অসৎ কাজের প্রতিদান দেয়াটাও ইহসানকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। যারা এই পৃথিবীতে সদাচরণকারী তাদের আল কুরআনে ‘মুহছিন’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। মুহছিন শব্দটি এক বচন। অর্থ সদাচরণকারী। এক বচনে এই শব্দটি আল-কুরআনে চার বার এসেছে। যথাÑ (ক) ইরশাদ হয়েছে, হ্যাঁ, যে ব্যক্তি স্বীয় মুখমÐলকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সমর্পণ করল এবং সে সদাচরণকারী, তার জন্য তার প্রতিপালকের নিকট প্রতিদান রয়েছে। (সূরা বাকারাহ : ১১২)।
সুতরাং কোনো সৎলোকের সাথে রক্ত ও বংশগত সম্পর্ক থাকা মুক্তি ও নিষ্কৃতির জন্য যথেষ্ট নয়। বরং মুক্তি ও সফলতা মানুষের নিজের একীন বিশ^াস ও কর্মের ওপর নির্ভরশীল। যারা বিশ^াস ও কর্মে সদাচরণকে ধারণ করতে পারে, তাদের সফলতা অবশ্যম্ভাবী। আর যারা সদাচরণকারী নয়, তাদের ব্যর্থতা ও পরাজয় অতি নিকটেই অবস্থান করছে বিধায় এই সাধের পৃথিবী দিন দিন ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন