আমার এক বন্ধু মাস কয়েক আগেই নয়ডায় ফ্ল্যাট কিনেছে। সে যখন ফ্ল্যাট কেনার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার বাবা ও ভাইয়ের রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল। তারা বারবার করে বন্ধুকে বলেছেন নয়ডায় ফ্ল্যাট না কিনতে। তাদের অনুরোধ ছিল, নয়ডা নয়, শাহিনবাগ, ওখলা, জামিয়া নগরের মতো জায়গায় গিয়ে ফ্ল্যাট কেনা উচিত। কেন? কারণ, হিন্দুপ্রধান নয়ডার সোসাইটিতে ফ্ল্যাট কিনলে বাবা-ভাইয়ের চিন্তায় রক্তচাপ বেড়ে যাবে। তারা শান্তিতে থাকবেন মুসলিম-বহুল এলাকায় ছেলে ও ভাই ফ্ল্যাট নিলে। আমার এই মুসলিম বন্ধু তার বাবা ও ভাইয়ের অনুরোধ রাখেনি। দীর্ঘদিন ধরে সে নয়ডায় থেকেছে এবং সে নয়ডাতেই থাকবে। ফলে অন্য রাজ্যে থাকা বাবা-ভাইসহ পরিবারের অন্যরা ভয়ে থাকবেন। আশঙ্কায় থাকবেন। আতঙ্কে থাকবেন। এমন নয় যে বন্ধুর চিন্তা হয় না। এমন নয় যে দিল্লিতে যখন দাঙ্গা হয়েছিল, জামিয়া মিলিয়ায় যখন পুলিশ হোস্টেলে ঢুকে ব্যাপক মারধর করেছিল, দিল্লিতে দাঁড়িয়ে ভোটের সময় জনসভায় মন্ত্রী বলেছিলেন, দেশ কে গদ্দারো কো... সমর্থকরা চেঁচিয়ে বলেছিলেন, গোলি মারো ... কো, তখন বন্ধুও আতঙ্কগ্রস্ত হয়। তখন তারও ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা সত্তে¡ও মুসলিমবহুল এলাকায় না গিয়ে, পছন্দের নয়ডাতেই ফ্ল্যাট কিনেছে সে। কেন? বন্ধুর জবাব, একে তো শাহিনবাগ, ওখলা, জামিয়া নগরের মতো জায়গাগুলো খুবই ঘিঞ্জি, নোংরা। খোলামেলা জায়গা পাওয়া যায় না। শিশুর খেলার, স্কুলের জন্য অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়। নাগরিক সুবিধের কথা মাথায় রেখেই নয়ডায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। এটাই তো হওয়া উচিত। একটা স¤প্রদায়ের মানুষ কেন শুধু সীমাবদ্ধ কয়েকটা জায়গায় থাকবেন? তারাও তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবেন পছন্দের জায়গায়। কিন্তু দিল্লি কেন, ভারতের অধিকাংশ শহরে ওই ভয়ের কারণে বা নিজেদের মানুষজনের সাথে একসাথে থাকার স্বস্তির জন্য মুসলিমরা ওই এলাকাগুলো পছন্দ করেন। এক জায়গায় থাকেন। তাই প্রতিটি শহরেই চিহ্নিত হিন্দু, মুসলিম, শিখ মহল্লা থাকে। থাকে দলিত মহল্লাও। অবশ্য এটা শুধু হিন্দু-মুসলিম-শিখেদের মানসিকতা নয়, দিল্লিতে তো অধিকাংশ বাঙালির প্রথম পছন্দ চিত্তরঞ্জন পার্ক, কারণ এটা হলো বাঙালি এলাকা। এখানে ঢুকলেই আপনাদের কানে আসবে বাংলা ভাষা, বাঙালি খাবার, শাড়ির দোকান, শুনতে পারবেন বাংলা গান, দেখতে পারবেন বাংলা বই। একই কারণে দক্ষিণ ভারতীয়রা পছন্দ করে স্বামীনগর। কারণ, সেখানে দক্ষিণ ভারতীয়ের সংখ্যা বেশি। অর্থাৎ, কারণ যা-ই হোক না কেন, সংখ্যালঘু মানসিকতা একইরকমভাবে কাজ করে। কিন্তু তাই বলে কি বাস বা ট্রেনযাত্রার সময় নিজের নাম বদলে নিতে হয়? আমার আরেক মুসলিম বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীর অভিজ্ঞতার কথা বলি। দিল্লিতে সা¤প্রদায়িক উত্তেজনা হলেই, বাস বা ট্রেনে সফরের সময় সে নিজের নাম বদল করে দেয়। সে তখন কখনো সমীর, কখনো রাজু বা কখনো পাপ্পু হয়ে যায়, যাতে কোনোভাবে মনে না হয় সে মুসলিম। তখন সে বাচ্চাদের, স্ত্রীকে বাড়ির বাইরে যেতে দেয় না। সাংবাদিক বলে নিজেকে বেরোতে হয় ঠিকই, কিন্তু তখন তাকেও ভয় তাড়া করে। সেই বন্ধুই বলছিল, সেসময় মুসলিমরা স্ত্রী বা বাড়ির মেয়েরা হিজাব পরে বাইরে যান না। কারণ, তাহলে তারা চিহ্নিত হয়ে যাবেন। তখন তারা শাড়ি পরেন। বোরখা তো নয়ই। ছেলেরাও ফেজ টুপি পরেন না। অর্থাৎ, দেখে যেন মনে না হয়, তারা মুসলিম। শুনতে শুনতে ১৯৮৪ সালের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। দুই দেহরক্ষীর গুলিতে মারা গেছেন ইন্দিরা গান্ধী। ঘটনাচক্রে দুজনেই শিখ। তারপর দিল্লি জুড়ে চলেছিল শিখ নিধন-পর্ব। সে সময় বাঁচার তাগিদে শিখরা তাদের মাথার পাগড়ি খুলে ফেলেছিলেন। দাড়ি কামিয়ে ফেলেছিলেন। নাম বদলে নিয়েছিলেন। ১৯৮৪’র পর শিখ-দাঙ্গা আর হয়নি। কিন্তু এই দিল্লিই তো সা¤প্রতিক সময়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, উত্তেজনা দেখলো কতবার। কতবার এরকমভাবে নামবদল করে চলতে হবে তাদের? ভয় ঢুকে যাচ্ছে। ভয় ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, খাবার, পোশাক, ধর্মাচরণ নিয়ে। শুধু গরুর গোশত রাখার অভিযোগে মারা হয়েছিল আখলাককে। গরু পাচারকারী সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছে, নির্দিষ্ট ধ্বনি না দেয়ার জন্য মারা হয়েছে। এ সবই তো শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় ভয়ে। সেই ভয় ঢুকে যায় অস্থি-মজ্জায়। বারাণসীতে গিয়ে সেই ভয়ের আরেক ছবি দেখেছিলাম। মুসলিম শাড়ি ব্যবসায়ী জানিয়েছিলেন সে কথা। জ্ঞানবাপী নিয়ে তখন উত্তেজনা বাড়ছে। সেই সময় তার কারিগররা চলে গিয়েছিলেন ভয়ে। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শাড়ি তৈরি। তারাও তখন বেরোবার আগে দুই বার চিন্তা করতেন। ডয়চে ভেলে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন