বর্তমানে বিশ্বে কোন ধর্মাবলম্বীরা সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত, বাস্তুচ্যুত ও হত্যার শিকার, এ প্রশ্ন করা হলে নির্দ্বিধায় জবাব আসবে, মুসলমান। মুসলমানরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা যত বেশি আক্রমণ ও হত্যার শিকার হচ্ছে, তা আর কোনো ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। মুসলমানদের টার্গেট করে হামলা, হত্যা ও বিতাড়ন কর্মকান্ড বেশি দেখা যায় খ্রিস্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলমান নিগৃহীত ও হত্যার শিকার হয় ভারতে। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশটিতে মুসলমানদের ওপর যেন বিভীষিকা নেমে এসেছে। তার পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ নীতির কারণে মুসলমানরা অনিরাপদ ও নিজদেশে পরবাসীর মতো অবস্থায় রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, মোদির নীতির কারণে ভারত এখন একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী দেশে পরিণত হয়েছে। দেশটি থেকে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বিতাড়িত করতে পারলে তার এ নীতি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে। ফলে মুসলমানদের হত্যা ও নির্যাতন করার জন্য যেকোনো ছুঁতো বেছে নেয়া হয়। পান থেকে চুন খসলেই সব দায় গিয়ে পড়ছে মুসলমানদের ওপর। শুরু হয় অত্যাচার ও নির্যাতন। আমাদের দেশে রাস্তা-ঘাটে চলাফেরা করার সময় যেমন ‘ধাক্কা পার্টি’ নিরীহ মানুষকে ধাক্কা দিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়, তেমনি ভারতেও উগ্র হিন্দুরা মুসলমানদের সঙ্গে ছুঁতোনাতায় ঝগড়া বাঁধিয়ে তাদের হত্যা-নির্যাতন, বাড়িঘর ভাংচুর ও লুটপাট করে। সর্বশেষ গত ১০ সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রদেশে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। হিন্দুরা তাদের গণেশ মূর্তি বিসর্জন দেয়ার সময় উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে একটি মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় থামে। মিছিলটি একটি মাদরাসার সামনে থেমে আর না এগিয়ে সেখানেই নাচ-গান শুরু করে। এতে সেখানের মুসলমানরা ক্ষোভ প্রকাশ করলে মিছিলে অংশগ্রহণকারী হিন্দুরা উত্তেজিত হয়ে তাদের বাড়িঘরে হামলা করে। ১২টি গাড়ি ও সম্পদ ধ্বংস করে। এতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ চার মুসলমানকে গ্রেফতার করে। উগ্র হিন্দুরা এই চার মুসলমানের বাড়ি-ঘর ভেঙে ফেলেছে। এ ঘটনা যে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বা মুসলমানদের নিপীড়ন করার জন্য ঘটানো হয়েছে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। এর আগেও এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটিয়ে উগ্র হিন্দুরা মুসলমানদের ওপর হত্যা, নির্যাতন ও সম্পদ ধ্বংস করেছে। এসব ঘটনা যে ঘটানো হচ্ছে, ভারত থেকে মুসলমানদের বিতাড়নে মোদি সরকারের নীলনকশা অনুযায়ী, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। মোদি সরকারের এই নীতির কারণে বলা যায়, ভারতের মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি বিপন্ন অবস্থার মধ্যে রয়েছে।
দুই.
বিশ্ব থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধরা হেন কোনো অপচেষ্টা নেই, যা চালাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা খ্রিস্টান দেশগুলো ইসলাম ও মুসলমানদের জঙ্গী এবং সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে এবং তা দমন করার নামে ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়ার মতো সমৃদ্ধ মুসলমান দেশ ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা সন্ত্রাস দমনের কথা বললেও এর নেপথ্যে যে ইসলাম ও মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা কাজ করছে, তা এখন সবার কাছে পরিষ্কার। শত শত কোটি ডলার খরচ করে একশ্রেণির বিপদগামী মুসলমানদের দিয়ে নিজেরাই সন্ত্রাসী সংগঠন সৃষ্টি করেছে শুধু মুসলমানদের ধ্বংস ও ইসলামের বদনাম করার জন্য। এসব সংগঠন দিয়ে বিভিন্ন দেশে হামলা চালিয়ে তার দায় মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। প্রমাণ করতে চাইছে, মুসলমানরা উগ্র ও সন্ত্রাসী। এখন এটা সবাই জানে, নাইন-ইলেভেনে নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন বুশ প্রশাসন। সে আল-কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের ওপর দোষ চাপিয়ে তাকে হত্যা ও সন্ত্রাস দমনের নামে আফগানিস্তানে বছরের পর বছর হামলা চালিয়ে দেশটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আইএস সৃষ্টি করে তা দমনের নামে সমৃদ্ধ সিরিয়াকে ধ্বংস করেছে। নির্বিচারে হামলা চালিয়ে নারী-শিশুসহ লাখ লাখ মুসলমান হত্যা এবং উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছে। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের কাছে বিধ্বংসী অস্ত্র থাকার অজুহাতে তাকে হত্যা এবং হামলা চালিয়ে ইরাককে ধ্বংস করেছে শুধু ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষ থেকে। লিবিয়ায়ও একইভাবে গাদ্দাফীকে হত্যা ও দেশটিকে ধ্বংস করেছে। তিউনিসিয়ায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধোঁয়া তুলে আরব বসন্তের নামে মুসলমান বিশ্বকে অস্থিতিশীল করে তোলার পাঁয়তারাও করে যুক্তরাষ্ট্র। এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এসব করেছে মুসলমানদের হত্যা ও ইসলামের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে। একইভাবে মুসলমানদের সম্পদ লুণ্ঠন করার জন্য। মিয়ানামার আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে কীভাবে দেশছাড়া করেছে এবং করছে তা বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। ফিলিস্তিনে ইসরাইল পাখির মতো গুলি করে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। তাদের বাড়িঘর ধ্বংস ও সম্পদ বিনাশ করছে। বছরের পর বছর ধরে এই অত্যাচার-নির্যাতন ও তান্ডব চলছে। ইসরাইলকে মদদ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব। অন্যদিকে, ভারতের মুসলমানদেরও দেশছাড়া করার জন্য মোদি সরকার নাগরিকত্ব আইন এনআরসি পাস করেছে। ভারতের মুসলমানদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করতে চাচ্ছে না। এজন্য নানা উছিলায় দেশটির মুসলমানদের ওপর চালাচ্ছে নিপীড়ন ও নির্যাতন। দাঙ্গা বাঁধিয়ে নির্বিচারে হত্যা করছে। এই মোদি যখন ২০০২ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন সেখানে মুসলমানদের ওপর মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, তা ইতিহাসে বিরল। ঘটানাটি ঘটানো হয়েছিল পুরোপুরি গুজব রটিয়ে। ঐ বছরের ২৭ ফেব্রæয়ারি অযোধ্যা থেকে ট্রেনে করে একদল হিন্দু সন্নাসী গোধরায় আসছিল। সেখানে ট্রেনটিতে কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দিলে ৫৮ সন্নাসীর মৃত্যু হয়। মুহূর্তে রটিয়ে দেয়া হয়, মুসলমানরা ট্রেনে আগুন দিয়েছে। গুজরাটজুড়ে শুরু হয় মুসলমান হত্যাযজ্ঞ। উগ্র হিন্দুরা যেখানেই মুসলমান পেয়েছে, সেখানেই কুপিয়ে, পুড়িয়ে, ইট দিয়ে মাথা থেতলে হত্যা করেছে। গর্ভবতী মহিলার পেট কেটে বাচ্চা বের করে হত্যা করেছে। ছোট শিশুদের মুখে জোর করে পেট্রোল ঢুকিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। মুসলমান নারীদের উলঙ্গ করে রাস্তায় হাঁটিয়েছে। মুসলমানদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। সে সময় সেখানের প্রশাসন ও মিডিয়া মুসলমানদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা লিফলেট আকারে ছেপে বিতরণ করেছে। ঠিকানা ধরে ধরে উগ্র হিন্দুরা মুসলমানদের হত্যা ও তাদের সম্পদ ধ্বংস করেছে। প্রায় দুই হাজার মুসলমানকে তারা হত্যা করে। মুসলমানরা পুলিশের সাহায্য চেয়েও পায়নি। থানায় অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ তাদের বলে দেয় উপরের নির্দেশে অভিযোগ নেয়া যাবে না। বলা হয়ে থাকে, ট্রেনে আগুন দেয়া এবং ঘটনার নেপথ্যে মাস্টারমাইন্ড ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। পরবর্তীতে তদন্তে বিষয়টি উঠে আসে। বলা হয়, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে শুধু মুসলমানদের আক্রমণ করার জন্য। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিজেপি ও তার উগ্রবাদী সংগঠন কতটা মুসলমান বিদ্বেষী। যেকোনো উসিলায় তারা মুসলমান হত্যা করার উদগ্র বাসনা পোষণ করে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদি গুজরাট দাঙ্গার অভিযোগ থেকে মুক্তি পান। অথচ, এই মোদিকে ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্রে দেশটির মুসলমানদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার কংগ্রেস সরকারের আমলে মুসলমানদের উপর নির্যাতন অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। দেশটির মুসলমানরা এতটাই অতীষ্ঠ হয়ে পড়েছিল যে, তারা মনে করেছিল, কংগ্রেস সরকার বিদায় না হলে তাদের উপর নিপীড়ন ও নির্যাতন কোনোভাবেই সহনীয় পর্যায়ে আসবে না। ফলে নির্বাচনের সময় উগ্র হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদির মিষ্টি মিষ্টি কথায় আশ্বস্ত হয়েছিল এই ভেবে যে, তিনি ক্ষমতায় এলে হয়তো তার চরিত্রে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দুত্ববাদের যে অপবাদ, তা দূর করতে চেষ্টা করবেন। তার বদনাম ঘুচাতে হলেও উগ্রবাদ পরিহার করবেন। তাদের এই ধারণা থেকেই মুসলমান অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে মুসলমানরা ভোট দিয়ে বিজেপির বিপুল বিজয়ে ভূমিকা রেখেছিল। মুসলমানদের এ ধারণা যে একেবারেই ভুল ছিল তা বলাই বাহুল্য। তারা যে তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, তা মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে। মোদি তার স্বরূপে ফিরে মুসলমান বিদ্বেষ এবং তাদের বিতাড়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। এখন তার শাসনামলে মুসলমানদের এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে, তারা অত্যন্ত ভয়ে জীবনযাপন করছে। পরিস্থিতি এতটাই শোচনীয় যে, কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হলে মুসলমানরা নাম বদলে ফেলে যাতে উগ্র হিন্দুরা তাদের মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে। মহিলারা হিজাব পরা বন্ধ করে শাড়ি পরে। বাসে উঠতে গেলে নাম পরিবর্তন করে। মোদির শাসনামলে ভারত মুসলমানদের জন্য এক ভীতিকর ও অনিরাপদ দেশে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, মুসলমানদের জোর করে হিন্দু বানানোরও চেষ্টা চলছে। ইন্ডিয়াস্পেড নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে ২০১০ সাল থেকে পরবর্তী ৮ বছরে মুসলমানরা কী হারে উগ্র হিন্দুদের হামলা ও হত্যার শিকার হয়েছে, তার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের পর গরু সংক্রান্ত সহিংসতায় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের ৮৬ শতাংশই মুসলমান। আর গরু নিয়ে মুসলমানদের উপর যত হামলা হয়, তার ৯৭ শতাংশই নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে। এসব হামলার ৫২ শতাংশই হয় গুজব ছড়িয়ে। এটা প্রমাণিত যে, বিজেপি ও তার সমর্থক উগ্রবাদী আরএসএসের টার্গেটই হচ্ছে, গুজব ছড়িয়ে এবং ষড়যন্ত্র করে মুসলমানদের উপর হামলা ও হত্যা করা।
তিন.
ভারতের মুসলমানরা এখন নিজভূমে পরবাসী হয়ে আছে। মোদি সরকার ভারত থেকে মুসলমানদের বিতাড়নে উগ্র হিন্দুদের যেমন লেলিয়ে দিয়েছেন, তেমনি ভারতে শত শত বছর ধরে মুসলমান শাসনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য মুছে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছেন। ঐতিহাসিক মসজিদ ভাঙ্গা ও বিভিন্ন স্থাপত্যকর্ম ধ্বংস করা থেকে শুরু করে মুসলমানদের নামে যেসব সড়ক রয়েছে, তা বদলে হিন্দুদের নামে রাখা হচ্ছে। কাশ্মীর থেকে মুসলমানদের সব ধর্মীয় ও সুফি ঐতিহ্য ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। মায়ানমার ছাড়া এমন উগ্র ও প্রতিহিংসাপরায়ণ সাম্প্রদায়িক সরকার বিশ্বে আর দেখা যায় না। ভারত এমনই একটি দেশ, যেখানে ধর্মের ভিত্তিতে শহর ও গ্রামের এলাকা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। মুসলমানদের আলাদা এলাকা নিয়ে বসবাস করতে বাধ্য করছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে ধর্মের ভিত্তিতে আলাদাভাবে বসবাস করার এমন নজির বিশ্বে খুব কমই রয়েছে। ভারতে মুসলমানদের অবস্থা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভয়ে তারা কতটা ভীত অবস্থার মধ্য দিয়ে বসবাস করছে। উগ্র হিন্দুদের সবচেয়ে বেশি রোষ মুসলমানদের ওপর। শুধু উগ্র হিন্দু নয়, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলমানরা নিগৃহীত হচ্ছে। দুঃখের বিষয়, মুসলমানদের ওপর ক্রমাগত হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়নের কাজ চললেও মানবাধিকারের ধ্বজাধারী যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্ব বরাবরই নীরব ভূমিকা পালন করছে। অথচ, ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের জন্য তাদের দরদের সীমা নেই। এর কারণ, তারা ইহুদি-খ্রিস্টান সর্বোপরি শ্বেতাঙ্গ। তারা ইউক্রেনের ইহুদী প্রেসিডেন্ট জেলনস্কিকে অস্ত্র ও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এমনকি যুদ্ধের মধ্যেও পশ্চিমা বিশ্বের সরকার প্রধানরা জেলনস্কির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছেন। তাদের এই একপেশে মানবাধিকারের দরদ ভন্ডামী ছাড়া কিছু নয়। অন্যদিকে, ভারতে যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রমাগত মুসলমানদের হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়ন কার্যক্রম চলছে, তা নিয়ে তাদের কোনো শব্দ নেই। আরও দুঃখের বিষয়, আরব বিশ্ব ও মুসলমানদের বৈশ্বিক সংস্থা ওআইসিও নীরব ভূমিকা পালন করছে। ভারতের মুসলমানদের রক্ষায় তারা কোনো ধরনের কার্যকর উদ্যোগ, এমনকি প্রতিবাদ পর্যন্ত করছে না। অথচ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে লাখ লাখ ভারতীয় হিন্দু কর্মরত এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত তাদের ওপর অনেক ক্ষেত্রে নির্ভরশীল। দেশগুলো যদি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উগ্র হিন্দুদের দ্বারা মুসলমান হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন ও বিতাড়নের ক্ষেত্রে কঠোর হুঁশিয়ারি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে তাদের কথা উপেক্ষা করার সাধ্য ভারত সরকারের নেই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি এবং ওআইসি এই উদ্যোগটুকু নিলে ভারতের মুসলমানদের অস্তিত্ব অনেকটাই নিরাপদ হতে পারতো। দেশগুলোর ভাবা উচিৎ, ভারতে মুসলমানদের ওপর যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নির্মূল প্রক্রিয়া চলছে, তা তার আভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এটি মুসলমান জাতিবিনাশী প্রক্রিয়া। একটি দেশ থেকে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। অত্যন্ত ঘৃণ্য এ প্রক্রিয়া বন্ধে মুসলমান দেশগুলোর দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। তাদের এ চিন্তা করতে হবে, কোনো দেশে খ্রিস্টান, ইহুদী, হিন্দু ও বৌদ্ধ আক্রান্ত হলে পশ্চিমাবিশ্বসহ অন্য দেশগুলো যেভাবে সে দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় না ভেবে তার প্রতি কঠোর অবস্থান নেয়, একইভাবে মুসলমান দেশগুলোরও উচিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপন্ন মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানো। কোথাও মুসলমানরা অন্যায়ভাবে হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়নের শিকার হলে তার প্রতিবাদ এবং তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। দেশগুলো নিশ্চুপ থাকায় বিভিন্ন দেশে মুসলমান হত্যা ও নির্যাতন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ভারতের মুসলমানরা যেভাবে প্রতিনিয়ত নিগ্রহ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও হত্যার শিকার হচ্ছে, তাতে আমাদের দেশেরও কর্তব্য তার প্রতিবাদ করা। আমাদের দেশে হিন্দুদের ওপর বিচ্ছিন্ন কোনো হামলার ঘটনা ঘটলে ভারত যেভাবে লাফিয়ে উঠে এবং অস্থির হয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়া শুরু করে, ‘সেভ হিন্দুস ইন বাংলাদেশ’ বলে সমাবেশ ও মিছিল করে সীমান্ত পর্যন্ত চলে আসে, একইভাবে আমাদেরও ভারতের মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করা উচিত। দুঃখের বিষয়, ভারতের মুসলমানদের ক্রমাগত নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা কোনো প্রতিবাদ করে না। বরং দেশে হিন্দুদের ওপর কিছু হলে তারা সোচ্চার হয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িকতার ধোঁয়া তুলে গেল গেল বলে বক্তব্য-বিবৃতি দিতে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের হাইকমিশনারকেও সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শনে যেতে দেখা যায়। কক্সবাজারে বৌদ্ধদের মন্দিরে হামলার ঘটনায় চীনের কর্মকর্তারাও ছুটে গিয়েছিলেন। অথচ ভারত, চীন ও মিয়ানমারে যে মুসলমানরা হত্যা-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, এ নিয়ে কথিত প্রগতিশীলদের মুখে কোনো কথা নেই। অবশ্যই আমাদের দেশে সকল ধর্মের মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করে। এখানে কোনো কুচক্রী মহল কারো ওপর হামলা চালিয়ে তা বিনষ্টের অপচেষ্টা করলে তা রুখে দাঁড়াতে হবে।
চার.
সবসময়ই বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ ও ভারতের সুসম্পর্ক উচ্চতম পর্যায়ে রয়েছে। দুই দেশের জনগণের সাথে সম্পর্ক গভীর। এই সম্পর্ক বিবেচনায় নিয়েও তো আমাদের সুশীল সমাজ এই আহবান জানাতে পারে, ভারতের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান নাগরিকের ওপর উগ্র হিন্দুরা যে অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়, তা বন্ধ করা হোক। ভারতের সামনে তো এ উদাহরণ তুলে ধরতে পারে, অমাদের দেশে হিন্দুদের ওপর কোনো ধরনের হামলা হলে সাথে সাথে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। আমাদের দেশের আলেম-ওলামা ও সাধারণ মুসলমানরা হিন্দুদের পাশে দাঁড়ায়। এই চিত্রটাও তো তারা তুলে ধরতে পারে। ওআইসি এবং আরব বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর উচিত ভারতের মুসলমানরা যে নিপীড়ন ও নির্যাতনের পরিবেশের মধ্যে রয়েছে, তা বন্ধে ভারত সরকারকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়া ও সতর্ক করা। প্রত্যেক মুসলমান দেশের উচিত ইসলাম ও মুসলমানদের টার্গেট করে যে হামলা, নির্যাতন ও নির্মূল প্রক্রিয়া চলছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন