বাংলাদেশের বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশের চার বছর পূর্ণ হয়েছে। সাংবাদিক ও অধিকার কর্মীরা বলছেন এ চার বছরে আইনটি দেশে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে। তথ্য ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিন বলেছে, গত চার বছরে ভিন্নমত ও সরকারের সমালোচনা দমনে এই আইনের নজিরবিহীন অপপ্রয়োগ হয়েছে। সংগঠনটির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেছেন, সরকার সমালোচনায় ভীত হয়ে একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরির জন্যই আইনটি করেছিলো। দেশে এখন সেই পরিবেশই তৈরি হয়েছে। গতকাল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি বাংলায় রাকিব হাসনাতের এ প্রতিবেদন তুলে ধরো হয়।
প্রতিবেদনের বলা হয়, আইনটি বাতিলের জন্য সম্পাদক, সাংবাদিক, অধিকার কর্মী ও অনেক রাজনৈতিক দল দাবি করলেও সরকার বরাবরই এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আইনটি বাতিল না করে বরং আন্তর্জাতিক মানদÐে উন্নীত করতে তারা জাতিসংঘের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন।
দেশের সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরোধিতার মধ্যেই ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হয়েছিলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এরপর আইনটি কার্যকর করার পর থেকে সাংবাদিকদের ওপর এর অপপ্রয়োগের অভিযোগ ওঠে। তারা বলেন, প্রত্যেকটা শব্দ উচ্চারণ করার আগে আমরা দশবার চিন্তা করি।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে সাংবাদিকতা করেন তানভীর হাসান তনু। গত বছর ৬ জুলাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে গিয়েছিলেন টেস্ট করাতে। সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পান দুপুরে হাসপাতালের রোগীদের যে মূল্যের খাবার দেয়ার জন্য সরকার টাকা বরাদ্দ দেয় তার চেয়ে অনেক কম মূল্যের খাবার পরিবেশন করা হয়। তিনি বলেন, তখনি ভাবলাম নিজের যেহেতু করোনা হয়েছে তাই ঘরে বসেই এটি নিয়ে রিপোর্ট করবো এবং তাই করলাম। ৯ জুলাই রিপোর্ট প্রকাশিত হলো এবং পরদিনই হাসপাতালের তত্ত¡াবধায়ক হাসপাতালের মানক্ষুন্নের অভিযোগ করে আমিসহ ২ জন সাংবাদিকের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। এরপর আমাকে অ্যারেস্ট করা হলো। মিস্টার হাসানকে গ্রেফতারের ঘটনায় তখন সারাদেশে সংবাদকর্মীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিলো। ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে একদিন পরেই আদালত থেকে জামিন পেয়েছিলেন তিনি। তিনি আরো বলেন, এখনো আমি জামিনেই আছি। কিন্তু এর ফলে যা হয়েছে এখন লিখতে গেলেই নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার চিন্তা মাথায় আসে। আমাদের এলাকায় সাংবাদিকরা এ আইনে হেনস্থার ভয়ে সত্যিকার অর্থেই ভীত। ফেসবুকে কিছু লেখার আগেই চিন্তা করি কী থেকে আবার কী হয়।
মিস্টার হাসানের ঘটনা পরে ওই এলাকার আরো ৪ জন সাংবাদিকের নামে এই আইনে মামলা করেছেন সরকারি দলের স্থানীয় একজন নেতা।
২০২০ সালের মে মাসে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনাভাইরাস নিয়ে এবং সরকারের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। এর মধ্যে লেখক মুশতাক আহমেদ কাশিমপুর কারাগারে আটক থাকা অবস্থাতেই মারা যান গত বছর ফেব্রæয়ারিতে। এ ঘটনায় তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদ হলে সরকার আইনটি সংশোধনের উদ্যোগের কথা জানায় যদিও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। তবে চলতি বছর মে মাসে পাবলিক প্রসিকিউটরদের এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে যদি কোনো মামলা হয়, তাহলে দয়া করে সরকারি কৌঁসুলিরা যেন আগে খুঁজে বের করেন যে ওইটা আদৌ ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হওয়ার মতো কি না। না হলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে তিনি তাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ওইদিনই তিনি জানিয়েছিলেন যে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে বলেছেন যে এ আইনে মামলা হলেই যেন সাথে সাথে গ্রেফতার না করা হয়। যদিও এরপরেও এ আইনে মামলার পরপরই গ্রেফতারের নজির আছে।
আর্টিক্যাল নাইনটিন শুধু ২০২১ সালের উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ওই বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে কট‚ক্তির কারণে। সরকারি দলের এসব নেতাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীরা ছাড়ারও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের মতো সংগঠনের নেতারাও রয়েছেন, যাদের নিয়ে কট‚ক্তির অভিযোগেও এ আইনে মামলা হয়েছে। তবে এটি সত্যি যে আইনটি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবাদ ও শোরগোলের প্রেক্ষাপটে চলতি বছর এ আইনে তুলনামূলক কম মামলা হয়েছে।
চলতি বছর অগাস্ট পর্যন্ত এই আইনে ৭৯টি মামলা হয়েছে যাতে আসামী ১৭১ জন। এদের মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে ৪৬জন। এর মধ্যে ৫৩টি মামলাই হয়েছে ফেসবুকে বা অনলাইনে মত প্রকাশের কারণে। এর মধ্যে ৮টি মামলা করেছে পুলিশ ও র্যাব। আর সরকারি দল সংশ্লিষ্টরা মামলা করেছে ৪৩টি। এর মধ্যে ২৫টিই হয়েছে শুধু প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের নেতাদের নিয়ে মন্তব্যের কারণে। চলতি বছর ১৭টি মামলায় ৩৭ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। আর জেলে গেছেন ৫ জন।
এর আগে ২০১৮ সালে ৩৪টি, ২০১৯ সালে ৬৩টি, ২০২০ সালে ১৯৭টি ও ২০২১ সালে ২৩৮টি মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৬১১ টি মামলা হয়েছে গত ৪ বছরে এবং বিভিন্ন মামলায় গত ৩ বছরেই মোট ৫৩ জন সাংবাদিককে জেলে যেতে হয়েছে।
আর্টিকেল নাইনটিন এর দক্ষিণ এশীয় পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলছেন, ভয়ের পরিবেশ তৈরির জন্যই আইনটা করা হয়েছিলো গত নির্বাচনের আগে। এ আইনে শাস্তি হয়েছে কম। শুধু হেনস্থার জন্যই আসলে এটি হয়েছে যাতে করে সেলফ সেন্সরশিপ করে সাংবাদিকরা। আর মানুষ যেন সামাজিক মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা না করে। এখন সেটিই হয়েছে- মানুষ ভয় পাচ্ছে। সে পরিবেশ সরকার তৈরি করেছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, নানা আলোচনার এই আইনে মামলার হার অনেক কমেছে। সরকার আইনটিকে আন্তর্জাতিক মানদÐে উন্নীত করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিসের সাথে একযোগে কাজ করছে। যেখানে সংশোধনের দরকার সেটি করা হবে। (সংক্ষিপ্ত)। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন