মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

ইট পাথরের বস্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে ঢাকা

| প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হারুন-আর-রশিদ : ঢাকা এখন পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম জনবহুল নগর। জনগণত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৪৫ হাজার। বিশ্বের স্বল্প আয়তনে সর্বোচ্চ ঘনবসতির প্রথম নগর হলো ঢাকা। ১৬১০ সালের ১৬ জুলাই ঢাকাকে সুবে বাংলার রাজধানী করা হয়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকাকে বাংলা ও আসামের রাজধানী করা হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকায় স্থাপিত হয় তদানীন্তন পূর্ববাংলা, পরে পূর্ব  পাকিস্তানের রাজধানী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী। তখন থেকেই জনসংখ্যা ঢাকায় জ্যামেতিক হারে বাড়তে থাকে। কিন্তু ঢাকা আয়তন, সুযোগ-সুবিধা এবং নাগরিক সেবা সৃষ্টিতে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়ে।
ঢাকা মহানগরীতে প্রতিদিন নি¤œতম ৩০০ থেকে ৪০০টি মোটর যান নিবন্ধিত হয়। ঢাকার রিকশার সংখ্যা ৫ লাখ ৫০ হাজারের মধ্যে মাত্র নিবন্ধিত ২৫ শতাংশ। ঢাকার পাকা রাস্তার দৈর্ঘ্য ২০০০ কিলোমিটারের মতো। আরামদায়ক চলাচলের জন্য প্রয়োজন ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ রাস্তা, সেখানে ঢাকায় আছে মাত্র ৭ শতাংশ, যার নাম ভিআইপি সড়ক।
মটরযানের ২৫ শতাংশই ব্যক্তি মালিকানাধীন। কিন্তু এই গাড়িগুলোই মাত্র এক থেকে দুজন প্যাসেনজার নিয়ে মূল সড়কের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ রাস্তা দখল করে রাখে। ৬৫০টি সংযোগ সড়ক কেন্দ্রের জন্য মাত্র ৬০টি ট্রাফিক লাইট। ঢাকার রাস্তায় মোট ৮ রকম গতির যানবাহন চলাচল করে। রাস্তা তুলনামূলকভাবে সরু বলে ধীরগতির যানবাহনের আলাদা লেন নেই। নগরে জনসংযুক্তি যতই বৃদ্ধি পাওয়ার চেষ্টা করা হোক না কেন, মধ্যমেয়াদি সমাধানও দুরূহ। দীর্ঘস্থায়ী সমাধান তো নয়ই। যানজটের কারণে রাজধানীতে প্রতিবছর বাণিজ্যিক ক্ষতি হচ্ছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। যার দ্বারা দুটো পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব। একই কারণে প্রতিদিন নগরবাসীর ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের গোলটেবিল আলোচনায় এ হিসাব (২০১০-১১ অর্থবছর) তুলে ধরেছেন বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক।
এরপর গত পাঁচ বছরে যানজট যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে আর্থিক ক্ষতিও। ঢাকার ৭৫ শতাংশ মানুষ চলাচল করে বাসে, যা মোট সড়কের ২০ ভাগেরও কম জায়গা ব্যবহার করে। অন্যদিকে ৬ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি সড়কের ৮০ শতাংশ জায়গা দখল করে। যানজট তীব্রতর হওয়ার মূল কারণ হলো এটি। আরেকটি বড় কারণ হলো অপরিকল্পিত উপায়ে রাস্তা নির্মাণ। যানজটের এ দুটো বড় কারণ লাঘবের প্রচেষ্টা অদ্যাবধি সরকারি ব্যবস্থাপনায় আনা হয়নি। জ্যাম বা যানজটে অতিষ্ঠ নগরবাসীর নিরুপায় শব্দ চয়ন হলো যন্ত্রণার জীবনে বেঁচে থাকাই যেন আনন্দ। মন না চাইলেও মনকে বলতে হবে যানজট মেনে নাও  তাহলে কষ্ট কমবে। কেউ কেউ বলেন, প্রযুক্তির ধাবমান যুগে আমরা কেন ম্যানুয়ালে ফিরে যাচ্ছি। যানবাহনের অচলায়ন অবস্থা যা সেই শত বছরের পূর্বের অবস্থায় ফিরে গেছে। গতিময় হলো ডিজিটাল, আর গ্যাপ দিয়ে থেমে থাকার নাম ম্যানুয়াল। তখন মানুষ মোটরযান থেকে নেমে ¯্রষ্টার নির্মিত দুই পায়ের ওপর ভরসা করে পথ চলা অনেকটা গ্রামগঞ্জের খেয়াপাড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। ৫০-৬০ দশকে এ রকম অবস্থা পূর্ববাংলায় ছিল। ঢাকা এখন সেই পথে হাঁটছে।
এবার আসুন ঢাকা নগরে জলাবদ্ধতার দিকে একটু তাকাই। বর্ষা ঋতুতে ঢাকা মহানগরের মানুষ প্রায় সব সময় জলাবদ্ধতার সমস্যায় পড়ে। এ সময় অধিকাংশ এলাকায় ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ দৃশ্য চিরাচরিত। বর্তমানে ঢাকা মহানগরের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ঢাকা ওয়াসার স্টর্ম স্যুয়ারেজ (বড়নালা) আছে মাত্র ৩৬০ বর্গকিলোমিটার। সঠিক উপায়ে রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে এগুলোর কার্যকারিতা বহুলাংশে কমে গেছে। ১৯৮৮ সালের ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান ও ২০১০ সালের ড্যাপ (বিশদ পরিকল্পনা অঞ্চল) এ দুটো পরিকল্পনাতেই ৫ হাজার ৪২৩ একর জায়গা জলাধার হিসেবে রাখার কথা ছিল। খাল-নদী রাখার কথা ২০ হাজার ৯৩ একর। বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল রাখার কথা ৭৪ হাজার ৫৯৮ একর। এগুলোর প্রায় সবই দখল হয়ে গেছে। আলোচনায় সুপরিশ ও নীতিমালার কথাও বলা হয়েছিলÑ (১) যে কোনো উপায়ে দখলকৃত খাল উদ্ধার করতেই হবে। (২) সমন্বিতভাবে কাজ করলে যে অনেক নান্দনিক কাজ হতে পারে, হাতিরঝিল প্রকল্প এর একটি উত্তম দৃষ্টান্ত (৩) পয়োবর্জ্য শোধনাগারে পৌঁছানোর জন্য মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা দাকার। পয়োবর্জ্য  ও বৃষ্টির পানি কখনো নালার মধ্য দিয়ে যেতে পারে না। (৪) ড্যাপ কার্যকর হলে আজ বিপজ্জনক জলজটের মধ্যে পড়তে হতো না। (৫) এই নগরকে বাঁচাতে হলে একটা আন্তরিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার একান্ত প্রয়োজন। (৬) জলাশয় আইন ভঙ্গকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। (৭) জলাশয় ভরাটের অপতৎপরতা চিরতরে বন্ধ করতে হবে। উল্লিখিত পদক্ষেপসমূহ জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর করলে ঢাকা মহানগরীর মানুষ জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে। (সূত্র প্রথম আলো : ৩-৯-১৫)। ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ একটি জাতীয় দৈনিকে কবার নিউজ ছাপিয়েছিল পুরো পৃষ্ঠাভরে। শিরোনাম ছিল চট্টগ্রাম নগরে জলাবদ্ধতা এক যুগে ২৭১ কোটি টাকা ব্যয় হয় কিন্তু ফল শূন্য। চট্টগ্রাম নগরবাসীরও বর্ষায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।
এবার আসুন ঢাকার একটি বিপদসঙ্কুল অবস্থার দিকে দৃষ্টি দিই। ঢাকার হাজারো অলিগলিতে যে আবাসন ও দোকানপাট নির্মিত হয়েছে তার কোনো নীতিমালা আছে বলে মনে হয় না। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অফিসে এসব নীতিমালা ফাইলবন্দি অবস্থায় আছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। আমি নিজে দীর্ঘ বছর বসবাস করার কারণে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যেতে হয়েছে কর্মের কারণে। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তার কিছু দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরব। পুরান ঢাকার কথা বাদই দিলামÑ যেটা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন আমরা সবাই জানি পুরান ঢাকা- গিঞ্জি এলাকা হিসেবে খ্যাত প্রায় শত বছর ধরে। আমি যে কথাটি বলতে চাচ্ছি তা হলো উত্তর সিটি কর্পোরেশনও সেই পথে হাঁটছে। মুনাফালোভী বাড়ির মালিকরা আবাসন নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউকের নীতিমালার ধার ধারে না। অর্থাৎ টাকা দিয়ে ভূমি কিনেছে, জায়গা ছাড়বো কেন। এসব ব্যাপারে রাজউকেরও তৎপরতা নেই বললেই চলে। কেউ কেউ বলেন, এটা বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুরের তুলনা দেবেন না? ওইসব দেশে আইন মেনেই সবকিছু করা হয়। কারণ ওসব দেশে আইন তার স্বগতিতেই চলে। কিন্তু বাংলাদেশে আইন চলে টাকায়। টাকা দিলে আইন তার গতি বদলায়। যার কারণে ঢাকার বাড়িগুলো একটার সাথে আরেকটা লাগানো। ৪-৫ ফুট জায়গা ছেড়ে বাড়ি নির্মাণ করা আবাসন নীতিমালায় নির্ধারণ করা থাকলেও সেই আইন বাড়িওয়ালারা মানেন না এবং রাজউকের মুখ বন্ধ থাকে অর্থের কারণে। ফলশ্রুতিতে দম বন্ধ হওয়া পরিবেশে বসবাস করতে হয় ঢাকায় বসবাসরত মানুষকে। ছোট শিশুরা আলো-বাতাসহীন এই বদ্ধ ঘরে বসে সারাক্ষণ ইন্টারনেট আর টিবি চ্যানেলনির্ভর হয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। নেই কোনো খেলার মাঠ। উন্নয়নশীল বিশ্বেও আজকাল তিনটি বাড়ির জন্য একটি খেলার মাঠ বরাদ্দ রাখতে হয়। এমন নীতিমালা ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ায় আছে। বাড়ি হবে  ফাঁকা-ফাঁকা, খোলামেলা গ্রিনজোনে তা নির্মিত হবে।
বৃক্ষরাজি মানুষকে অক্সিজেন সরবরাহ করে। আর বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গাছ শোষণ করে নেয়। এই বিষাক্ত জিনিসটি গাছের খাদ্য। যা এখন আমরা খাচ্ছি। কারণ বৃক্ষ নিধন এখন বাড়ি নির্মাতা গোষ্ঠীর মূল টার্গেট। তাদের ডায়লগÑ গাছ থাকলে তো বাড়িটি বড় হবে না। আমার তো প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। ৫ কাটা জমিতে ১০ থেকে ১৪ তলা বাড়ি নির্মাণ না করলে শত কোটি টাকার মালিক কীভাবে হব। এমন বৈশ্বিক চিন্তা আমাদের মস্তিষ্কে কাজ করে। ফলে ঢাকা হয়ে গেছে ইট-পাথরের বস্তি। বলতে হয়, সবকিছুই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে ঢাকায়। ৩০ নভেম্বর বুধবার মাছরাঙা চ্যানেলে উত্তর সিটির উত্তরখান এবং দক্ষিণখানের সবাক চিত্র দেখিয়েছে। সড়কপথগুলো অজোপাড়াগাঁয়ের মেটোপথের চেয়েও নিকৃষ্ট দেখলাম। ঢাকার ওই দুটো এলাকায় প্রায় অর্ধশতাধিক ইউনিয়ন এখন সিটি করপোরেশনের আওতাধীন। গাড়ি, লেগুনা, রিকশা, এমন কি মানুষেরও ওসব পথ দিয়ে হেঁটে চলা মানেই হলো প্রতি মুহূর্তে বিপদের ঝুঁকি। ঢাকার তিন কোটি মানুষ বিশেষ করে ৮০ শতাংশ নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ কখনো নিরাপদ অনুভব করেছে যাত্রাপথে ঢাকার সিটির অভ্যন্তরে, এ কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। তার বাস্তব প্রমাণ আমি নিজেই। কিছু দিন আগে একটি কাজে পূর্বরাজাবাজার যেতে হয়েছিল। মোহাম্মদপুর থেকে ৮ টাকা, কিছু দিন আগে লক্কড়ঝক্কড় মুড়িরটিন সাইজের গাড়ির ভাড়া ছিল ৫ টাকা। ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে আসতে সময় লেগেছে প্রায় এক ঘণ্টা। সময় লাগার কথা ১০ মিনিট। মোহাম্মদপুর টাউন হল থেকে জ্যাম শুরু। গোটা পঞ্চাশেক স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে হাফ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে। দুই লেনের সড়কের দুই পাশে ব্যক্তিগত গাড়িগুলো ১২ থেকে ১৫ ফুট প্রস্ততা সড়কের কমিয়ে দিয়েছে। বিত্তশালী ব্যক্তিদের গাড়ির বহর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনও একেবারে চুপ। এটুকু জায়গার জ্যাম আমাদের মতো অসহায় যাত্রীদের ৪৫ মিনিট কষ্ট দিল। এসব কথা বলার জায়গা নেই। আমি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের সামনে নেমে পড়লাম দমবদ্ধ হয়ে যাওয়ার মুড়িরটিন মার্কা গাড়ি থেকে। ভাবলামÑ আর কোনো বাহনে চড়ব না। বাহন মানেই যন্ত্রণা। তাই সৃষ্টিকর্তার দেওয়া অমূল্য সম্পদ দুই পায়ের ওপর ভরসা করে ইন্দিরা রোড দিয়ে হেঁটে  চললাম পূর্বরাজাবাজার গন্তব্য স্থানে। মাত্র ১৫ ফুট চওড়া, কেউ কেউ বলেন ২০ ফুট ছিল। ৫ ফুট খেয়ে ফেলেছে কাঁচাবাজারের দোকানদার বা হকাররা। হাঁটা পথ এখন মূল সড়ক। গায়ে গায়ে মানুষ ধাক্কাধাক্কি করে পথচলা। এরপর আছে রিকশা, বেবিটেক্সি এবং ব্যক্তিগত গাড়িÑ এক কথায় হেঁটে পথ চলাও এখন ঢাকা শহরে অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
রাস্তার দুই পাশে তাকিয়ে দেখলাম ৬ থেকে ১২ তলা বিশিষ্ট অট্টালিকার সারিবদ্ধ চেহারা। একটি বাড়ি থেকে আরেকটি বাড়ির মাঝখানে এক ইঞ্চিও ফাঁক নেই। এ দৃশ্য শুধু পূর্ব রাজাবাজার নয়, মোহাম্মদপুরে রিজিয়া সুলতানা রোড, নূরজাহান রোড, শেরশাহসুরী রোড, বাবর রোড, কাঁটাসুর, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড এবং সোসাইটি, রায়েরবাজার, পশ্চিম ধানমন্ডি, সর্বত্রই ঘা ঘেঁষা এরকম বহুতলবিশিষ্ট ইমারত দেখা যাবে। এসব গিঞ্জি এলাকায় আবাসন কোম্পানিরাও ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মাণ করেছে। শিশুদের খেলার মাঠ নেই। আলো-বাতাস ঢোকার ব্যবস্থাও নেই। কারণ চার দিকের তিন দিকেই ইমারত। সূর্যের আলো আর প্রকৃতির মুক্ত হাওয়া প্রবেশ পথে সিল মেরে দেওয়া হয়েছে ইমারত তৈরি করে। অক্সিজেন উৎপাদনকারী বৃক্ষরাজি কেটে ফেলা হয়েছে বহু আগেই। ভরাট করে খাল-পুকুর, দীঘি ও মাঠ দখল করে নির্মিত হয়েছে এসব ভবন। খাল-পুকুর, গাছপালায় যত লাভ তার পঞ্চাশগুণ বেশি মুনাফা হয় বহুতলবিশিষ্ট নির্মিত ভবন থেকে। আমরা শহরের সৌন্দর্য এবং স্বাস্থ্যের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেই অর্থকে। মাঝে মাঝে ভাবি- ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধটা মনে হয় বৈশ্বিক কারণেই করেছি, না হলে এভাবে অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ করে অর্থ উপার্জন করতাম না। আগে দেশের চিন্তা, তারপর নিজের অর্থবিত্তের চিন্তা। কিন্তু সেটা এখন নেই বললেই চলে।
আশির দশক থেকে আবাসন বা হাউজিং কোম্পানিগুলো ইট-পাথর আর রড সিমেন্টের এই ব্যবসায় যত টাকা বিনিয়োগ করেছে তার দ্বিগুণ মুনাফা অর্জন করে। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ রিহ্যাব ও রাজউকের নীতিমালা তারা মেনে চলছে কিনা। এক্ষেত্রে রিহ্যাব বা আবাসন কোম্পানির প্রতিনিধিত্বকারী কর্মকতাবৃন্দ এবং রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কতটুকু তদারকি করছেন সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অলিগলি অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০ ফুট প্রশস্থ গলিগুলোর নির্মিত বাড়িগুলো দেখলে গা চমকে ওঠে। মনে হয় যেন কতগুলো গুদাম ঘরে রুম বানিয়ে বসবাস করার নামে মানুষের স্বাস্থ্য ও অর্থের সর্বনাশ ঘটানো হচ্ছে। আমি ঢাকা সেন্ট্রাল রোডে গিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম এ কারণে যে, এ সমস্ত বাড়িতে কীভাবে মানুষ বসবাস করে। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, উত্তরও পেলাম সঙ্গে সঙ্গে। বলল, রাত-দিন সারাক্ষণ লাইট-ফ্যান চালিয়ে রাখতে হয়। এই অগ্রহায়ণ মাসের শেষ সময়েও ঢাকায় শীতে নামেনি। তাই বাংলাদেশ এখন দুই ঋতুর দেশÑ গ্রীষ্ম ও বর্ষা। ১২ মাসের মধ্যে ৯ থেকে ১০ মাসই গ্রীষ্মকাল। বলতে হয় ১২ মাসেই এখন বিদ্যুৎ ছাড়া চলা যায় না। বাড়ির মালিক ও আবাসন কোম্পানিগুলো যদি পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা রেখে অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করত তাহলে বসবাসরত মানুষগুলো কিছুটা হলেও স্বস্তি পেত। বিদ্যুৎ খাতে মোটা অংকের খরচ থেকেও রেহাই পেত। আমি কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলামÑ ঢাকার অলিগলিতে যে বাড়িগুলো নির্মিত হচ্ছে, সে বাড়িগুলোর ডানে-বামে এক ইঞ্চিও ফাঁক নেই। সামনে এবং পেছনের দিক দিয়ে বাড়ির আবর্জনাগুলো ফেলা হয়। সেই আবর্জনা পরিষ্কার করারও কোনো ব্যবস্থা নেই।
মোহাম্মদপুর চান মিয়া হাউজিংয়ের সড়কপথে দীর্ঘ এক মাস ধরে যান চলাচল বন্ধ। বাসাবো ত্রিমোহনী সড়কে চলছে দীর্ঘমেয়াদি যানজট। মৌচাক, মগবাজার, এফডিসি সংলগ্ন ফ্লাইওবার নির্মাণকালীন জনগণের ভোগান্তি হয়েছে সীমাহীন। ধুলোবালিতে একাকার হয়ে যায় খোঁড়াখুঁড়ি ও ফ্লাইওবার নির্মাণকালীন পুরো এলাকা। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ থেকে গাবতলী পর্যন্ত যেতে পুরো সড়কটির অবস্থা ভয়াবহ। এ সড়কে গড়ে উঠেছে নির্মাণ সামগ্রীর অনেক দোকান, বালুর পরিমাণও বেশি। রোকেয়া সরণিতে চলছে মেট্রোরেলের কাজ। তালতলা, শেওরাপাড়া, কাজীপাড়া, মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর বাসস্ট্যান্ডের সামনে প্রচুর ধুলা। এসব এলাকার সাধারণ মানুষের অভিযোগ, উন্নয়নের নামে যা হচ্ছে সবই অপরিকল্পিত। শুধু তাই নয়, অর্থ উপার্জনের একটি সরল পথ। প্রতি বছর কয়েকবার এ কাজ টেন্ডার হিসেবে পেলে শাসক দলের সোনার ছেলেরা আরামে থাকবে। সব কাজই হচ্ছে লম্বা সময় নিয়ে, কারণ একটা সময় যত বেশি রোজগার তত বেশি হবে। সড়ক নির্মাণে দীর্ঘ মেয়াদি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে না। টেকসই সড়ক নির্মাণ হলে বছরে একাধিকবার আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন