সারাদেশে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এলাকায় অধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি ছিনতাই পথকে শুরু করে খুনোখুনিসহ নানা অপরাধে কিশোর-তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে।
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, এদের বয়সসীমা ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যেই বেশি হয়ে থাকে। সাধারণত প্রতিটি গ্যাংয়ের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়, এমন একটি নির্দিষ্ট নাম ও লোগো থাকে। ক্ষেত্রবিশেষ গ্যাংয়ে একই রকমের জামা-কাপড় পরার স্টাইল দেখা যায় এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্য তারা অস্ত্র যেমনÑ ছুরি, রামদা, হকিস্টিক, বন্দুক ইত্যাদি সংগ্রহে রাখে। সমাজব্যবস্থা, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহচার্য, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রের নানাবিধ উপকরণ গ্যাং কালচার তৈরির উপাদান হিসাবে কাজ করে। গতকাল মহাখালীস্থ মসজিদে গাউছুল আজমে জুমার খুৎবাপূর্ব আলোচনায় খতিব প্রিন্সিপাল মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা অথবা ডিভোর্সের কারণে ভেঙে যাওয়া পরিবারে সন্তানদের মাঝে হতাশা তৈরি হয়। নেশাগ্রস্ত পরিবার যেখানে মাদক নেশাজাতীয় দ্রব্যের নিয়মিত আসর বসে, সেখানে কম বয়সে অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া খুবই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আবার কখনো কখনো কর্মজীবী বা ব্যবসায়ী পিতা-মাতার পক্ষে সন্তানকে সময় দেয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে গ্যাং তৈরির মধ্য দিয়ে সন্তান একাকিত্ব ও হতাশা দূর করার চেষ্টা করে। একাধিক বিবাহ এবং পারিবারিক অশান্তিও গ্যাং তৈরির কারণ হতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থাও এ কালচার গড়ে ওঠার পেছনে কিছুটা দায়ী। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাস্তি নিষিদ্ধ হওয়ায় শিক্ষার্থীরা আদব আখলাক শিখছে না। কিশোর তরুণরা যার যার মতো চলছে। দলবদ্ধ হয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া পরীক্ষা পদ্ধতিও এর জন্য দায়ী যেমনÑ ৯৬ থেকে ১০০% পাস। যেহেতেু পরীক্ষা দিলেই পাস সেহেতু তারা পড়ার টেবিলে বসতে চায় না। সময় পাড়া মহল্লায়, রাস্তার পাশে, চায়ের দোকানে আড্ডায় কাটায়।
মূলত ২০১৭ সালে উত্তরায় আদনান হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের সহিংসতার নির্মমতা জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়। যা বর্তমানে জটিল অবস্থা ধারণ করেছে। পুলিশ ও র্যাব সূত্র বলছে, রাজধানীতে এখন অন্তত ৭০ থেকে ৭৫টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। এদের সদস্য সংখ্যা দেড় থেকে ২০০ হাজার। কিশোর দলের অপরাধ দমন করলেই চলবে না। প্রয়োজন হচ্ছে এদের সংশোধন করা এবং অপরাধী যেন তৈরি না হয়, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ইসলাম মূলত মানুষে যেন অপরাধ না করতে পারে, সে ব্যাপারে গ্রাউন্ড তৈরি করে। কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ দমনে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হযরত লোকমান হেকিমের সন্তানের জন্য দেয়া উপদেশগুলো বেশ কার্যকর যেমনÑ হে প্রিয় পুত্র, আল্লাহর সাথে শিরক করো না। কেননা, শিরক হচ্ছে অত্যন্ত বড় জুলুম (সূরা লুকমান : ১৩)। হে বৎস, কোনো বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তর গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূগর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ গোপন ভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন (সূরা লুকমান ৩১:১৬)।
অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না (সূরা লুকমান ৩১:১৮)।এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না (সূরা লুকমান ৩১:১৮)। হে পুত্র, নামাজ কায়েম কর (সূরা লুকমান : ১৭)। এবং ভালো কাজের আদেশ কর আর অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখ (সূরা লুকমান : ১৭)। যা কিছু দুঃখ-কষ্ট-লাঞ্ছনা আসবে, এ কাজে তাহা সব উদারভাবে বরদাশত করো। কেননা, এমন কাজ, যা সম্পন্ন করার একান্তই জরুরি ও অপরিহার্য (সূরা লুকমান : ১৭)। মধ্যমনীতি অবলম্বন করে মাঝামাঝি ধরনের চালচলন অবলম্বন করো (সূরা লুকমান : ১৯)। তোমার কণ্ঠধ্বনি নিচু করো, সংযত ও নরম করো, কেননা সবচেয়ে ঘৃণ্য হচ্ছে গর্দভের কর্কশ আওয়াজ (সূরা লুকমান : ১৯)। হে আল্লাহ, আমাদের স্ত্রীদের ও সন্তানদের দিক থেকে চোখের শীতলতা দান করো এবং আমাদের পরহেজগার লোকদের নেতা বানাও (সূরা ফুরকান : ৭৪)।
খতিব বলেন, ইসলামে শাস্তির বিধান তিন ধরনের, যারা কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে তাদের সংশোধন ও দমনে ইসলামের এ শাস্তির বিধান প্রয়োগ জরুরি। ইসলাম অপরাধের ক্ষেত্রভেদে বেত্রাঘাত, রজম ও শিরোচ্ছেদের বিধান দেয়। এগুলো কঠোর ও কঠিন শাস্তি। এ শাস্তি জনসমক্ষে দিতে হয়। যাতে সবাই শাস্তির কঠোরতা দেখে অপরাধ থেকে বিরত থাকে। এরশাদ হয়েছে, হে বুদ্ধিমানগণ! কেসাসের মধ্যে তোমাদের জন্যে জীবন রয়েছে, যাতে তোমরা সাবধান হতে পার (সূরা বাকারা ২:১৭৯ )।
এছাড়াও কিছু পদক্ষেপ নেয়া যায়, কিশোর ও তরুণদের সঠিক পথে রাখার জন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে যেমন: তাদের দ্রুত কর্মমুখী করা, রাস্তায় দলবদ্ধ হয়ে বসতে না দেয়া, চুলের স্টাইল করতে না দেয়া, হলুদ অনুষ্ঠান বর্জন করা, সহশিক্ষা মুক্ত রাখা, নারী-পুরুষদের অবাধে মিশতে না দেয়া, নেশা জাতীয় পণ্য সরবরাহ না করা, আকাশ সাংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণ করা, নাকট সিনেমায় অপরাধ কর্মের উপাদানগুলো প্রদর্শন না করা। খতিব সাহেব এহেন আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে, পরিবার ও সমাজকে রক্ষার জন্য সবাইকে আরো সতর্ক ও সোচ্চার হতে আহ্বান জানান।
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব মুফতি রুহুল আমিন গতকাল জুমার বয়ানে বলেন, মানুষকে আলোর দিশা দিতে আল্লাহপাক আম্বিয়া কেরামের পর নায়েবে রাসূলদের ওপর দ্বীন সম্প্রসারণের দায়িত্ব দিয়েছেন। আল্লাহর হুকুম এবং রাসূল (সা.) এর আদর্শ উভয়ই বাস্তবায়ন করতে হবে। আধুনিক যুগেও নবী (সা.) আদর্শ বাস্তবায়নে বিন্দু পরিমাণও শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না। নবীর উত্তরসূরী হিসেবে দায়িত্ব পালনে আলেমদের অবিচল থাকতে হবে। খতিব বলেন, সাহাবায়ে কেরাম বহু কষ্ট শিকার করে অগ্নিপরীক্ষায়ও কামিয়াবি হয়েছিলেন। ধোকায় না পড়ে দ্বীনের প্রচার সম্প্রসারণ ও বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আল্লাহ সবাইকে পরিপূর্ণভাবে রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ বুঝে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন