রাজধানীতে বিশৃঙ্খলভাবে যানবাহন চলাচল অনেকটা ‘অঘোষিত’ নিয়মে পরিণত হয়েছে। ট্রাফিক আইন না মানার সাথে আইন প্রয়োগে ‘ট্রাফিক পুলিশের নিস্ক্রিয়তা’ দৃশ্যমান। দিন যতই গড়াচ্ছে যানজট পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর আকার ধারণ করছে। আজ পর্যন্ত যানবাহন চলাচলের জন্য পৃথক লেন গড়ে উঠেনি। বহুতল ভবনের সামনে পার্কিং, ফুটপাথ দখল করে ভাসমান দোকান, ফুটপাথসহ রাস্তার একপাশে নির্মাণ সামগ্রী রাখা, রাস্তায় বাম দিকে চলাচলের পথ (লেফট বে) অবরুদ্ধ করে রাখা নিত্যকার চিত্র। এর বাইরেও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম। রাজধানীর ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের ওপর ১৮টি সংস্থা কাজ করলেও কাজের কাজ বলতে যানজটের জট খুলতেই চাইছে না।
দৈনিক ইনকিলাবের অনুসন্ধানে ওইসব চিত্র ফুটে উঠেছে। এছাড়াও যানজট নামক বিষফোঁড়ার কবল থেকে আদৌ নগরবাসী মুক্তি পাবে এমন কোনো নিশ্চয়তা যানবাহন চলাচল ও নিয়ন্ত্রণের সাথে সংশ্লিষ্ট কেউই দিতে পারেননি। রাজপথে একটি ‘অলিখিত সমঝোতা’য় যানবাহন চলাচল করছে। যে কারনে কোনো নিয়মের বালাই নেই। ওই সমঝোতায় নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা আগেই ট্রাক চলাচল শুরু হয়ে যায়।
প্রতিটি রাস্তার মোড়ে বাম লেন (লেফট বে) উন্মুক্ত থাকা নিয়ম। লেফট বে’তে যানজটের কোনো প্রশ্নই উঠেনা। এ ধরনের একাধিক স্পটে কর্তব্যরত ট্রাফিকের পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারাও লেফট বে উন্মুক্ত থাকা যে নিয়ম তা স্বীকার করেছেন। কিন্তু সেই নিয়ম দিন, মাস কিংবা বছর নয়; যুগ যুগ ধরে কেন উপেক্ষিত? এমন প্রশ্নে কর্তব্যরত একাধিক ট্রাফিক সার্জেন্টের কথা, রাজধানীর ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের ওপর ১৮টি সংস্থা কাজ করে। এর মধ্যে ট্রাফিক পুরিশ হচ্ছে একটি। ফলে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব ট্রাফিক পুলিশের একার পক্ষে দেয়া একেবারেই দূরহ ব্যাপার।
হালকা থেকে ভারী যানবাহনের চালকদের সাথে আলাপাকালে তারা জানিয়েছেন, যানজট নিয়ন্ত্রণ ও কমিয়ে আনার পরিবর্তে ট্রাফিক পুলিশের ‘নজর’ থাকে অন্যদিকে। এই ‘নজর’ নামক শব্দের বদৌলতে ফিটনেসবিহীন যানবাহন ট্রাফিক পুলিশের নাকের ডগায় চলাচল করছে। অবশ্য এমন অভিযোগ সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেছেন, ‘যানবাহনের ভেতর-বাইরে সদরঘাট থাকলেও কাগজপত্রে ফিটফাট’। অর্থাৎ ফিটনেসবিহীন যানবাহন আটকালেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় না। চালক যে কাগজপত্র দেখায় তাতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) দেয়া ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকে।
অনেকেই বলেছেন, যানবাহন চলাচলে পৃথক লেন না থাকা, বাম লেন (লেফট বে) উন্মুক্ত না রাখা এবং বহুতল ভবনের পাকিং ব্যবস্থা না থাকাটা যানজটের জন্য একটি ‘বিষফোড়া’। যানজট নিয়ে প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন মাঠ পর্যায়ের ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, প্রথমত অপ্রশস্ত রাস্তায় ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যানবাহনের চাপ, গণপরিবহনে নির্দিষ্ট স্টপেজের বাইরে যত্রতত্র যাত্রী উঠা-নামা, ট্রাফিক আইন অমান্য, বহুতল ভবন ও মার্কেটের নিচে রাস্তায় অবৈধ পাকিং, ভবন কিংবা মার্কেট নির্মাণে দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্দেশ অমান্য, স্কুল কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থী বহনে নিজস্ব বাস না থাকা, সর্বোপরি জনসচেতনতার অভাব যানজটের মূল কারন।
ট্রাফিকের একাধিক কর্মকর্তার মতে, যানজট কমিয়ে আনার জন্য সবচেয়ে যেটা বেশি জরুরি সেটা হলো গণপরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত করা। স্কুলগুলোর নিজস্ব শিক্ষার্থী বাস থাকলে রাস্তায় কয়েক লাখ গাড়ির চাপ কমে যাবে। সেই সাথে প্রধান সড়ক থেকে রিকশা তুলে দেয়া হলে যানজট অর্ধেকে নেমে আসবে। কিন্তু এসবের কিছুই ট্রাফিক পুলিশের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের সাথে সংশ্লিষ্ট ১৮ সংস্থাকে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে।
যানজটে মানুষের গন্তব্যে পৌঁছাতে শুধুই দেরি নয়; জ্বালানি পুড়ে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সেই সাথে নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্ট। কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। যানজট নিরসনে একাধিকবার নেয়া পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানজট নিরসনে দুই সিটি কর্পোরেশসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যেগ এবং সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত যানজট থেকে রেহাই মিলবে এমন আশা ‘আশা’ হিসাবেই নগরবাসীদের ললাটে ঝুলে থাকবে। কয়েকদিনের অনুসন্ধানে রাস্তায় নড়বড়ে-ভাঙাচোরা বাস, লাইসেন্সবিহীন চালক, ট্রাফিক আইন না মানার প্রতিযোগিতা সবই দৃশ্যমান হয়েছে।
গত সপ্তাহে দুপুরের দিকে ফকিরাপুল কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের সামনে চৌরাস্তায় দায়িত্বরত ছিলেন ট্রাফিক সার্জেন্ট সুমন। চৌরাস্তার প্রতিটি বাম লেন (লেফট বে) কেন বন্ধ? এই প্রশ্নে সার্জেন্ট বলেন, প্রাইভেটকার, রিকশা ও মোটরসাইকেল ডান দিকে যাবে। কিন্তু তারা বাম লেন একটু ফাঁকা পেয়ে সামনে চলে আসে। এতে করে বাম লেন পুরোপুরি ব্লক হয়ে গেছে। বাম লেন ফ্রে রাখার জন্য বললেও যানবাহন চালকরা তাতে কান দেন না। সার্জেন্ট সুমন আরো বলেন, কতজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব? সবাইকে আইন-নিয়ম মেনে চলার জন্য বলি। ট্রাফিক কনস্টেবলরা বাম লেন থেকে সরতে বললেও কয়েক পা সামনে এগিয়ে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।
একাধিক ট্রাফিক পুলিশের মতে, যানবাহনের তুলনায় রাস্তা নেই। যতটুকু আছে তা-ও ব্যবহার করা যাচ্ছে না ট্রাফিক আইন না মানার কারনে। লোকজন যেটুকু আইন মানেন তা এক কথায় বাধ্য হয়ে। এটাকে আইনের প্রতি সন্মান কিংবা দায়িত্বশীলতা বলা যাবে না।
একই দিন বিকেল ৩টায় বিজয়নগর মোড়ে ভিক্টর পরিবহণের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-০৯৮৩) আটকে তার সঙ্গে তর্ক করতে দেখা যায় সার্জেন্ট তৌহিদকে। ওই সময় সিগন্যাল ছিলো মূলত যেসব গাড়ি ফকিরাপুল হয়ে মতিঝিলের দিকে যাবে তাদের জন্য। আর উন্মুক্ত ছিলো কাররাইল থেকে যেসব গাড়ি পুরানা পল্টনের দিকে যাবে সেগুলোর জন্য। কিন্তু ওই মোড় থেকে লেফট বে ব্যবহার করে কাকরাইল রাজমনি সিনেমা হলের যাতায়াতে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকার কথা নয়। কিন্তু সিগন্যালে বাম, ডান সোজা সব রাস্তাই বন্ধ।
বাম লেনটি আটকে রখেছিলো ভিক্টর পরিবহনের ওই বাস। সার্জেন্ট তৌহিদ আর বাসে বসা চালকের সাথে কথা শুরু হয়। চালক, ‘স্যার আমার পেটে লাথি মাইরেন না’। সার্জেন্টের উত্তর ‘বাম লেন কেন বন্ধ করে রাখলেন? গাড়ির কাগজ কাগজপত্র দেন’। চালক, ‘ক্যামনে দিমু, গাড়ির তো মামলা আছে। কাগজপত্র নেই’। এ সময় চালক তার হেলপারের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এই ছট্টু সামনে যা, স্যারের সাথে কথা বল’।
সার্জেন্ট তৌহিদ বলেন, আনাড়ি ও বেপরোয়া গণপরিবহন চালকদের কারণে যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খল অবস্থা। একই রুটের দু’টি বাস পাশাপাশি থাকলে চালকরা তখন মানুষ থাকে না। বাম-ডান বলে কিছুই তারা মানে না। আড়াআড়িভাবে বাস দাঁড় করিয়ে রাখে। তিনি আরো বলেন, যানজটের পেছনে পরোক্ষভাবে বিআরটিএ অনেকটাই দায়ি। অধিকাংশ চালকেরই আসল ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। অনেকের আসল লাইসেন্স থাকলেও তারাও চালকের উপযুক্ত নন।
বিজয়নগর পানির ট্যাংকির বিপরীতে দায়িত্বরত সার্জেন্ট শফিকের কাছে প্রশ্ন, সামনের রাস্তার জন্য সিগন্যাল রয়েছে। কিন্তু সেগুনবাগিচার দিকে যেতে বাম লেনের যানবাহন আটকে আছে কেন? উত্তরে তিনি বলেন, অধিকাংশ প্রধান সড়কে বাম লেনের জন্য কয়েকশ’গজ দূর থেকে ডিভাইডার কিংবা বিকল্প ব্যবস্থা করা রয়েছে। কিন্তু এই সিগন্যালে বাম লেনের জন্য তেমনটা নেই। কিন্তু রিকশাচালকরা এতটাই অসচেতন কি আর বলা ওরা রাস্তা আটকে রাখে। রাস্তায় রশি বেঁধে রাখলেও ছিড়ে কিংবা নিচ দিয়ে চলে যাবে।
ট্রাফিক আইন না মানা এবং যানজট নিরসনে প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক দক্ষিণ) এসএম মেহেদী হাসান ইনকিলাবকে বলেন, আমরা ট্রিপল ‘ই’ নিয়ে করি। যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং, এডুকেশন এবং এনফোর্সমেন্ট নিয়ে। আমরা কাজ করি এনফোর্সমেন্ট নিয়ে। এর মধ্যে প্রথম দুইটা মানে ইঞ্জিনিয়ারিং ও এডুকেশনের কাজটি শতভাগ সঠিকভাবে প্রতিপালন করলে আমরা আমাদের ল এনফোর্সমেন্টের কাজটি সুচারুভাবে করতে সক্ষম হই। ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের ওপরে মোট ১৮টি সংস্থা কাজ করে। আমাদের পুলিশের কাজ হচ্ছে ওই ১৮টি সংস্থার একটি পার্ট। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চালকদের অসচেতনতা ও খামখেয়ালীপনার কারনে যানজট সৃষ্টি হয়। অল্প শিক্ষিত চালকদের প্রশিক্ষিত করার কাজটি কিন্তু বিআরটিএ এবং ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের। আমাদের কাজটি হচ্ছে শুধুমাত্র চালকরা আইন ভঙ্গ করছে কিনা। তাদের ল ইনফোর্স করা।
এসএম মেহেদী হাসান আরও বলেন, বাম লেন উন্মুুক্ত না থাকার একটি অন্যতম কারন হচ্ছে চালকদের ইচ্ছেকৃত খামখেয়ালীপনা। একিটি সিগন্যালে গাড়ি যে লেনে ছিলো সেভাবেই থাকার নিয়ম। কিন্তু হয়তো কোনো গাড়ি ডান দিকে কিংবা সোজা যাবে। এ সময় সিগন্যাল পড়েছে। কিন্তু বাম দিকে কিছুটা ফাঁকা। চালক ওই ফাঁকা জায়গায় গাড়ি ঢুকিয়ে দেয়। সবার মধ্যে একটি মানসিকতা গড়ে উঠেছে, একটি গাড়ির আগে যেতে পারলে হয়তো সময় বাঁচবে। আমাদের সচেতন হতে হবে। বর্তমানে সিটি কর্পোরেশনসহ সকলেই একসাথে চেষ্টা করে যাচ্ছেন একটি উন্নত গনপরিবহণ উপহার দিতে। এজন্য গণপরিবহন মালিক, শ্রমকি সরকার সকলের দায়িত্ব রয়েছে।
ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প নামে ২০০৯ ও ২০১৪ সালে দুটি সমীক্ষা করে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা। এই সমীক্ষা বলছে, যানবাহন ব্যবহার করে ঢাকায় প্রতিদিন ৩ কোটি ৩০ লাখ বার যাতায়াত হয়। এর ৭২ শতাংশ যাতায়াত হয় বাসে। আর বাস ও অটোরিকশায় যাতায়াত হয় ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ। বাকিটা প্রাইভেটকার ও অন্যান্য যানবাহনে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুসারে, যানজটের কারণে রাজধানীতে একটি যানবাহন ঘণ্টায় যেতে পারে গড়ে পাঁচ কিলোমিটার। এর ফলে দিনে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণায় বলা হয়, ২০০৪ সালে রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা ছিল গড়ে ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার। যানবাহনের সংখ্যা যদি একই হারে বাড়তে থাকে তাহলে ২০২৫ সালে গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার। আর সেটি মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন