বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

রাজধানী ঢাকা এখন ধূলার নগরী

| প্রকাশের সময় : ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আলহাজ আবুল হোসেন : মশা ও আবর্জনার দুর্নাম ঘুচানোর কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার অনেক আগেই রাজধানী মহানগরী ঢাকা নতুন একটি পরিচিতি পেয়ে গেছে। সে পরিচিতি ধূলার নগরীর। এ শুধু কথার কথা নয়, এ বিষয়ে জানার জন্য সংবাদপত্রের সচিত্র রিপোর্টের জন্যও অপেক্ষা করতে হবে না। ঢাকায় যারা বসবাস করেন তারা তো বটেই, যাদের এমনকি কয়েক ঘণ্টার জন্য ঢাকায় কাজে আসতে হয় তারাও জানেন, রাজধানী ঢাকা আসলেও ধূলার নগরীতে পরিণত হয়েছে। বস্তুত উত্তরা ও মিরপুর-পল্লবী থেকে সদরঘাট, কমলাপুর ও মুগদাপাড়া পর্যন্ত এমন কোনো এলাকার নাম বলা যাবে না, যেখানে প্রখর রোদে ও ঝলমলে আলোর মধ্যেও ধূলায় অন্ধকার না হয়ে থাকছে। গুলশান-বনানী কিংবা অতি অভিজাত কূটনৈতিক এলাকা বারিধারার কথা বলবেন? এসব এলাকাতেও ধূলার কবল থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায় নেই।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের আয়তন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সময়োচিত এবং যৌক্তিক। তবে এ সিদ্ধান্ত দুই সিটি কর্পোরেশনকে একই সঙ্গে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। কারণ রাজধানীর মানুষ আয়তন নয়, নাগরিক সুযোগ-সুবিধার প্রতিই বেশি আগ্রহী। নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে দুই সিটি কর্পোরেশনেই বিরাজ করছে হতশ্রী অবস্থা। রাজধানীর অভিজাত এলাকায়ও রাজপথে পড়ে থাকে ময়লা-আবর্জনা। বেশিরভাগ ফুটপাথই বেদখল। বর্ষা হলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় প্রায় প্রতিটি রাস্তাঘাটে। সিটি কর্পোরেশনের আয়তন বৃদ্ধির পাশাপাশি সামর্থ্য বৃদ্ধি না পেলে সর্বক্ষেত্রে হ-য-ব-র-ল অবস্থার যাতে সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে যুক্ত কোনো কোনো এলাকা আগে থেকেই নাগরিক সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর সে সুবিধার যাতে বিচ্যুতি না ঘটে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। সংযুক্ত এলাকার বেশিরভাগই সমস্যাবহুল। সেসব এলাকার নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণেও দুই সিটি কর্পোরেশনকে যতœবান হতে হবে।
রাজধানীবাসী ভুলেই গেছে, ঠিক কত বছর আগে বাংলামোটর থেকে মৌচাক-মালিবাগ ও শান্তিনগর এবং তেজগাঁও সাতরাস্তার ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। নির্মাণ কাজ চলছে তো চলছেই। শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। মাঝখানে মাস কয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে মগবাজার চৌরাস্তা হয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল পর্যন্ত মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের একটি অংশের উদ্বোধন করেছেন। কিন্তু সে পর্যন্তই। এরও পর ডিজাইনের ত্রুটি ধরা পড়েছে। সরকারের লোকজনকে বাংলামোটর থেকে মৌচাক পর্যন্ত ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেছে। তাদের কাজ এখনো চলছে জোর কদমে!  
তাই বলে একথা মনে করা কিন্তু ঠিক নয় যে, কেবলই ফ্লাইওভার নির্মাণের কারণে রাজধানী ধূলার নগরীতে পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থাও কয়েক মাসে কিংবা ফ্লাইওভার নির্মাণের মতো বিশেষ দু’একটি কারণে সৃষ্টি হয়নি।
একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে, বৃহত্তর রাজধানী মহানগরীর প্রতিটি এলাকাতেই ধূলার কবল থেকে বাঁচার জন্য মানুষকে নাকে কাপড়ের মাস্ক পরে কিংবা অন্য কোনোভাবে নাক ঢেকে চলাচল করতে হচ্ছে। উদাহরণ দেয়ার জন্য রিপোর্টে সোয়ারিঘাট থেকে বাবুবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ সড়কের দুরবস্থার উল্লেখ করা হয়েছে। সড়কটি বহুদিন ধরেই ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। তার ওপর আবার এই সড়কের দু’পাশে সিটি কর্পোরেশেনের ট্রাকগুলো এসে টনকে টন আবর্জনা ফেলে যাচ্ছে প্রতিদিন। সড়কটি দিয়ে গাড়িও চলাচল করছে শত শত। ফলে নোংরা আবর্জনামিশ্রিত ধূলায় ছেয়ে যাচ্ছে চারদিক। এরই পাশাপাশি মিরপুর ৬, ১০, ১১, ১২, ১৩ ও ১৪ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় চলছে উত্তর সিটি কর্পোরেশেনের উন্নয়ন কার্যক্রম। খোঁড়াখুঁড়ির একই কার্যক্রম চালানো হচ্ছে মিরপুর ১০ নম্বর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত দীর্ঘ সড়কেও। এখানে আবার উপলক্ষ মেট্রোরেলের জন্য সড়ক নির্মাণ। আর খোঁড়াখুঁড়ির অর্থই যেহেতু ধূলার বিস্তার ঘটানো সেহেতু শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে মানুষের। দৈনিকটির রিপোর্টে রাজধানী মহানগরীর আরো অনেক এলাকার নাম রয়েছে, যেসব এলাকায় একদিকে দুই সিটি কর্পোরেশন পাল্লা দিয়ে উন্নয়ন কার্যক্রম চালাচ্ছে, অন্যদিকে অসংখ্য সড়ক ও অলিগলি পড়ে রয়েছে ভাঙাচোরা অবস্থায়। ফলে সব মিলিয়েই বিস্তৃত হচ্ছে ধূলার সাম্রাজ্য।
পরিস্থিতির ক্ষতিকর বিভিন্ন দিক সম্পর্কেও উল্লেখ রয়েছে রিপোর্টটিতে। এসবের মধ্যে প্রাধান্যে আছে মারাত্মক অনেক রোগের বিস্তার। সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, হাঁপানি এবং চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের কষ্টের কোনো সীমা থাকছে না। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে জড়িত একাধিক সংগঠনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব অসুখের চিকিৎসার জন্য মধ্য ও নিম্নবিত্তদের প্রতি মাসে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। অর্থাৎ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে মানুষের। তবুও সম্পূর্ণ মুক্তি মিলছে না অসুখের কবল থেকে।
বলা দরকার, রাজধানী মহানগরীর এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ, সরকার এবং তার বিভিন্ন বিভাগ ও দফতর-অধিদফতর তো রয়েছেই, পাশাপাশি আছে দু’দুটি সিটি কর্পোরেশন। ‘অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’ প্রবাদ বাক্যটিকেই তারা সত্য প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন কিনা, সে জিজ্ঞাসায় যাওয়ার পরিবর্তে আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের কর্তব্য ও দায়িত্বের কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। অপরিকল্পিত কিংবা কেবলই টাকার ‘শ্রাদ্ধ’ করার উদ্দেশ্যে হলেও ফ্লাইওভার নির্মাণসহ উন্নয়ন কার্যক্রমের ব্যাপারে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। আমরাও আপত্তি জানাচ্ছি না। আমাদের আপত্তি ও প্রতিবাদের আসল কারণ দায়িত্বের বিষয়টি ভুলে যাওয়া কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা। লক্ষ্য করলে এই অভিযোগ অনস্বীকার্য হয়ে উঠবে যে, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা থেকে ধূলা প্রতিরোধ করার বা ধূলার বিস্তার কমানোর জন্য সড়কে সড়কে পানি ছেটানোর সামান্য কাজটুকু পর্যন্ত করছে না কোনো কর্তৃপক্ষ। আমরা মনে করি, সরকারের উচিত ফ্লাইওভার বা মেট্রোরেল ধরনের বিরাট কোনো প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু করার আগে ধূলা প্রতিরোধের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন দফতর-অধিদফতরের পাশাপাশি দুই সিটি কর্পোরেশনের উচিত নাগরিকদের স্বাস্থ্যের প্রশ্নে অনেক বেশি সচেতন হওয়া। এ উদ্দেশ্যে ধূলার বিস্তার তো প্রতিরোধ করতেই হবে, একই সঙ্গে পরিচ্ছনতার অভিযানও চালাতে হবে নিয়মিতভাবে। সব মিলিয়ে আমরা চাই, রাজধানী মহানগরীকে যেন ধূলার নগরী নামে চিহ্নিত হতে না হয়।
রাজধানীর বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে নাগরিকদের অনেক সময় বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। অথচ বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়নমূলক কাজ সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে করার ব্যবস্থা থাকলে এ অবস্থা সৃষ্টি হতো না। নাগরিক ভোগান্তির সঙ্গে অর্থের অপচয়ও রোধ করা যেত। সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন সংস্থাগুলোকে সমন্বিত করে একই কর্তৃপক্ষের আওতায় নিয়ে দরকার। সমন্বয়ের অভাবে নগরবাসীর দুর্ভোগের মাত্রা যেমন কমে না, তেমনি সরকারি তহবিলের অর্থের অপ্রয়োজনে ব্যয়ও বাড়ে।
বর্তমানে অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, রাজধানীতে একটি সংস্থা রাস্তা খোঁড়ে তো অন্য সংস্থা রাস্তা কার্পেটিংয়ের কাজে হাত দেয়। কোনো সংস্থা বর্ষা মৌসুমেই মাটি খুঁড়ে পাইপ বসায়। কেউ এ সময় ড্রেনের কাজ করে। এভাবে সমন্বয়হীনভাবে বিভিন্ন সেবামূলক সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা স্ব-স্ব পরিকল্পনামাফিক কাজ করে। অথচ এসব কাজ যাদের জন্য সেই নাগরিকরাই এহেন বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত ও সমন্বয়হীন কাজের ফলে নানাবিধ বিড়ম্বনার শিকার হন। তারপরও সারা বছরই ওয়াসা, ডেসা, তিতাস গ্যাস ও টেলিফোন বিভাগের দফায় দফায় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলতেই থাকে। এভাবে অপ্রতুল ব্যয় বরাদ্দের একটা অংশ অপচয় হয়। আমরা চাই, নাগরিক ভোগান্তির সঙ্গে অপচয় স্থায়ীভাবে বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হোক। এ জন্য সেবা সংস্থাগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সমন্বয় সাধনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এ ধরনের সমন্বিত ব্যবস্থা থাকলে ওয়াসা ও ডিএসসিসি কি একই উদ্দেশ্যে দুটি ভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে বিপুল অংকের অর্থ অপচয় করতে পারত! আমলাতান্ত্রিক জটিল সমীকরণের ফেরে পড়ে নাগরিক সেবা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া উচিত নয়। রাজধানীসহ বিভিন্ন নগরীর সেবামূলক সংস্থাগুলোর কাজের সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া এখন সময়ের দাবি।
য় লেখক : সদস্য, নির্বাহী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি),  ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল ও সভাপতি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ পরিষদ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন