নানা উদ্যোগ নেয়ার পরও কোনোভাবে ঠেকানো যাচ্ছে না মানবপাচার। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে মানবপাচার হচ্ছে। ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানব চক্রের আট গ্রুপের সন্ধানে মাঠে নেমেছে র্যাব, সিআইডি ও গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম। লিবিয়ায় কর্মী পাঠানো বন্ধ থাকায় পাচারকারী সিন্ডিকেট ভ্রমণ ভিসায় বিদেশগামীদের ভারত, নেপাল, দুবাই, মিসর ও জর্দান ঘুরিয়ে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের পাচার করছে। মানবপাচারের সঙ্গে রাজধানীসহ ১৫ জেলার অন্তত ৮টি গ্রুপ জড়িত। গত বছরের ২৭ মে লিবিয়ার মিজদায় ২৬ জনকে গুলি করে হত্যার ২৫টি মামলার তদন্তে এমনই তথ্য পেয়েছে র্যাব, সিআইডি ও পুলিশের কর্মকর্তারা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, মানবপাচারের মামলায় দেশের দালাল ও সহযোগীদের গ্রেফতার করলেও লিবিয়া, দুবাই ও ইতালিতে থাকা হোতাদের গ্রেফতার করা যায়নি। আন্তর্দেশীয় তদন্ত না হওয়ায় লিবিয়ার ফার্ম হাউসে সক্রিয় পাচারকারীদের পর্যন্ত পৌঁছায়নি তদন্ত কার্যক্রম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, দুবাইয়ে অবস্থান করে লিবিয়া ও ইউরোপে মানবপাচারকারীদের মধ্যে গাজী, কাজী ও বাবুল বেশি আলোচিত। রুবেলের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বড় ভাটারায়। তারা লিবিয়ায় তানজিমুল ও আবদুল্লাহর কাছে লোক পাঠান।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, দালালরা আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। চক্রের মূল হোতারা দেশের বাইরে বসে অনলাইন ভিসা ও বিমানের টিকিটের ব্যবস্থা করে। মানব পাচারকারী চক্রের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করছে র্যাব। এ চক্রের মুলহোতাদের গ্রেফতারে র্যাব সারাদেশে সক্রিয় রয়েছে। তবে মানবপাচারকারী চক্রের হাত থেকে রক্ষা পেতে সকলকে সচেতন হতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যার অভিযোগে দেশে ২৯টি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোর ২৫টি তদন্ত করে ২৩টির অভিযোগপত্র দিয়েছে সিআইডি। একটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। একটি তদন্তাধীন। তদন্তে পাচারচক্রের ২৯৯ জনের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে ১৭১ জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি, থানা পুলিশ ও র্যাব। এদের ৪২ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। বাকি ১২৮ জন অধরা।
মানবপাচারের মামলাগুলোর তদন্ত তদারক কর্মকর্তা বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ সাইদুর রহমান বলেন, প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে টাকা ফেরত পেলে অনেকে আর মানবপাচারকারীদের নামে মামলা করে না। কিছু ব্যক্তি মামলা করলেও মানবপাচারকারীদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা দেয় না। লিবিয়া থেকে তিউনিশিয়ার চ্যানেল হয়ে পাচার হচ্ছে বেশি। লিবিয়ার ফার্ম হাউসে এদের জিম্মি করে রাখা হয়। সেখানে কিছু বাংলাদেশিও আছে। লিবিয়ায় বেঁচে যাওয়া ৯ জনকে আমরা নিয়ে এসেছি। তাদের এদের বর্ণনায় ইউরোপে ও লিবিয়ায় সক্রিয় কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। দেশ থেকে যারা পাঠিয়েছে তাদের নামও এসেছে। মানবপাচারকারী চক্রের সাথে জড়িতদের গ্রেফতারে সিআইডির কর্মকর্তারা কাজ করছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, মানবপাচারকারী চক্র আসলে অনেক শক্তিশালী। র্যাব, সিআইডি ও ডিবি যাদের গ্রেফতার করেছেÑ তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, কয়েকটি ধাপে মানবপাচারের কাজ করা হয়। প্রথমে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধভাবে বিদেশে যেতে ইচ্ছুকদের বাছাই করা হয়। এরপর তাদের পাসপোর্ট, ভিসা, টিকিট কেনার কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা নেয়া হয়। প্রাথমিক কাজ শেষ করে মানবপাচার চক্রটি রুট চিহ্নিত করে। বাংলাদেশ থেকে তুরস্কের ইস্তানবুল হয়ে লিবিয়া একটি রুট, বাংলাদেশ থেকে ভারত-শ্রীলংকা হয়ে লিবিয়া এবং দুবাই-জর্ডান হয়ে লিবিয়া-এই তিনটি রুট ব্যবহার করা হয়। যে রুটই ব্যবহার করা হোক না কেন, লিবিয়ার ত্রিপলিতে নেয়ার পর সেখান থেকে ইউরোপের দিকে পাঠানো হয়।
ওই কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, নৌকায় পাচারকারী চক্রের কেউ থাকে না। যারা অবৈধভাবে যাচ্ছে, তাদেরকেই নৌকা চালানো এবং দিক নির্ণয়ের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে সাগরে ছেড়ে দেয়। মানবপাচারের কোনো ঘটনা আলোচনায় এলে, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো তৎপর হয়। কিন্তু মানবপাচারের বিরুদ্ধে অভিযানের ধারাবাহিকতা থাকে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন