দীর্ঘদিন ধরে দেশে মানব পাচার চক্র সক্রিয় রয়েছে। এ চক্রের সদস্যরা সাধারণ মানুষকে বিদেশে চাকরি দেয়ার নানা প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করে দিচ্ছে। এতে আর্ন্তজাতিকভাবে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হচ্ছে। আফ্রিকার বিভিন্ন উপকুল থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে প্রবেশ অথবা সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ায় যাওয়ার সময় সমুদ্রে বা সীমান্তরক্ষীদের হাতে আটক হওয়াদের মধ্যে বাংলাদেশিদের নাম হরহামেশাই উঠে আসছে। মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি অভিবাসির অবৈধ হয়ে পড়া এবং আটক ও পুলিশি হয়রানির শিকার হওয়ার বিষয়টি ভিন্ন। তবে অবৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণে বিদেশে পাঠানোর কারণে সৃষ্ট জটিলতাগুলোকেও একপ্রকার মানব পাচার হিসেবেই গণ্য করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে মানব পাচারের বিষয়টি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। মানবপাচারকারিরা নারী ও তরুণীদের টার্গেট করেছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। ইউরোপে ও মধ্যপ্রাচ্যে উচ্চ বেতনের চাকরি ও কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচার করে কলকাতা, দিল্লী ও মুম্বাইয়ে টর্চার সেলে নির্যাতন, যৌনকর্মী হতে বাধ্য করা এবং সেখান থেকে মধ্যপ্রাচ্যে বিক্রি করে দেয়ার তথ্য বেরিয়ে এসেছে প্রতিবেদনে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, উচ্চ আয় ও বিলাসী জীবনযাপনের প্রলোভন দেখিয়ে দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে নারী ও তরুণীদের ভারতে পাচার করার সাথে জড়িত ৫টি বড় চক্র কাজ করছে। মিথ্যা প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে বাংলাদেশের অন্তত ১৫ জেলা থেকে নারীদের সংগ্রহ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়–, তেলেঙ্গানা, কেরালা, কর্নাটক ও উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, ম্যাসাজ পার্লার এবং স্পা সেন্টারে এসব তরুণী ও নারীদের যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। চক্রের সাথে অনেক লোক জড়িত থাকলেও ভারত ও বাংলাদেশের মোট ১৪-১৫ জনের নাম পাওয়া গেছে, যারা এসব চক্রের নেতৃত্ব ও নির্দেশনা দিয়ে কাজ করিয়ে থাকে। টর্চার সেলে রেখে নির্যাতন ও যৌণকাজে বাধ্য করা ছাড়াও অনেককে জিম্মি হিসেবে আটক করে মোটা অংকের অর্থ আদায়ের কথাও জানা জানা গেছে। র্যাবের এই অনুসন্ধান রিপোর্ট প্রকাশের অনেক আগেই বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশি তরুণীদের ভারতে পাচার হওয়া ও অনৈতিক কাজে বাধ্য করার সংবাদ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। টিকটক ভিডিও বানানোর কথা বলে ঢাকার এক তরুণীকে ভারতে নিয়ে যৌণ নির্যাতন করার ভিডিও কয়েক মাস আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। পালিয়ে আসা তরুণীর দেয়া অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশের হাতে ধরা পড়া ব্যক্তিরা নারী পাচারের কথা স্বীকার করে। তবে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না থাকায় নারী পাচার বন্ধ হয়নি।
প্রায় ২ বছর আগে ২০২০ সালের শুরুতে র্যাবের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, দেড় বছরে শুধুমাত্র ড্যান্সক্লাবের আড়ালে সহ¯্রাধিক নারী বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। ড্যান্সক্লাবের নামেই যদি এত সংখ্যক নারী পাচার হয়ে থাকে, অন্যান্য প্রলোভনে পাচার হওয়া নারী-পুরুষের সংখ্যা নি:সন্দেহে আরও বেশি। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার দেয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ মানুষ অবৈধভাবে বিদেশ যায়। এদের একটি বড় অংশই যায় পাচারকারীদের হাত ধরে। দুবাইয়ের নাইটক্লাবে অথবা অশিক্ষিত গ্রাম্য নারীদের সউদী আরবে লোভনীয় বেতনে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগের কথা বলে বা অন্য যেভাবেই হোক, অবৈধ প্রক্রিয়ায় যাওয়া বেশিরভাগই নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশি নারীদের এমন নির্যাতন ও অবমাননার শিকার হওয়ার ঘটনা জাতি হিসেবে আমাদের ভাব মর্যাদার জন্য হানিকর ও লজ্জাজনক। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর পক্ষ বিভিন্ন সময়ে এসব ঘটনার নেপথ্য তথ্যাবলী তুলে ধরা হলেও পাচারকারীদের মূল হোতাদের ধরার নজির নেই বললেই চলে। এতে পাচারকারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। নারী পাচারের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদেরও দায় রয়েছে। বিদেশে চাকরি এবং লোভনীয় অফার দেখে তারা লোভাতুর হয়ে পড়ে। এটা বিবেচনা করে না, কার হাতে সন্তানকে তুলে দিচ্ছে এবং কিভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে গিয়ে কি করবে? এসব বিষয় যাচাই না করে শুধু লোভে পড়ে সন্তানকে দালাল তথা পাচারকারীদের হাতে সন্তানকে তুলে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে যদি অভিভাবকরা সচেতন না হয়, তবে পাচার কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না। পাচার রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ গণমাধ্যমকেও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে। দুই দেশের পুলিশ ও সীমান্তরক্ষিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দল বেঁধে পাচারের বিষয়টি প্রশ্নের উদ্রেক করে। পাচারকারীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যের যোগসাজশ না থাকলে এভাবে পাচার সম্ভব নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, নানা ইস্যুতে এখন বাংলাদেশের উপর আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি রয়েছে। মানবপাচারের ঘটনাও তাদের দৃষ্টির বাইরে যাবে না। ফলে মানবপাচারের বিষয়টিও তারা আমলে নিতে পারে। এ প্রেক্ষিতে, মানবপাচারকারীদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন