বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির উপর বড় ধরনের আঘাত হানতে শুরু করেছে। করোনাকালে লাখ লাখ মানুষ কর্মসংস্থান হারানোর পর অধিকাংশ মানুষের আয় এবং ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলেও ডলারের মূল্যের হাত ধরে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির যাঁতাকলে সাধারণ মানুষের জীবন যখন দুর্বিষহ, তখন ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার প্রেক্ষাপটে জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তায় নতুন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশে চাহিদা অনুসারে গ্যাস সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ গ্যাসনির্ভর শিল্পকারখানাগুলো চরম সংকটে পড়েছে। গড়ে দিনে ৮-১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকার কারণে কলকারখানায় একদিকে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে, অন্যদিকে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে তৈরী পোশাকসহ রফতানিমুখী শিল্পকারখানায় ক্রয়াদেশ কমে গেছে। গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কোথাও কোথাও দিনে ১৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ থাকায় কল-কারখানার উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংকঋণের সুদের চাপ এবং উৎপাদন ও রফতানি কমে যাওয়ায় লোকসানের মুখে থাকা কারখানাগুলো এখন কর্মী ছাঁটাইয়ের উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। বিশেষত দেশের তৈরী পোশাক খাতে অর্ধকোটির বেশি নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থান আছে। তৈরী পোশাক কারখানা, বস্ত্রমিল, টেক্সটাইল মিল, নীটিং কারখানার শ্রমিকদের পাশাপাশি পাটকল, রফতানিমুখী ওষুধশিল্পসহ ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ কারখানায় কর্মরত লাখ লাখ শ্রমিক ও উদ্যোক্তা এখন চরম উদ্বেগে পড়েছে।
গতকাল ইনিকলাবে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, বৈশ্বিক মন্দার কারণে লোকসান ঠেকাতে যশোরে বেসরকারি একটি পাটকলের ৬ হাজারের বেশি শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। একই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা করছে দেশের ছোট-বড় সব শিল্প কারখানার শ্রমিকরা। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রবণতা দৃশ্যমান। রেমিট্যান্স প্রবাহের পারদ ক্রমশ নি¤œমুখী। ডলারের বিপরীতে টাকার মান অস্বাভাবিক গতিতে কমে যাওয়া এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় নিয়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ছে সংশ্লিষ্ট সকলের কপালে। পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় সরকারি-বেসরকারি ২০টি ব্যাংক আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে পারছে না। দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ এক জটিল সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এহেন বাস্তবতায় কলকারখানা বন্ধ বা ব্যাপক হারে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কারণে দেশে একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে। কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার ন্যূনতম আশ্রয়টুকু রক্ষায় সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শিল্প ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামে গ্যাস সংকটের জন্য কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি পেট্রোবাংলাকে অভিযুক্ত করেছে। বৈশ্বিক সংকটে দেশীয় জ্বালানি সম্পদ ব্যবহারে যে ধরনের বাড়তি সর্তকতা ও উদ্যোগ গ্রহণের কথা, তার যথেষ্ট ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
গতকাল দেশের প্রথম সারির বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পাতায় ব্যাংকিং খাতে দুর্দশা এবং অর্থনৈতিক মন্দার চালচিত্র নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দেশের কর্মসংস্থান এবং অর্থনীতির স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির প্রধান খাত তৈরী পোশাক খাত এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রবণতার পাশাপাশি ছোটবড় প্রায় সব কলকারখানায় কর্মী ছাঁটাইয়ের বাস্তবতা দেশে বড় ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটকে নির্দেশ করছে। এহেন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে দেশের রফতানি বাণিজ্য, আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ জোরালো করা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল-পেট্রোলের দাম আবারো বেড়ে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। খুব শীঘ্রই জ্বালানি-বিদ্যুৎখাতের আশাব্যঞ্জক উন্নতি আশা করা যাচ্ছে না। আরো অন্তত দু’তিন বছর সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী। তবে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হওয়ায় গ্যাস ও ডিজেল সরবরাহ বাড়ানোর মধ্য দিয়ে বিদ্যুতের ঘাটতি ও লোডশেডিং কমিয়ে আনা অসম্ভব নয়। দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, অর্থপাচার রোধ ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিপর্যয় অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি তেলের পাশাপাশি খাদ্য আমদানিতেও সংকট দেখা দিতে পারে। এ দিক বিবেচনা করে কৃষিখাতের উৎপাদনশীলতা ও প্রবৃদ্ধির দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ বৈদেশিক ঋণ-উন্নয়ন সহায়তার অপচয় রোধ ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি প্রকল্পে কৃষিখাত ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। কলকারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই রোধে সরকার এবং প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠনগুলোর কার্যকর উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন