দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের তোষণ এবং নিরীহদের হয়রানির বিষয়ে এবার সরাসরি অসন্তোষ প্রকাশ করলেন হাইকোর্ট। আদালত সুস্পষ্ট করে বলেছেন, দুদক রাঘব বোয়াল নয়, শুধু চুনোপুঁটি নিয়ে ব্যস্ত। বড় বড় ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সংস্থাটির পক্ষের আইনজীবীদের একহাত নিয়ে হাইকোর্ট আরো বলেছেন, ঋণখেলাপিরা আইনের চেয়ে শক্তিশালী নয়। তাহলে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হচ্ছে, আপনারা ধরছেন না কেন? যারা বড় বড় ঋণখেলাপি তারা কি বিচারের ঊর্ধ্বে থাকবে? যারা অর্থশালী তারা কি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে? দুদক রাঘব বোয়ালদের নয়, শুধু চুনোপুঁটিদের ধরতে ব্যস্ত আছে।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার এবং বিচারপতি খিজির হায়াতের ডিভিশন বেঞ্চ গতকাল রোববার এ মন্তব্য করেন। অবশ্য বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ ইতোপূর্বেও বহুবার দুদকের কার্যক্রম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে আদালতের এসব মন্তব্যকে যেন থোড়াই তোয়াক্কা করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রমাণস্বরূপ গত ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এক মতবিনিময় সভায় সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তা দাবি করেন, রাঘববোয়াল ধরার ক্ষেত্রে দুদক বিশ্বে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।
গতকাল মন্তব্যের প্রাসঙ্গিকতায় ছিল, আলোচিত বিসমিল্লাহ গ্রুপের বিরুদ্ধে ৯ বছর ধরে চলমান তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল না করা। দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে থাকা মামলাটির এজাহারভুক্ত আসামি সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা এএসএম হাসানুল কবিরকে জামিন দিয়েছিলেন বিচারিক আদালত। তার জামিন বাতিলের আবেদন করে দুদক। সেটির শুনানিকালে আদালত উপরোক্ত মন্তব্য করেন। ২০১৩ সালে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে বিসমিল্লাহ গ্রুপ জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ গ্রহণের মামলা করে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তফসিলভুক্ত হওয়ায় মামলাটির তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। ৯ বছরেও মামলাটির তদন্ত শেষ না হওয়ায় হাইকোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এ সময় সরকারপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিনউদ্দিন শুনানিতে অংশ নেন।
এর আগে বিসমিল্লাহ গ্রুপের এমডি খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরীসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ২৯ মার্চ মামলা করে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা নকীবুল ইসলাম। মামলার ধারা দুদকের তফসিলভুক্ত হওয়ায় তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ মামলায় ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর ব্যাংকটির তৎকালীন ডেপুটি ম্যানেজার এএসএম হাসানুল কবীর ও জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট জান্নাতুল মাওয়াসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়। ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর এই দুইজনকে জামিন দেন বিচারিক আদালত। পরে সেই জামিন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করে দুদক। ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট রুল জারি করেন। এর মধ্যে ২০১৮ সালে এ মামলা পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।
গতকাল ওই ২ জনের জামিন বাতিল প্রশ্নে রুল শুনানিতে হাইকোর্ট দুদকের আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বলেন, ১১০ কোটি টাকা নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় ২০১৩ সালে মামলা হয়েছে। এ মামলায় এখনো কেন বিচার হচ্ছে না? এদের ধরবে কে? আপনারা ধরছেন চুনোপুঁটি। তখন দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, অবশ্যই দুদকের ধরা উচিত, এদের ধরবে।
এসময় আদালত বলেন, কবে ধরবেন? মামলা ২০১৩ সালে। চার্জশিট ২০১৫ সালে। এরপর ফের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এত বছর হয়ে গেল। এগুলোর কী হবে? এতে কি বোঝা যায় না যে, যারা অর্থশালী, পাওয়ারফুল, তারা বিচারের ঊর্ধ্বে? এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে কেন? আপনারা বিষয়টি সিরিয়াসলি নিতে দুদক চেয়ারম্যানকে বলবেন। এ ধরনের মামলাগুলো কেন শেষ হচ্ছে না? কেন প্রতিবেদন দেয়া হচ্ছে না? ৯ বছর চলে গেছে। এসময় এক আসামির আইনজীবী বলেন, আমরা তো নিম্নস্তরের ব্যাংকার। তখন আদালত প্রশ্ন করেন, মামলার প্রধান আসামি খাজা সোলায়মান কে? জবাবে খুরশিদ আলম খান বলেন, বিসমিল্লাহ গ্রুপের। তিনি এখন পলাতক। এক মামলায় তার সাজা হয়েছে। তাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতারে আপনার কোর্টের আদেশ রয়েছে। তখন আদালতে অন্য মামলার শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিনউদ্দিন আসেন। আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, দেখেন অ্যাটর্নি জেনারেল মামলার অবস্থা! ২০১৩ সালের মামলা এখনো প্রতিবেদন দেননি। ১১০ কোটি টাকার মামলা। এরপর দুদক আইনজীবী বলেন, আমরা হালনাগাদ তথ্য জানাব।
অসন্তোষেও বেপরোয়া দুদক
এর আগে দুদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আচরণে, গতবছর ৪ অক্টোবর অসন্তোষ প্রকাশ করেন বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ। তখন আদালত বলেন, যারা দেশের বাইরে বেগমপাড়া করছেন, যারা মালয়েশিয়া, আমেরিকাতে টাকা পাঠাচ্ছেন, এগুলো হলো বড় বড় মানিলন্ডারিং, তাদের ধরুন।
দিনাজপুরের রাজনীতিক খলিলুল্লাহ আজাদ মিল্টনের জামিন আবেদনের শুনানিকালে আদালত দুদক আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলেন, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন যদি এভাবে ছোটে তাহলে দেশের উন্নয়ন হবে কীভাবে? যারা দেশের বাইরে বেগমপাড়া করছেন, যারা মালয়েশিয়া, আমেরিকা টাকা পাঠাচ্ছেন, এগুলো হলো বড় বড় মানিলন্ডারিং, তাদের ধরুন।
বৃহৎ অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান-তদন্ত প্রশ্নে সংস্থাটির ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন একই আদালত। হাইকোর্ট অর্থপাচারকারীদের তালিকা চাইলেও সেটি প্রদানে দুদক গড়িমসি ও কালক্ষেপণ করে। এ প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ দুদকের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ওইসময় দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান পাচারকৃত অর্থফেরত আনার বিষয়ে নিজেদের অতীত অর্জন তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমরা আরাফাত রহমান কোকোর পাচারকৃত অর্থফেরত এনেছি। আরো বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত অর্থ জব্দ করা হয়েছে। এসময় আদালত বলেছিলেন, পুরাতন কাহিনী বলে লাভ নেই। আমাদের আদেশের পর কী করেছেন তা দেখতে চাই। তার একটা ফিরিস্তি দেন। যারা অবৈধভাবে দেশের টাকা পাচার করে বিদেশে গাড়ি-বাড়ি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন সেটি জানতে চাই। আমরা দেশ ও দেশের মানুষকে সহযোগিতা করতে চাই। অর্থপাচার নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, সেটিকে ‘অশনিসঙ্কেত’ বলেও উল্লেখ করেন হাইকোর্ট।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিনউদ্দিন আদালতকে বলেছিলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য সময় চেয়েছে। তারা বলেছে, বিদেশি মিশনগুলোর কাছ থেকে নির্দেশনা পেলে অর্থপাচারের প্রতিবেদন জমা দেবে। তিনি বলেছিলেন, বিএফআইইউ জানিয়েছে বাইরের দেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটগুলোর সঙ্গে তাদের চুক্তি রয়েছে। এই চুক্তির কারণে তারা অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশ করতে পারবে না। তবে তথ্য চেয়ে বিএফআইইউকে চিঠি দেয়া হয়েছে বলেও জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
এদিকে উচ্চ আদালত দুদকের কার্যক্রম নিয়ে যতই অসন্তোষ প্রকাশ করুক না কেন, তাতে যেন থোড়াই পরোয়া করছে দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা। অর্থনৈতিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের দুদকের দায়মুক্তি প্রদান এবং অনুসন্ধান-তদন্তের নিরপরাধ ব্যক্তিদের হয়রানি করার বিষয়ে দৈনিক ইনকিলাব বহু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এসবের মধ্যে, গতবছর ১৪ মার্চ প্রকাশিত দুদকে অনুসন্ধান বাণিজ্য। ‘বহু রাঘব বোয়ালকে ছেড়ে দেন’, শীর্ষক ইকবাল মাহমুদের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ দুদকের প্রতি স্বপ্রণোদিত রুল জারি করেন। রুলটি এখন শুনানির অপেক্ষায়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বিদায়ের শেষ ৫ মাসে ২ শতাধিক দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দায়মুক্তি দিয়ে যান।
লুটেরাদের পৃষ্ঠপোষকতা-কৃষকের হাতে হাতকড়া :
চলতি বছর ৪ আগস্ট ‘দুদকের দায়মুক্তি ব্যাংক কর্মকর্তাসহ তিনজনকে শত শত কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইনকিলাব। প্রতিবেদনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গত ১ অক্টোবর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার এবং বিচারপতি খিজির হায়াতের ডিভিশন ‘জাবের অ্যান্ড জোবায়ের’, ‘ডলি কনস্ট্রাকশন’, ‘সোনালী টেক্সটাইল’ এবং ‘জজ ভূঁইয়া (জেবি) গ্রুপের বিরুদ্ধে দুদকের করা অনুসন্ধানের রেকর্ডপত্র তলব করেন। গত ৬ নভেম্বরের মধ্যে রেকর্ডপত্র দাখিলের কথা থাকলেও দুদক গতকাল রোববার অবধি কোনো রেকর্ডপত্র দাখিল করেনি। কালক্ষেপণের কৌশলে সংস্থাটি ‘জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিকস লি: কে রিটে পক্ষভুক্তির সুযোগ করে দেয়। একই সম্পত্তির একাধিক দলিল সৃষ্টি করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রযেছে জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিকস লি:-এর মূল প্রতিষ্ঠান ‘নোমান গ্রুপ’র বিরুদ্ধে। অদৃশ্য ইশারায় অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে, মর্মে অভিযোগ তোলা হয়েছিলো প্রতিবেদনে। শিগগিরই এ বিষয়ে শুনানির উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন দৃষ্টি আকর্ষণকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
এদিকে রাঘববোয়াল ছেড়ে চুনোপুঁটি ধরার বিষয়ে হাইকোর্ট চরম অসন্তোষ প্রকাশের ২ দিন আগেই গণমাধ্যমের কল্যাণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় একটি সংবাদ। তাতে বলা হয়, মাত্র ২৫ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ না করার মামলায় পাবনার ঈশ্বরদীতে ১২ কৃষককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর আগে গত ২৩ নভেম্বর পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেট আদালত ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় ৩৭ কৃষকের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনকারী রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় না আনা হলেও ২৫ হাজার টাকা ঋণখেলাপি কৃষকের হাতে হাতকড়া পড়ছে। দুর্নীতি দমন প্রশ্নে একই দেশে দুই নীতি সম্পর্কে ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকনোমিক রিসার্চ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ এহসানুল আলম পারভেজ ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশের আইনের হাত এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের হাত, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাধরদের ঘাড় মটকানোর মতো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। এ কারণে গরিব,অসহায় কৃষক আইনের বেড়াজালে পড়ে যায়। এটি আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার ব্যবস্থার বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন