সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বিলুপ্ত ‘ব্যুরো’তে ফিরে যাচ্ছে দুদক?

বদলি-পদায়ন-আর্থিক ক্ষমতা সচিবের হাতে উদ্বেগ টিআইবি’র

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৮ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অধীন, পরে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান ছিলো ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’। সরকার তথা নির্বাহী বিভাগের প্রভাবের কারণে দুর্নীতি দমন ব্যুরো দুর্নীতি দমনে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছিলে না। সংস্থাটি পরিচালিত হতো সরকারের ইচ্ছায়। সরকারের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ থাকলেও অনুসন্ধান- তদন্ত করা যাচ্ছিলো না। এমনকি সরকারের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো ব্যুরো। সরকারের ফুট-ফরমায়েশ খাটাই হয়ে উঠেছিলো দুর্নীতি দমন ব্যুরোর প্রধান কাজ। ‘পিক অ্যান্ড চ্যুজ’র ভিত্তিতে সরকারের অপছন্দের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে হয়রানি করাই মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায় প্রতিষ্ঠানটির। এতে দুর্নীতি দমন ব্যুরো একটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এ প্রেক্ষাপটে সুশীল সমাজের দাবি, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার চাপে দুর্নীতি বিরোধী একটি স্বাধীন সংস্থা প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। ২০০৪ সালে আইন করে ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’ বিলুপ্ত করা হয়। গঠন করা হয় স্বাধীনত স্বশাসিত ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’। এর ফলে দুর্নীতি বিরোধী একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনতা মুক্ত হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন পরিচালনায় প্রণয়ন করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারি বিধিমালা। আইনানুসারে সার্চ কমিটির মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া ৩ জন ব্যক্তিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের ‘কমিশনার’ নিয়োগ দেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট। তাদের মধ্য থেকে একজনকে কমিশনের ‘চেয়ারম্যান’ নিযুক্ত করেন তিনি। কমিশনের সকল প্রকার নিয়োগ, বদলি,পদোন্নতি, অনুসন্ধান-তদন্তের সিদ্ধান্ত,বিধি প্রণয়নের সকল ক্ষমতা দেয়া হয় তিন কমিশনারের সমন্বয়ে গঠিত কমিশনকে। আইন অনুযায়ী, দুদকের একজন সচিব থাকবেন। এ সচিব নিয়োগ দেবে কমিশন। তিনি কমিশন সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। কমিশনের বৈঠকের এজেন্ডা নির্ধারণ, বৈঠকের সময়সূচি নির্ধারণসহ সুনির্দিষ্ট কার্যাদি সম্পাদন করবেন। কমিশনে সচিব নিযুক্ত করা হয় যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার ব্যক্তিকে। তবে বিগত কয়েকটি কমিশন অতিরিক্ত সচিব এমনকি পূর্ণাঙ্গ সচিবকেও এই নিম্নপদটিকে ‘সচিব’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেণ। সীমিত এখতিয়ার সম্পন্ন এই ‘সচিব’ কখনোই মন্ত্রণালয়ের সচিবের সমকক্ষ নন। আইন ও বিধিতে কমিশন কর্তৃক সচিব নিযুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও বিগত কয়েকটি কমিশনে সচিব নিয়োগ দেয়া হয়েছে সরকার কর্তৃক। সচিব নিয়োগ দিয়ে কমিশনে পাঠায়। কমিশন সেটি গ্রহণ করে। সচিবের এই নিয়োগ প্রক্রিয়া অতীতে বহু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তবে সব বিতর্ককে ছাপিয়ে গেছে বর্তমান কমিশনের সচিব সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত। সাচিবিক দায়িত্ব পালনের বাইরে দুদক সচিবকে দেয়া হয়েছে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা। যা কমিশনের স্বাধীন ও স্বশাসন সত্ত্বাকেই শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, প্রতিষ্ঠানটিকে বিলুপ্ত ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’র অবস্থায় ফিরিয়ে নেবে। এমন আশঙ্কা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টান্যাশনালসহ সুশীল সমাজের।

আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’ (টিআইবি) বলছে, এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে বিলুপ্ত ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’র মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।
গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে এ মন্তব্য করে সংস্থাটি। দুদক সচিবের জারি করা ‘ডেলিগেশন অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল পাওয়ার’ (প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ) বিষয়ক কার্যালয় আদেশে অনুসন্ধান ও তদন্তে নিয়োজিত উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের পদায়ন ও বদলির ক্ষমতা দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের হাত থেকে সরিয়ে সচিবের হাতে ঢালাওভাবে ন্যস্ত করা হয়েছে। এর ফলে দুর্নীতি প্রতিকারে কমিশনের ক্ষমতা পদদলিত হওয়ার ভয়ানক শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে কার্যাদেশটি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।

গত ১৮ ডিসেম্বর ওয়েবসাইটে এ বিষয়ক আদেশ প্রকাশ করে দুদক। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রশ্ন রাখেন, সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী দুদকের নির্বাহী ক্ষমতা চেয়ারম্যান ও তার নেতৃত্বে কমিশনারদের হাতে অর্পিত এই প্রতিষ্ঠানের মূল ম্যান্ডেট-সংক্রান্ত উক্ত নির্বাহী ক্ষমতা ঢালাওভাবে সচিবের হাতে অর্পণের এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি কী প্রক্রিয়ায়, কোন যুক্তিতে হলো ? কমিশনের ক্ষমতা খর্ব হবার শঙ্কার বিষয়টি কতোটা বিবেচিত হয়েছে? সিদ্ধান্তটি কি কমিশন কর্তৃক সজ্ঞানে গৃহিত, নাকি এতোদিন ‘নখদন্তহীন বাঘ’ হিসেবে কথিত এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাকে বাস্তবে রূপান্তরের এক অশুভ প্রয়াসের ফসল, এমন প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। এসব প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর প্রাপ্তি জরুরি, বিশেষ করে কমিশন কেন নিজের হাতে থাকা উক্ত ক্ষমতাসহ আরও কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ এখতিয়ার সচিবের তথা আমলাতন্ত্রের হাতে নিরঙ্কুশভাবে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো? সেটিরও স্পষ্টীকরণ প্রয়োজন।

বিভিন্ন সংবাদগ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এই সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও বিভাগের দৃষ্টান্ত অনুসরণের যে ব্যাখা দুদকের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে তা দুদক যে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান নয় তা অনুধাবনে ব্যর্থতার পরিচায়ক। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক এই অশুভ কার্যালয় আদেশ অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শুধু উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়নই নয়, এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের বলে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের চাকুরী স্থায়ী ও নিয়মিতকরণ, চলতি দায়িত্ব প্রদান, ভাতা ও ছুটি, পেনশন, পিআরএল এবং মামলার সাজার প্রেক্ষিতে পুরস্কার ইত্যাদি সকল ক্ষমতা আমলাতন্ত্রের হাতে অর্পিত হওয়ায়, দুদক এখন পুরোপুরিভাবে প্রাক্তন ব্যুরোতে সম্পূর্ণভাবে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে আর কিছুই বাকি থাকলো না।

টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, এই আদেশের ‘ছ’ অনুচ্ছেদের ৪ নম্বর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যে রূপ ঢালাওভাবে দুদক আইনের ১৬ ধারার আওতাভুক্ত সকল এখতিয়ার বাসন্তবায়নের ‘পূর্ণ ক্ষমতা’ সচিবের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে, তার বলে উক্ত আইনের ৩(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দুদকের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হওয়ার জনপ্রত্যাশার কফিনের শেষ পেরেক ছাড়া আর কিছুই নয়।
টিআইবি উক্ত কার্যালয় আদেশকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূণ্য সহনশীলতার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে পদদলিত করার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের হতাশাব্যঞ্জক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করছে এবং অবিলম্বে এর প্রত্যাহারের আহ্বান জানাচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন