বাড়ি বিশেষ একটি জেলায়। এই পরিচয়ে দোর্দÐ প্রতাপে তিনি করে যাচ্ছেন চাকরি। নিয়েছেন পদোন্নতি। পাচ্ছেন প্রাইজ পোস্টিংও। সরকারি চাকরি করলেও তার শরীরটাই শুধু এদেশে। মন চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রে। ফি বছর তাকে নিয়ম করে ‘হাজিরা’ দিতে হয় পশ্চিমা ওই দেশটিতে। জনহয়রানি ও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও কোনো মুখোমুখি হতে হয়নি শাস্তির। এমনকি বিভাগীয় ব্যবস্থাও যেন তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ঘুষ, দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থপাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে কয়েক বছর। অনেকটা ‘তলানি’ খুঁজে না পাওয়ার মতো। কেবলই হাত বদল হচ্ছে। এক কর্মকর্তা থেকে আরেক কর্মকর্তা। দায়ের হয়নি কোনো মামলা। দুর্নীতি ও জনহয়রানির এই ‘যুবরাজ’ আর কেউ নন। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের উপ-পরিচালক মাসুম হাসান। এখন কর্মরত টাঙ্গাইল পাসপোর্ট আঞ্চলিক অফিসে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের উপ-পরিচালক যেখানেই পোস্টিং পেয়েছেন সেখানেই জনহয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন মানুষ। গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির শক্ত সিন্ডিকেট। তিনি যখন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসে ছিলেন, তখন সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েন মানুষ। মাসুম হাসানের প্রত্যক্ষ মদদে বিস্তার ঘটে দালাল-দৌরাত্ম্যের। চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ কার্যালয়ে পাসপোর্ট করতে আসা মানুষকে পদে পদে গুনতে হয়েছে বাড়তি টাকা। দরখাস্তে নানা ত্রæটি-বিচ্যুতি ধরে দালালচক্রের সদস্যদের মাধ্যমে ঘুষ নিতেন তিনি। যশোরে ছিলেন দীর্ঘদিন। রংপুর অফিস ভাজা ভাজা করে টাঙ্গাইল অফিসে এখন দিয়ে চলেছেন ‘অভিন্ন সেবা’। দালাল ছাড়া এখানে এখন সেবা মেলা ভার। গুনতে হচ্ছে সরকারি ফির অতিরিক্ত টাকা। ৫ বছর মেয়াদি সাধারণ পাসপোর্ট পেতে সরকারি ফি লাগে ৬৮২৫ টাকা। ১০ বছর মেয়াদির ফি ৮,০৫০ টাকা। কিন্তু দ্রæত পাসপোর্ট পাইয়ে দেয়ার প্রলোভনে দালালচক্রের সদস্যরা নিচ্ছেন অতিরিক্ত ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। নবায়নের ক্ষেত্রেও লাগে সরকারি ফির অতিরিক্ত ২ থেকে ৪ হাজার টাকা। আদায়কৃত অতিরিক্ত টাকার ৫০ ভাগ নেন মাসুম হাসান। ৩০ ভাগ অফিস স্টাফদের মধ্যে ভাগ-বাটোরা হয়। ২০ ভাগ টাকা থাকে দালালদের পকেটে। এই ‘লাইন‘ মতো না এলে ভোগান্তির অন্ত নেই পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের। প্রচলিত দৃশ্যমান এসব ‘উপরি‘র বাইরেও অনেক খাত রয়েছে মাসুম হাসানের। চট্টগ্রামে থাকাকালে তার হাত দিয়েই হয়েছে বহু রোহিঙ্গা পাসপোর্ট। বিনিময়ে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। কিন্তু কোথায় এই টাকা? সেই খোঁজে নেমেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০১.০১.০২৪.১৯-৫১৬, তারিখ: ০৫/০১/২০২০ খ্রি:)। ৩৬টি দফতরে তন্ন তন্ন করেও নাকি মাসুমের ‘অবৈধ সম্পদ’ বলে কিছু পাওয়া যায়নি।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গোপালগঞ্জ কাশিয়ানি থানার শঙ্করপাশা গ্রামের এম এম হাসানের পুত্র মাসুম হাসান। ২০০৭ সালের ৮ জুলাই যোগ দেন পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন বিভাগের সহকারী পরিচালক হিসেবে। প্রথম পোস্টিং হবিগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে। ২ বছর পর বদলি হয়ে আসেন সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অ্যান্ড ভিসা অফিসে। ২০১২ সালে বদলি হন যশোরে। সেখান থেকে উপ-পরিচালক পদে পদোন্নতিসহ পোস্টিং পান ময়মনসিংহ কার্যালয়ে। সেখান থেকে রংপুর পরে আবার ময়মনসিংহ জেলা অফিস। ২০১৫ সালে চলে আসেন ঢাকা বিভাগীয় অফিসে। ২০১৮ পর্যন্ত ছিলেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট পাসপোর্ট অফিসে। ২০১৯ সালে ফরিদপুর আঞ্চলিক অফিসে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে। সহকারী পরিচালক হিসেবে তিনি বেতন পেতেন ৪০ হাজার টাকার মতো। উপ-পরিচালক হিসেবে সাকুল্যে বেতন তুলছেন ৬০ হাজার টাকা। সরকারি এ কর্মকর্তার এর বাইরে দৃশ্যমান কোনো আয় নেই। সীমিত এই আয় থেকেই তিনি ২০১৪ সালে ঢাকার দক্ষিণ বনশ্রীর বøক-কে, রোড-১৮, বাড়ি-১৯২, ‘সিনথিয়া ভিউ‘র ৪ তলায় কিনেছেন ১৯২৩ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট। প্রায় ২ কোটি টাকায় তিনি এই ফ্ল্যাট কিনলেও মাসুম হাসান এটির দলিল মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ৪১ লাখ ২২ হাজার ৭৫০ টাকা। দেড় কোটি টাকায় ২০১২ সালে উত্তরায় কিনেছেন (দলিল নং-৬৮৫৫/১২) ৪ কাঠার প্লট (মৌজা-বাউনিয়া, সিএস এবং এসএ-২৪৫৪, আরএসদাগ নং-৬২২২)। রেজিস্ট্রি খরচসহ এটির দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। যদিও মাসুম হাসান দাবি করছেন এই প্লট তার স্ত্রী সুমি আক্তার তার নামে কিনে দিয়েছেন। নিজের অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বৈধ করার লক্ষ্যে গৃহিণী স্ত্রীর নামে খুলেছেন আয়কর (টিআইএন নং-৫৯৮৯২২৮০৬৯৯০) ফাইল। স্ত্রীর নামে খুলেছেন বিও অ্যাকাউন্ট।
এছাড়া সরকারি এই কর্মকর্তা নিজেকে বানিয়েছেন ‘স্টক ব্যবসায়ী’। অথচ তার ৬টি বিও অ্যাকাউন্টের একটিতেও কোনো টাকা নেই। আয়কর নথিতে মাসুম স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য দেখিয়েছেন ৭৭,৮৪,২২০ টাকা। আর চাকরি জীবনে আয় দেখিয়েছেন ১ কোটি ২১ লাখ ৯৮ হাজার ৬৩৯ টাকা। স্ত্রী সুমি আক্তার গৃহিণী হলেও ট্যাক্স ফাইলে তার পারিবারিক আয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৫৪ লাখ ৪৮ হাজার ৬৩৯ টাকা। তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মূল্য দেখানো হয় ১ কোটি ১০ লাখ ৩৪ হাজার ২২০ টাকা, যা মাসুম হাসানের সরকারি চাকরিলব্ধ আয়ের প্রায় সমান। পুত্র মারজুক হাসান ও কন্যা মারজিয়া হাসান এখনও শিক্ষার্থী। চার সদস্যের এই পরিবারের ব্যয় নির্বাহেই মাসুমের চাকরিলব্ধ অর্থ খরচ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু পাসপোর্টের এই কর্মকর্তাকে বেতনের টাকায় হাতই দিতে হয়নি। বিত্ত-বৈভব করেছেন ‘উপরি’ আয় দিয়ে। অবৈধ অর্থের উৎস গোপন করতে স্ত্রীর নামে খুলেছেন ট্যাক্স ফাইল। তবে তার সব সম্পত্তি নিজের কিংবা স্ত্রীর আয়কর নথিতে উল্লেখ করেননি।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, পাসপোর্ট হেড অফিসের কাছে ৬০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন একটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে মাসুমের। এছাড়া বেনামে রয়েছে বিনিয়োগ এবং সম্পত্তি। এসবের কোনো তথ্য নেই আয়কর নথিতে। জানা গেছে, সাবেক পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম, উপ-পরিচালক আবু নোমান মো. জাকির হোসেন, মহেরউদ্দিন শেখ, পরিচালক মো. আবু সাইদসহ পাসপোর্টের যে ক’জন মার্কিন ইমিগ্র্য্যান্ট, উপ-পরিচালক মাসুম হাসান তাদের একজন। পাসপোর্টে তিনি ‘ধনী কর্মকর্তা‘ হিসেবে পরিচিত। জি-১০ নামে পরিচিত পাসপোর্ট অধিদফতরের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের একজন মাসুম। সপরিবারে ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণের রেকর্ড রয়েছে তার। দুদক দীর্ঘদিন ধরে মাসুম হাসানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। অথচ তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানসহ কতবার কোন্ দেশ ভ্রমণ করেছেনÑ এবিষয়ক কোনো তথ্যই সংগ্রহ করেনি। বছর বছর যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের কী কারণ, বিদেশ ট্যুরের অর্থই বা আসে কোত্থেকে সেটিও খতিয়ে দেখেনি। দায়সারা প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে তাকে চলছে দায়মুক্তি প্রদানের প্রস্তুতি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, কয়েকজন কর্মকর্তার হাত ঘুরে এখন অভিযোগটির পুন: অনুসন্ধান করছেন দুদকের উপ-পরিচালক সেলিনা আখতার। তবে ‘অনুসন্ধানাধীন’ চলমান থাকায় মাসুম হাসানের বিষয়ে কোনো তথ্য দিতেই রাজি হননি তিনি। এই কর্মকর্তা মাসুম হাসানের বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। সম্পদ বিবরণী চেয়ে নোটিশের প্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রæয়ারি তিনি সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। এখন সেগুলো পুন: যাচাই চলছে।
এদিকে দুদকের অনুসন্ধান এবং অভিযোগ সম্পর্কে জনাতে একাধিকার ফোন করা হয় মাসুম হাসানের সঙ্গে। তবে তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠানোর পর এক মাসের বেশি অতিক্রান্ত হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন