দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)র মহাপরিচালকের পদ থেকে বিদায় নেয়া অতিরিক্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান যতো না মামলা রুজু এবং চার্জশিটের পক্ষে সুপারিশ করেছেন তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দিয়েছেন দায়মুক্তি। মুখে শুদ্ধাচারের বাণী আওড়ালেও তার আপাদমস্তকে ছিলো দুর্নীতির চাষাবাদ। দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ)র মতো গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারটিকে তিনি বানিয়েছেন ক্ষমতার অপব্যবহারের হাতিয়ার। পরিণত করেছেন অর্থ উপার্জনের মেশিনে। দুদকের বিগত চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের আস্থাভাজন ও দুর্নীতির একনিষ্ঠ সিপাহসালার ছিলেন সাঈদ মাহবুব খান। নিরীহ ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, ভূমি অফিসের নিম্ন বেতনের কানুনগো, ক্লার্ক, এমএলএসের দুর্নীতি অনুসন্ধান-তদন্ত প্রশ্নে প্রচন্ড রকম আপসহীন অবিভ্যক্তির প্রকাশ ঘটাতেন। সস্তা বাহবা নিতেন চুনোপুটিদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও গ্রেফতার করে। ব্যাপক প্রচার নিতেন ‘১০৬‘ হটলাইনে আসা কথিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন দফতরে ‘অভিযান‘ পরিচালনার মাধ্যমে। কিন্তু দুর্নীতিবাজ রাঘব বোয়ালদের দায়মুক্তি দিতেন নিঃশব্দে। দায়মুক্তির তথ্য গণমাধ্যমকর্মীদের হাত অবধি যাতে না পৌঁছায় সেলক্ষ্যে নিয়েছেন কঠোর গোপনীয়তার কৌশল। তবে গোপনীয়তার সব কৌশল ব্যর্থ করে দিয়ে ইনকিলাব প্রতিবেদকের হাতে এসেছে সাঈদ মাহবুব খান গংয়ের দেয়া বহু দায়মুক্তির প্রমাণ। মূলত : প্রভাবশালী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান প্রধান, প্রশাসন ক্যাডারের দুর্নীতিবাজদের অকাতরে দায়মুক্তি দিয়েছেন সাঈদ মাহবুব খান। কারও কারও ক্ষেত্রে নিজে নেপথ্যে থেকে দায়মুক্তি প্রদানে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন। অনুসন্ধান-তদন্তের ক্ষেত্রে অধীনস্ত কর্মকর্তাদের দিয়েছেন ম্যানুয়াল-বহির্ভুত নির্দেশনা। এবাবে গত এক বছরে তিনি দায়মুক্তি দিয়েছেন বহু দুর্নীতিবাজকে। এর মধ্যে দুদককর্মীদের মুখে মুখে আলোচিত হচ্ছে বেশ কয়েকটি দায়মুক্তি প্রদানের ঘটনা।
রেকর্ডপত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)র তৎকালীন কমিশনার মো. রেজাউল কাদেরকে দায়মুক্তি দেন। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ছিল। দুদকের উপ-পরিচালক মো. সিরাজুল হক অভিযোগটি অনুসন্ধান করেন। এই অনুসন্ধানটি হয় দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান-তদন্তের দায়িত্বে থাকা মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খানের ফরমায়েশ অনুসারে। এমনভাবে অনুসন্ধান প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়-যাতে কোনো ‘কয়েরিজ’ও দেয়া হয়নি।
জানা গেছে, রেজাউল কাদেরের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানটি দুদকের বিদ্যমান গাইডলাইন বা ম্যানুয়াল অনুসরণ না করেই পরিসমাপ্ত করা হয়েছে। সাঈদ মাহবুবের স্বাক্ষর চলতি বছর ১১ মে দায়মুক্তি (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০০/৭৮/০০১.২২.৪০) দেয়া হয় মো. রেজাউল কাদেরকে।
ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের জয়েন্ট কমিশনার (লজিস্টিক ও প্রকিউরমেন্ট) ইমাম হোসেনের বিরুদ্ধে ছিল কেনাকাটায় অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থের বিনিময়ে পছন্দের ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেয়ার অভিযোগ। পুলিশের রেশন সামগ্রি কেনা-কাটা, অন্যান্য সামগ্রী ও গাড়ির যন্ত্রাংশ ক্রয়ের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন ইমাম হোসেন। তার বিরুদ্ধে মামলা রুজুর অকাট্য প্রমাণ হাতে আসা সত্ত্বেও দুদকের তৎকালীন মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খান তাকে দায়মুক্তি (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০০.৫০.০৪১.২২.৪১) দেন। গুরুতর এই দুর্নীতির অভিযোগ থেকে প্রভাবশালী এই পুলিশ কর্মকর্তাকে তিনি দায়মুক্তি দেন চলতিবছর ১২ মে। এ সময় তিনি সচিবের ‘রুটিন দায়িত্ব’ পালন করছিলেন। অভিযোগটি অনুসন্ধান করেন উপ-পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিউট (বিএসটিআই)র তৎকালীন পরিচালক (প্রশাসন) মো. খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে রয়েছে নিয়োগ বাণিজ্য, নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নামে-বেনামে বিপুল সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ। দুদক থেকে বদলি হয়ে যাওয়া তৎকালীন মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরীর নির্দেশনা বিএসটিআই’এ ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম। অভিযানকালে দুদক টিম নিয়োগ বাণিজ্যের প্রমাণ পায়। বিএসটিআইর অফিস সহায়ক পদে নিয়োগ পরীক্ষার টেবুলেশন শিট জালিয়াতির মাধ্যমে নম্বর পরিবর্তন করে ৬ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। টেবুলেশন শিটে নিয়োগ কমিটির সদস্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী থাকা সত্বেও তাকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। ৭৭টি শূন্যপদের বিপরীতে ৬৮জনকেই নিয়োগ দেয়া হয় অর্থের বিনিময়ে। দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ফরিদপুর অফিসের অফিস সহায়ক মো. রূহুল আমিন পরিচালক (প্রশাসন) খলিলুর রহমানের শ্যালিকার ছেলে। ফরিদপুর ডাটা এন্ট্রি ও কন্ট্রোল অপারেটর সফিকুল ইসলাম খলিলুর রহমানের ভাতিজা। ঢাকায় কর্মরত খালাসি মো. সালাউদ্দিন খলিলুর রহমানের চাচাতো শ্যালক। ফরিদুপরের ডাটা এন্ট্রি ও কন্ট্রোল অপারেটর মহিউদ্দিন পরিচালকের ভাতিজি জামাই। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া এই অনুসন্ধানটিতে পর্যাপ্ত প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও ইকবাল মাহমুদ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়মুক্তি দেয়া চেষ্টা করেন। শেষ মুহূর্তে সেটি করে যেতে না পারলেও তার ধামাধরা হিসেবে দুদকে থেকে যাওয়া সাঈদ মাহবুব খান দায়মুক্তি দেন। দুদকের সহকারী পরিচালক শেখ গোলাম মাওলা ও উপ-সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে একটি টিম অভিযোগটি অনুসন্ধান করছিল। পরে উপ-পরিচালক মামুনুর রশিদ চৌধুরী সাঈদ মাহবুবের নির্দেশনায় পরিসমাপ্তির সুপারিশ প্রদানে বাধ্য হন। গত ২৫ এপ্রিল দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনের স্বাক্ষরে মো. খলিলুর রহমানকে দায়মুক্তি (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০০.৫০.০৩৭.২২.৩৭) দেয়া হয়।
জিওবি’র অর্থে উন্মুক্ত জলাশয়ে আহরণযোগ্য মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠির আর্থ সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাৎ এবং নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ছিল মৎস্য অধিদফতরের প্রকল্প পরিচালক মো. মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে। দুদদকের যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন অভিযোগটি অনুসন্ধান করেন। তাকে দায়মুক্তি (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৬৭১.৩১.০২৫.২২.৩৭) দেয়া হয় গত ৮ মার্চ।
পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ)র তৎকালীন ব্যবস্থপনা পরিচালক মো. মাহবুবুর রহমানকে দায়মুক্তি (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০০.৫০.০৩৪.২২.৩৪) দেয়া হয় গত ১৯ এপ্রিল। তার বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, নামে বেনামে অবৈধ সম্পদ অর্জনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। উপ-পরিচালক (পদোন্নতিপ্রাপ্ত পরিচালক) মো. মোশাররফ হোসেইন মৃধা অভিযোগটি অনুসন্ধান করেন।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)র প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে ছিল ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, দুর্নীতি এবং সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ। এছাড়া সিডিএ’র ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পে পছন্দসই ঠিকাদার নিয়োগ প্রদান করেন তিনি। অভিযোগ ছিল, লালখান বাজার থেকে শাহ আমনত বিমান বন্দর পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পে শর্ত পরিবর্তন করে ৬টি ঠিকাদারের মধ্যে ২ হাজার ৮৫৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকার কার্যাদেশ ২০ কোটি টাকার লেনদেন করে ভাগভাটোয়ারা করে দেয়ার অভিযোগ ছিল। সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করেন উপ-পরিচালক শাহীন আরা মমতাজ। মামলার পরিবর্তে অনুসন্ধান প্রতিবেদনে ‘পরিসমাপ্তি’র সুপারিশ করা হয়। বিপরীতে লেনদেন হয় অন্তত : ২ কোটি টাকা। গত ১৮ মে দুদক সচিবের ‘রুটিন দায়িত্বে’ থেকে সাঈদ মাহবুব খান প্রভাবশালী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমানকে দায়মুক্তি (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০০.৫০.০৪৪.২২.৪৪) দেন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তৎকালীন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (সিনিয়র সহকারি সচিব) আসিফ ইমতিয়াজকে দায়মুক্তি (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৬৭১.৩১.৩০২.২১.৩১৮)দেয়া হয় গত ১৩ মার্চ। প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরকারি অর্থ লেনদেন, সরকারি অর্থ নিজের একাউন্টে রাখা এবং ভূমি অধিগ্রহণের অর্থ প্রকৃত ভূমি মালিককে না দিয়ে ভুয়া দাবিদারদের প্রদান এবং বিপুল অবৈধ অর্থ অর্জনের অভিযোগ ছিলো। দুর্নীতির পর্যাপ্ত প্রমাণাদি সত্ত্বেও দায়মুক্তি দেয়া হয় আসিফ ইমতিয়াজকে। একজন প্রশাসন ক্যাডারকে বাঁচাতে গিয়ে দায়মুক্তি দেয়া হয় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লি:র কর্মকর্তা মো. খোরশেদ আলমকেও।
বাংলাদেশ জুট করর্পোরেশনের (বিজেসি)র তৎকালীন চেয়ারম্যান, অতিরিক্ত সচিব মো. শামীম ইকবালসহ তিন জনকে দায়মুক্তি (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০০.৫০.০৩৫.২২.৩৫) দেয়া হয় গত ২০ এপ্রিল। তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ছিলো। দায়মুক্তি পাওয়া বিজেসি’র অপর দুই কর্মকর্তা হলেন, পারচেজ অফিসার খায়রুল আলম ও পারচেজ অফিসার মো. হাবিবুর রহমান। হাবিবুর রহমান ইন্তেকাল করায় তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অভিযোগটি অনুসন্ধান করেন দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন