দীর্ঘ কয়েক যুগ পর টোটাল ফুটবলের এক অভ‚তপূর্ব ও অবিস্মরনীয় শৈলী দেখল সারা বিশ্ব। ফুটবল মানেই যে শুধু একক কোনো ফুটবলারের ব্যক্তিগত নৈপূণ্য নয়, সকল খেলোয়াড়ের টিম ওয়ার্ক যে দর্শকদের হৃদয় এবং চোখ উভয়কেই জুড়িয়ে দিতে পারে তারই এক জ¦লন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে গতপরশু রাতে কাতার বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা-পোল্যান্ড ম্যাচটি।
শুরুতেই দলের সবাচইতে বড় তারকা লিওনেল মেসির পেনাল্টি মিসের পরও স্টেডিয়াম ৯৭৪-এ অনুষ্ঠিত ম্যাচটিতে একতরফা প্রাধাণ্য বিস্তার করে আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে পোল্যান্ডকে হারিয়ে ‘সি’ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে শুধু শেষ ষোলতেই জায়গা করে নেয় নি, পাশাপাশি সারা পৃথিবীর শতশত কোটি ভক্তদের মনে আশাও জাগিয়েছে যে এবারের বিশ^কাপে আর্জেন্টিনার ভালো কিছু করার যোগ্যতা এবং সম্ভাবনা দুইই রয়েছে। প্রথমার্ধে অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যলিস্টারের গোলে এগিয়ে যাবার পর দুবারের বিশ্চ্যাম্পিয়নদের হয়ে দ্বিতীয়ার্ধে ব্যবধান বাড়ান হুলিয়ান আলভারেজ।
আগামীকাল শনিবার রাতেই শেষ ষোলয় আর্জেন্টিনা খেলবে ১৬ বছর পর বিশ^কাপের নকআউটে নাম লেখানো অস্ট্রেলিয়ার। মেসিদের সঙ্গে হেরে গিয়েও গোলব্যবধানে এগিয়ে থেকে শেষ ষোলর টিকিট পেয়েছে পোল্যান্ডও। তাতে কিছুটা ভাগ্যের ছোঁয়াও পেয়েছে রবের্ত লেভান্দেভস্কিরা। লুসাইলে একই সময়ে হওয়া গ্রæপের অপর ম্যাচে সউদী আরবকে ২-১ গোলে হারিয়েও ছিটকে গেছে মেক্সিকো। আর একটি গোল করতে পারলেই পোল্যান্ডের জায়গায় নকআউটে জায়গা পেতে পারতো উত্তর আমেরিকার দেশটি। তাতে মেসিদের পরদিন রোববার রাত ৯টায় পোলিশরা মুখোমুখি হবেন বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের।
এদিন রাস আবু আবুদের মাঠে বল কন্ট্রোল, নিখুঁত পাসিং, প্ল্যানড অ্যাটাক ও কনিফেডেন্ট ডিফেন্স- সবকিছুতেই আর্জেন্টিনার মুন্সিয়ানা ছিল এক চেটিয়া। মেসি-ডি মারিয়াদের অপূর্ব ফুটবল শৈলী দেখে এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল যেন এটা বাস্তবের মাঠের কোনো ফুটবল নয়, নতুন প্রজন্ম যেন কম্পিউটারে ভিডিও গেমসের ফুটবল খেলছিল। আর্জেন্টিনার ফুটবল নৈপূণ্যের কাছে প্রতিদ্ব›দ্বী পোল্যান্ড এতটাই পর্যুদস্ত ছিল যে পায়ে বল পাওয়া তো দূরের কথা যেন রেফারির শেষ বাঁশিটিই ছিল তাদের কাছে বেশি প্রতীক্ষিত। মেসিদের ৭৪ শতাংশের বীপরিতে পোল্যান্ডের দখলে বল ছিল যে কেবল ২৬ শতাংশ! নিখুঁত টাইমিংয়ে আলিবিসেলেস্তাদের পাসিং অ্যাকুরেসি ছিল ৯২%। বল নিয়ন্ত্রণেও দক্ষতার ছাপ রেখেছেন মেসি-মারিয়ারা। গোলমুখে শট নেওয়া ২৩টির ১২টিই ছিল লক্ষ্যে। বল দখলে না পাওয়া পোল্যান্ড শটই নিতে পেরেছে কেবল ৪টি, যার একটিও ছিলনা ঠিকানামুখে।
তবে ম্যাচের আগে সংশয় অবশ্যই ছিল, সঙ্গে বহু অঙ্ক-সমীকরণ মেলাতে হচ্ছিল আর্জেন্টিনাকে। আতঙ্ক কি একটুও ছুঁয়ে যায় নি? হয়ত বা গিয়েছিল দলটির ম্যানেজার লিওনেল স্কালোনিকে। যদি গোল হয়, যদি না হয়? গোল হলে দলের করণীয় কী হবে, না হলেই বা কোন কৌশলে যাবে। এই ধরনের হাজারটা হিসেব কষতে হচ্ছিল আর্জেন্টিনা দলকে। সেই সংশয় ছুঁয়ে যাচ্ছিল গোটা পৃথীবিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখো-কোটি আর্জেন্টাইন সমর্থককে। নিজেদের ম্যাচের সঙ্গে আরেক চোখ যে রাখতে হয়েছে অন্য ম্যাচের দিকেও। আরও কত গণিতের হিসেব আর ফুটবলীয় সমীকণ যে গুণতে হয়েছে আর্জেন্টিনা ফুটবল সংশ্লিষ্টদের, সে হিসেব হাতের কড়ে কি আর করে শেষ করা যাবে?
সেই সকল হিসেব নিকেষ শেষ হয়ে গেল ম্যাচ শুরুর পরই। দোহার ৯৭৪- স্টেডিয়ামে ‘সি’গ্রæপের শেষ রাউন্ডে পরশুরাতে পোল্যান্ডের বিপক্ষে শুরু থেকেই আক্রমণের ফুলঝুরি সাজালো আলবিসেলেস্তারা। আরেকটু ঠিকঠাক করে বললে পোলিশরাই সেই রাস্তা বাতলে দিল। লেভান্দোভস্কিকে সামনে রেখে বাকি নয় ফুটবলারই নেমে গেলেন রক্ষণ সামলাতে। প্রতিপক্ষকে যখন এভাবে আক্রমণের নিমন্ত্রণ জানানো হয়-তখন যা আবশ্যক, তাই করলেন মেসি-আলভারেজরা। প্রথমার্ধে আলবিসেলেস্তারা এগিয়ে যেতে পারলো না মেসির পেনাল্টি মিসে। তবে সুই দুঃখ মোচন হয়ে যায় ম্যাক অ্যালিস্টারের মাধ্যমে। বিরতির পর এই মিডফিল্ডার মাত্র ১ মিনিট নিলেন গোল করতে। মিনিট বিশেক পর আলভারেসও জানিয়ে দিলেন অত সহযে লড়াই থামাচ্ছে না আর্জেন্টিনা।
আর্জেন্টিনা এদিন দেখালো অধিনায়ক মেসি পেনাল্টি মিস করলেও মাথা নিচু করে থাকার দিন শেষ। বুঝিয়েছে, বিশ্বজয়ের যে স্বপ্নটা গত চার বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন মেসি, সে স্বপ্নটার অকালমৃত্যু ঠেকাতে এখন এসে গেছেন আলভারেস-ম্যাক অ্যালিস্টার-ফের্নান্দেসের মতো তরুণরা। প্রথম ম্যাচে সউদী আরবের কাছে হুট করে হেরে যাওয়ার ব্যাপারটাকে যারা বিশ্বজয়ের পথে একটা ছোট্ট গতিরোধক হিসেবে প্রমাণ করতে ছিলেন বদ্ধপরিকর!
তিন ম্যাচের মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ফুটবল আর্জেন্টিনা গতপরশু রাতেই খেলেছে। তবে এর পেছনে পোল্যান্ডের রক্ষণনির্ভর কৌশলের দায় অনেক বেশি। শুরু থেকেই মেসি, এনজো ফার্নান্দেস, ম্যাক অ্যালিস্টার, মার্কাস আকুনিয়া, আলভারেস আর অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ারা পোল্যান্ডের ডি-বক্সের আশপাশ দিয়েই ঘুরঘুর করেছেন। তবে পোলিশ গোলকিপার সেজনির পেছনের জালটার ঠিকানা পায়নি। অপরপ্রান্তে লেভান্দোভস্কির চুপচাপ হতাশ হয়ে সতীর্থদের অসহায় রক্ষণ দেখা ছাড়া কাজ ছিল না কোনো। এমন অবস্থাতেই হুট করে গোলের সুযোগ এল আর্জেন্টিনার সামনে। তাও আবার পেনাল্টিতে। কর্নার থেকে আসা বল আটকাতে গিয়ে নাগাল পাননি শেজনি, বল মেসির মাথা খুঁজে পেলেও, সেজনির আঙুল ভুলক্রমে ছুঁয়ে গিয়েছিল মেসির মুখমন্ডল। তাতেই রেফারির মনে হল পেনাল্টি। সে পেনাল্টি থেকে গোল করতে পারলেন না মেসি। টানা দুই বিশ্বকাপে এই নিয়ে পেনাল্টি মিস করলেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। অসাধারণ শট ঠেকিয়ে দিলেন সেজনি।
আগের বিশ্বকাপে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের ম্যাচটায় মেসির পেনাল্টি মিসের পর আর্জেন্টিনা আরও খাপছাড়া হয়ে গিয়েছিল। আর এখানেই চার বছর আগের আর্জেন্টিনার সঙ্গে চার বছর পরের দলটির সবচেয়ে বড় পার্থক্য। দলের সবচেয়ে বড় তারকার পেনাল্টি মিসের পর এবার দলটা খেই হারিয়ে ফেলেনি। ধৈর্য্যরে চ‚ড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে উল্টো পোল্যান্ডকে চেপে ধরেছে আরও আষ্টেপিষ্টে। দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাইটব্যাক নাহুয়েল মলিনার ক্রসে অ্যালিস্টারের মাপা শটে করা গোলটা তারই উজ্জল দৃষ্টান্ত। পরে সেটি আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে ৬৭ মিনিটে। আলভারেস বুঝিয়েছেন, লাওতারো মার্তিনেসকে বসিয়ে তাঁকে খেলানোর সিদ্ধান্তটা নিছক ভুল ছিল না স্কালোনির! অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ম্যানসিটি ফোয়ার্ডকে খেলানোর কারণে স্কালোনিকে শুনতে হয়েছিল গালি।
আর্জেন্টিনা জানত ড্র করলেও সমস্যা হবেনা, তবে তাদের জয়ই প্রয়োজন ছিল। ওদিকে মেক্সিকোর বিপক্ষে সউদী হার নিশ্চিত করেছে, ড্র করলেও আলবিসেলেস্তারা পরের রাউন্ডের টিকিট কাটত সেই কারণেই। সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় রাউন্ডেই সি গ্রæপের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের মুখোমুখি হওয়া লাগত, যারা ২০১৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিদায়ী ফরমান এনেছিল দ্বিতীয় রাউন্ডেই। কিন্তু নিজের হাতে ভাগ্য গড়ার সুযোগ থাকলে আর্জেন্টিনা সে পথ মাড়াবে কেন? পোল্যান্ডকে ‘নকআউট পাঞ্চ’ মেরেই নকআউট-ট্রেনের টিকিট কাটল আর্জেন্টিনা।
১৯৮৬ সালে ডিয়াগো ম্যারডোনার আর্জেন্টিনার ফুটবল শৈলী বর্তমান আর্জেন্টিনার আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তার মূল উপাদান। দীর্ঘ প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় পর সেই ফুটবলই দর্শকরা দেখতে পেল মেসির আর্জেন্টিনার কাছে। এমন দ্যুতিময়, দুর্দান্ত আর্জেন্টিনাকেই তো দেখতে চায় গোটা বিশ্ব।
আজকের খেলা
দ.কোরিয়া-পর্তুগাল, রাত ৯টা
ঘানা-উরুগুয়ে, রাত ৯টা
সার্বিয়া-সুইজারল্যান্ড, রাত ১টা
ক্যামেরুন-ব্রাজিল, রাত ১টা
সরাসরি : বিটিভি/জিটিভি/টি স্পোর্টস
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন